Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আজুলেজো: পর্তুগালকে বিশ্বসভ্যতায় অনন্য করেছে যে শিল্প

পর্তুগালকে পৃথিবী যে জিনিসগুলোর জন্য চেনে, তার মধ্যে আজুলেজো টাইলস অন্যতম। পর্তুগালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে এই টাইলস। কোথায় নেই আজুলেজো? চার্চ, রাজপ্রাসাদ, বসতবাড়ি থেকে শুরু করে রেলস্টেশন পর্যন্ত সবখানেই আধিপত্য বিস্তার করে আছে আজুলেজো টাইলস

বসতবাড়িতে আজুলেজো; Image Source: praktyczne podroze

আজুলেজোর কল্যাণে পর্তুগালের ভবনগুলোর প্রতিটি খালি দেয়াল পরিণত হয়েছে ইতিহাসের সচিত্র ধারা বিবরণীতে। এর নান্দনিক সজ্জা দেশটিকে পরিণত করেছে এক শৈল্পিক প্রদর্শনীতে। পর্তুগালের সৌন্দর্যবর্ধন ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিনির্মাণে এই টাইলসের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

এখন নিশ্চয়ই আপনার জানতে ইচ্ছে করছে, কী এই আজুলেজো? কীভাবেই বা পর্তুগালের ইতিহাসে এর অনুপ্রবেশ? এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা থাকছে আজকের লেখায়।

নানারকম নকশাকাটা আজুলেজো; Image Source: 123RF.com

আজুলেজো চিনামাটির তৈরি একধরনের চকচকে নকশাদার টাইলস। শব্দটি এসেছে আরবি ‘আজেলিজ’ থেকে, যার অর্থ ‘চকচকে পাথর’। আজুলেজোর মতো রঙিন মৃতশিল্পের কারুকাজ বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন– মরক্কোতে পাওয়া যায়। মরক্কোতে এই টাইসলগুলো জেলিজ নামে পরিচিত।

আজুলেজোর উৎপত্তি

প্রথম চকচকে টাইলস ব্যবহার শুরু হয়েছিলো মিশর ও মেসোপটেমিয়াতে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬২০ অব্দে ফারাও জোসার তার স্থপতি ইমহোটেকে একটি পিরামিড তৈরি করতে বলেন। এই পিরামিডের সমাধিকক্ষের গ্যালারিগুলোতে সবুজ চকচকে রঙের টাইলস ব্যবহার করা হয়েছিলো। টাইলসের উপরের চকচকে অংশকে বলা হতো এনামেল। তাই উৎপত্তিগত দিক থেকে টাইলস পুরোপুরি প্রাচ্যের।

গ্রিক বা রোমানরা ঘরবাড়ি সাজানোর জন্য রং, ফ্রেসকো, এমনকি মোজাইক ব্যবহার করলেও টাইলস ব্যবহার করেনি। ধীরে ধীরে প্রাচ্যেও একসময় টাইলসের ব্যবহার বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর নবম শতাব্দীতে এসে সাসানিদ সম্রাটরা টাইলস পুনরাবিষ্কার করেন। তাদের প্রতিবেশী আব্বাসীয় খলিফারা তাদের রাজধানী বাগদাদকে সাজাতে এই দারুণ কৌশলটি কাজে লাগান। পরে দালানকোঠা সাজাতে টাইলস ব্যবহারের রীতি পুরো আরব ও মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফাতিমি খলিফাদের অধীনে থাকাকালে মিশরের কুমোররা কায়রোর রাজপ্রাসাদ, সমাধিসৌধ, মসজিদ প্রভৃতিতে এই টাইলসের বিস্তর ব্যবহার করেন। তারপর আরবদের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যে থেকে ইউরোপে আজুলেজো টাইলসের আমদানী ঘটে।

পর্তুগালে আজুলেজো

পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েল পঞ্চদশ শতকে একবার স্পেনে বেড়াতে যান। সেখানে আলহামরা প্রাসাদে আজুলেজোর কারুকাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন।

আলহামরা প্রাসাদে আজুলেজোর কারুকাজ; Image Source: pived mex.com

দেশে ফিরে তিনি সিন্ট্রাতে নিজের রাজপ্রাসাদও অমন নকশা দিয়ে সাজাতে চাইলেন। সেজন্য তিনি স্পেনের সেভিল থেকে আজুলেজো আমদানী করেন। এভাবেই মূলত আজুলেজো পর্তুগালে আসে এবং পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

আজুলেজোর বিবর্তন

প্রথম প্রথম আজুলেজো টাইলসে চাকচিক্যময় জ্যামিতিক নকশা শোভা পেত। জ্যামিতিক কারুকার্যখচিত টাইলসের উৎকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায় স্পেনের আলহামরা প্রাসাদে। তখন আলাদা আলাদা চিনামাটির খন্ডে জ্যামিতিক নকশা কেটে সেগুলো একসাথে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হতো আজুলেজো। এ ধরনের আজুলেজোকে বলা হতো আলিকাতাদো।

