(২য় পর্ব পড়ুন)
“তুরস্ক যদি একটি বৈশ্বিক খেলোয়াড় হতে চায়, সেক্ষেত্রে ইস্তাম্বুল খাল কেবল একটি স্বপ্ন নয়, এটি একটি প্রয়োজন!”
-রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান
তুর্কি সরকারি কর্মকর্তারা বরাবরই ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে উক্ত খালের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। খালটি নির্মিত হলে তুর্কি জলসীমা দিয়ে নৌযান চলাচলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, এই অঞ্চলে নৌ পরিবহন আরো নিরাপদ হবে, চলাচলকারী নৌযানগুলো ইস্তাম্বুলের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে দূরে সরে যাবে, মার্মারা সাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের ক্ষেত্রে নৌযানগুলোর সময় সাশ্রয় হবে এবং তুর্কি সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে পারবে– এই বক্তব্যগুলোর ওপর তুর্কি সরকারি কর্মকর্তারা বেশি জোর দিয়েছেন।
কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আদৌ রয়েছে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বসফরাস প্রণালী ব্যবহারকারী জাহাজ কোম্পানিগুলো এখন পর্যন্ত কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের মধ্যে নতুন কোনো জলপথ নির্মাণের দাবি উত্থাপন করেনি। কার্যত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বসফরাস প্রণালী দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। যদিও প্রণালীতে অতীতে সময়ে সময়ে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে, সম্প্রতি তুর্কি সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নত যানজট ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
তুর্কি প্রণালীদ্বয়ে নৌ চলাচল সংক্রান্ত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বসফরাস অবজার্ভারে’র পরিচালক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটে’র ‘টার্কি প্রোগ্রামে’র নন–রেসিডেন্ট স্কলার ইয়োরুক ইশিকের ভাষ্যমতে, তুর্কিরা যদি সত্যিই এতদঞ্চলের নৌ পরিবহন আরো নিরাপদ করতে চায়, সেক্ষেত্রে নতুন খাল খননের পরিবর্তে উপকূলীয় নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও অত্যাধুনিক নৌ চলাচল সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত ছিল। হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে নতুন একটি খাল খননের তুলনায় এই পদক্ষেপ গ্রহণ তুর্কি সরকারের জন্য অনেক বেশি সাশ্রয়ী হতো।
তদুপরি, ইস্তাম্বুল খাল যে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বসফরাস প্রণালীর চেয়ে বেশি নিরাপদ হবে, এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। সংকীর্ণ খালগুলো বরাবরই নৌযান চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও সমস্যাসঙ্কুল, যেটি সম্প্রতি সুয়েজ খালে ‘এভার গিভেন’ জাহাজের আটকা পড়ে যাওয়া থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তীব্র বাতাস, স্রোত, যান্ত্রিক বা ইঞ্জিন সংক্রান্ত সমস্যা কিংবা মানবিক ত্রুটির কারণে উক্ত খাল দিয়ে চলাচলকারী জাহাজ নির্ধারিত পথ থেকে সরে গিয়ে খালটিতে নৌ চলাচল রুদ্ধ করে ফেলতে পারে। বস্তুত যেসব জাহাজের কাপ্তান জার্মান সংবাদ সংস্থা ‘ডয়েচ ভেলে’র টার্কিশ সার্ভিসকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন, তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন, ইস্তাম্বুল খালের চেয়ে বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ চালানোই তাদের কাছে অধিক পছন্দনীয়। অর্থাৎ, ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের পশ্চাতে তুর্কি সরকারি কর্মকর্তারা অর্থনৈতিক কারণ দেখালেও উক্ত প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক নয়।
বস্তুত ইস্তাম্বুল খাল খননের পেছনে থাকা সম্ভাব্য যে উদ্দেশ্য ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছে, সেটি হচ্ছে– খালটিতে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে ‘মনথ্রো কনভেনশন’ (Montreux Convention) প্রযোজ্য হবে না। ন্যাটো ডিফেন্স কলেজ ফাউন্ডেশনের বক্তব্য অনুসারে, তুর্কিরা উক্ত খালটি নির্মাণের পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি দেখালেও তাদের মূল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক। তারা ভূকৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথের ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক সুযোগ–সুবিধা আদায় করে নিতে ইচ্ছুক।
উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে সম্পাদিত মনথ্রো কনভেনশনের মাধ্যমে তুরস্ক বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের ওপর সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়, এবং প্রণালীদ্বয়ের মধ্য দিয়ে সামরিক নৌযান যাতায়াতের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। উক্ত বিধিনিষেধের কারণে রুশরা চাইলেই ইচ্ছেমতো প্রণালীদ্বয়ের মাধ্যমে নিজেদের নৌবহর কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রেরণ করতে পারে না, আবার কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত নয় এমন রাষ্ট্রগুলোও চাইলেই নিজেদের নৌবহর কৃষ্ণসাগরে প্রেরণ করতে পারে না। উভয় ক্ষেত্রেই প্রণালীদ্বয় অতিক্রমের জন্য তাদেরকে তুর্কি সরকারের অনুমতি নিতে হয়। তদুপরি, কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী নয় এমন রাষ্ট্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের নৌবহর কৃষ্ণসাগরে রাখতে পারে না।
এই কনভেনশনের মাধ্যমে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো উভয়েরই কিছু সুবিধা এবং কিছু অসুবিধা পেয়েছিল। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নৌবহরের কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ থাকায় তারা চাইলেই কৃষ্ণসাগরে সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়ার) বিরুদ্ধে তাদের পূর্ণ নৌশক্তি ব্যবহার করতে পারে না। এটি মস্কোর জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু একইসঙ্গে মস্কোর নৌবহরের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধিনিষেধ প্রযোজ্য, তাই সোভিয়েত/রুশ কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহরের জন্য এই অঞ্চলের বাইরে প্রভাব বিস্তার বা সামরিক হস্তক্ষেপ করা সমস্যাসঙ্কুল। এটি মস্কোর জন্য অসুবিধাজনক। এক্ষেত্রে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জন্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। কৃষ্ণসাগরে সোভিয়েত/রুশদের বিরুদ্ধে পূর্ণ নৌশক্তি ব্যবহার করতে না পারাটা তাদের জন্য অসুবিধাজনক, আর মস্কোর নৌবহরের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্য সুবিধাজনক।
রুশ–পশ্চিমা দ্বন্দ্বে তুরস্ক যদি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতো, সেক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের নিয়মাবলি তুরস্কের স্বার্থের অনুকূলে হতো, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন/রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব উভয়ের ক্ষেত্রেই তুর্কি প্রণালীদ্বয় ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধের কারণে তুরস্ক এই দ্বন্দ্ব থেকে নিজস্ব ভূখণ্ড/জলসীমাকে নিরাপদ রাখার সুযোগ পেত। কিন্তু তুরস্ক এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ নয় এবং ১৯৫০–এর দশক থেকে তারা মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতবিরোধী/রুশবিরোধী সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র সদস্য। একই সঙ্গে তুরস্ক সোভিয়েত কমিউনিজমের তীব্র বিরোধী ছিল এবং বর্তমানে মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার বিস্তৃত রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কার্যত তুরস্ক ও রাশিয়া পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক্ষেত্রে তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্বের নিকটবর্তী এবং এজন্য তুর্কি নেতৃবৃন্দের একাংশ কৃষ্ণসাগরে পশ্চিমা নৌ আধিপত্য বিস্তারের পক্ষপাতী।
কিন্তু তুরস্ক চাইলেই পশ্চিমা বিশ্বকে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে কৃষ্ণসাগরের সামরিকায়ন করার অনুমতি দিতে পারে না, কারণ মনথ্রো কনভেনশন অনুযায়ী আঙ্কারার সেই অধিকার নেই। তাছাড়া, উক্ত কনভেনশন অনুযায়ী বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয় দিয়ে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলোর কাছ থেকে তুরস্ক কোনো শুল্ক আদায় করতে পারে না, যেটিকে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের একাংশ নিজেদের জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের একাংশ মনথ্রো কনভেনশন বাতিল করে দিতে আগ্রহী।