আলিকাতাদো অনেক ব্যয়বহুল ছিলো। তাছাড়া পুরোপুরি হাতে তৈরি করতে হতো বলে এর নির্মাণকাজ কষ্টসাধ্যও ছিলো। এজন্য কারিগররা ভাবলেন, সরাসরি চিনামাটির উপরই নকশা করবেন। এভাবে আজুলেজো দিনকে দিন আরো উন্নত হতে থাকে। প্রথমদিকের আজুলেজোগুলোতে মুসলিমদের আধিপত্যের কারণে আজুলেজোতে কোনো প্রাণীর ছবি আঁকা হতো না, সবই ছিল শুধু নানা কিসিমের জ্যামিতিক নকশা। কিন্তু ১৪৯২ সালে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের শেষ মুসলিম ভূখন্ড গ্রানাডার পতন হলে স্পেনে অনিবার্যভাবেই ইতালীয় রেনেসাঁর প্রভাব পড়লো। তখন স্পেনের স্থাপত্যশিল্পে, বিশেষ করে আজুলেজোতে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এদিকে ইতালিতে ততদিনে মেজোলিকার আবির্ভাব হয়েছে।

ফুলদানীতে মেজোলিকা; Image Source: 1stdibs.com

মেজোলিকা হচ্ছে ইতালিতে উদ্ভাবিত চিনামাটিতে রঙিন চকচকে নকশা আকার শিল্প। ফুলদানী, বাসন-কোসনসহ গৃহস্থালির সব উপকরণে ফুল, পাতা, মানুষসহ নানা জিনিসের রঙিন ছবি আঁকা হতো। ইতালির শহর ফায়েঞ্জা পরিণত হয়েছিল মেজোলিকা উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রে। ১৪৯৮ সালে ইতালির এক মেজোলিকা শিল্পী এলেন স্পেনের সেভিলে। নাম তার ফ্রান্সিসকো নিকোলাস। তিনিই প্রথম আজুলেজোতে মেজোলিকার প্রয়োগ ঘটান। তখন থেকেই সাদা, নীল, হলুদের আজুলেজোতে যোগ হয় লাল, সবুজ, বাদামী, কালো, বেগুনি প্রভৃতি উজ্জ্বল রঙ। আর জ্যামিতিক নকশা ছাড়াও আজুলেজোতে শোভা পেতে শুরু করলো মানুষসহ নানা প্রাণীর ছবি।

আজুলেজোতে শোভা পাচ্ছে প্রাণীর ছবি; Image Source: humid fruit

নতুন ধরনের এই আজুলেজো স্পেন তো বটেই, পর্তুগালসহ পুরো ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকা দেশগুলো, যেমন- ব্রাজিলেও পর্তুগিজ সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্নের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।

পর্তুগালের সংস্কৃতিতে আজুলেজোর প্রভাব

পর্তুগালের সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ ঘটেছে আজুলেজোর মাধ্যমে। এই সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মের মাধ্যমে বৈশ্বিক সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ হয়েছে। আজুলেজোর ব্যবহার পর্তুগালে এতটাই বিস্তৃত যে, দেশটির এমন একটি ঐতিহাসিক ভবনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এর ব্যবহার নেই। আজুলেজো তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি একই থাকলেও সময়ের আবর্তনে এর চেহারায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন আর আজুলেজো শুধু বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ সজ্জার উপকরণ নেই, বরং হয়ে উঠেছে বিশ্বস্থাপত্যের একটি মহান আবিষ্কার, পরিণত হয়েছে এক অনন্য সাধারণ শিল্পে।

তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদে আজুলেজোর নকশা; Image Source: havecamerawilltravel

বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন- স্পেন, ইতালি, তুরস্ক, ইরান, মরক্কোতে আজুলেজোর অহরহ ব্যবহার চোখে পড়লেও বিশ্বজুড়ে পর্তুগালের আজুলেজো এক বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে- দীর্ঘসময় ধরে পর্তুগালে এর ব্যাপক ব্যবহার, পর্তুগালের প্রতিটি ভবনের ভেতরে বা বাইরে, সদর দরজায় এর অবশ্যম্ভাবী ব্যবহার এবং গত কয়েক দশকজুড়ে শুধু সৌন্দর্যবৃদ্ধির একটি শিল্পই নয়, বরং নবায়নকৃত ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হওয়া। এভাবেই পর্তুগিজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য ও অনন্য এক উপাদানে পরিণত হয়েছে আজুলেজো।

অনন্য পর্তুগিজ আজুলেজোয় সজ্জিত দালান; Image Source: hostel world

আজুলেজো দর্শনের সেরা স্থানগুলো

পুরো পর্তুগালেই আজুলেজোর বিচিত্র কারুকাজ দেখতে পাওয়া গেলেও রাজধানী লিসবনই আজুলেজোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। পুরো লিসবন জুড়েই রয়েছে আজুলেজো দেখার দারুণ সব জায়গা, যার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় পর্তুগালের ইতিহাসকে, হারিয়ে যাওয়া যায় মোহনীয় রঙ ও নকশার ভুবনে। এমনি কয়েকটি জায়গার কথা চলুন জানা যাক।

ফ্রন্টেইরা প্যালেস

জমকালো আজুলেজো সমৃদ্ধ পর্তুগিজ স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য যেখানে মনভরে উপভোগ করতে পারবেন, তার মধ্যে অন্যতম ফ্রন্টেইরা প্যালেস। মূল শহরের কোলাহল থেকে দূরে অবস্থিত ১৭ শতকে নির্মিত এই প্রাসাদটি অভিজাত মার্কুইস দ্য ফ্রন্টেইরা পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তবে প্রাসাদের কিছু কিছু এলাকা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

দৃষ্টিনন্দন ফ্রন্টেইরা প্যালেস; Image Source: pic portugal

প্রাসাদের মূল বাগানের দেয়ালগুলোতে এবং ভেতরের কক্ষগুলোতে রয়েছে আজুলেজোর চোখধাঁধানো প্রদর্শনী। তবে প্রাসাদের একটি বিশেষ কক্ষ, দ্য ব্যাটল রুমের, আজুলেজোর সজ্জা এতটাই আকর্ষণীয় যে, এটি সিস্টিন চ্যাপেল অব টাইলস বলে আখ্যায়িত।

সাও ভিসেন্তে দ্য ফোরা

সতের শতকে নির্মিত এই আশ্রমটি লিসবনের অন্যতম সুন্দর একটি ভবন। এর মার্বেল হলগুলো, ভেতরের করিডোর এবং নির্জন মঠগুলোতে রয়েছে আজুলেজোর নয়নাভিরাম কারুকাজ।

আজুলেজোতে সাজানো আশ্রমের দেয়াল; Image Source: congelodosnotempo

দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে নানা সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি আঁকা হয়েছে এই আজুলেজোগুলোতে। সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত আশ্রমের একটি ভবনের দেয়ালে ফরাসি কবি ফন্টেইনের রুপকথা অঙ্কিত। 

ন্যাশনাল আজুলেজো মিউজিয়াম

ন্যাশনাল আজুলেজো মিউজিয়াম; Image Source: Time out

১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মিউজিয়ামটিতে রয়েছে পনের শতক থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত তৈরিকৃত আজুলেজোর বিশাল সংগ্রহ। এই ভবনটি ছিল মূলত রানী দ্য লিওনের দ্বারা ১৫০৯ সালে নির্মিত একটি মঠ। তারপর নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর এটি পরিণত হয় আজকের আজুলেজো মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামটিতে আজুলেজো তৈরির প্রক্রিয়া, এ কাজে ব্যবহৃত উপাদান ও প্রযুক্তির বিশদ প্রদর্শনীও রয়েছে, যা আপনার আজুলেজো সংক্রান্ত জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে।

ফ্রেবিকা ভিউভা লামেগো

এটি একটি আজুলেজো বিক্রির দোকান। ১৮৪৯ থেকে ১৮৬৫ সালের মাঝামাঝিতে নির্মিত এই ভবনটি ছিল মূলত অ্যান্টনিও কস্টা লামেগোর মৃৎশিল্পের কারখানা। এখানে তখন উৎপাদিত হতো কাদামাটির তৈরি নানা জিনিসপত্র। তারপর একসময় এখানে উৎপাদন শুরু হয় টাইলসের। একসময় এই টাইলস কারখানার একজন পরিচালক ফেরেইরা দাস টাবুলেটাস টাইলসের প্রচারণার জন্য কারখানার সদরদরজার সামনে টাইলস দিয়ে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন।

 জাঁকজমকপূর্ণ সাজে ফ্রেবিকো ভিউভা লামেগার সদরদরজা; Image Source: oculos do mundo

তারপর থেকে এই পর্যন্ত নানা সাজে সেজেছে লামেগোর এই কারখানা। এখন অবশ্য টাইলস তৈরি হয় অন্য জায়গায়, এখানে শুধু বিক্রি হয়।

This is a Bangla article on azulejo. The origin of this beautiful art, it's evolution and it's  uses in portugese culture are disscussed in this article. All the informations are hyperlinked inside the article.

Feature Image - culture trip

Related Articles