অবশ্য তুরস্ক চাইলেই উক্ত কনভেনশন বাতিল করে দিতে পারবে না, কারণ সেক্ষেত্রে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী বাকি রাষ্ট্রগুলোর সম্মতির প্রয়োজন হবে। এমতাবস্থায় তুরস্ক মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুল খাল খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সামগ্রিকভাবে তুর্কি সরকারের কার্যাবলি থেকে এমন একটি দৃশ্যকল্প উপস্থাপিত হয়েছে যে, ইস্তাম্বুল খালের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ, ইস্তাম্বুল খাল দিয়ে সামরিক ও বেসামরিক জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তুরস্ক। ইতালিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইনস্টিটিউট ফর দি অ্যানালাইসিস অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে’র বিশ্লেষক আলেসান্দ্রা কাসারেজ্জোর ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খাল খননের মধ্য দিয়ে তুরস্ক তুর্কি প্রণালীদ্বয়ে নৌ চলাচল বহুলাংশে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে পারবে এবং এর মধ্য দিয়ে মনথ্রো কনভেনশন কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধ বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে পারবে।
এটাও পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার জন্য একটি দোধারী তলোয়ার (double-edged sword) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হওয়ার পর এটি যদি মনথ্রো কনভেনশনের আওতায় না পড়ে, সেক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য কৃষ্ণসাগরে নিজেদের নৌবহর প্রেরণের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধানিষেধ থাকবে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক (অবশ্য তুর্কি সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে) সেখানে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারবে এবং কৃষ্ণসাগরের সামরিক ভারসাম্যকে নিজেদের অনুকূলে (ও রাশিয়ার প্রতিকূলে) নিয়ে আসতে পারবে। এটি পশ্চিমা বিশ্বের জন্য লাভজনক, কিন্তু রাশিয়ার জন্য ক্ষতিকর।
উল্টো দিক থেকে বিবেচনা করলে, ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হওয়ার পর যদি এটি মনথ্রো কনভেনশনের আওতায় না পড়ে, সেক্ষেত্রে রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে তাদের বাণিজ্যিক ও সামরিক নৌযান প্রেরণের জন্য বসফরাস প্রণালীর পাশাপাশি একটি নতুন জলপথ পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক (অবশ্য তুর্কি সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে) ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারবে এবং ইতিপূর্বে বিশ্বের সাগরগুলোতে সামরিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তাদের জন্য যেসব আইনি ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেগুলো বহুলাংশে দূরীভূত হবে। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে’র ভিজিটিং ফেলো বোরিস টুকার মতে, এতদঞ্চলে রাশিয়ার চূড়ান্ত ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামরিক উপস্থিতি স্থাপন করা এবং এর মধ্য দিয়ে ঈজিয়ান সাগর ও মধ্য ভূমধ্যসাগরে ন্যাটোর উপস্থিতিকে প্রতিহত করা। এটি রাশিয়ার জন্য লাভজনক, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইস্তাম্বুল খাল পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে কাজ করবে না প্রতিকূলে, সেটি নির্ভর করবে তুরস্কের মর্জির ওপরে। যদি পশ্চিমা বিশ্ব ইস্তাম্বুল খালকে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করতে চায় এবং রাশিয়ার ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ রোধ করতে/সীমিত রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। অন্যদিকে, যদি রাশিয়া এতদঞ্চলে পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রতিহত করতে চায় এবং ভূমধ্যসাগরে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, ইস্তাম্বুল খাল খননের পর নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়া উভয়কেই তুরস্কের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াস চালাতে হবে। এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণাধীন তুর্কি সরকারও ঠিক এরকমই চায়।
সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমা ইউরো–আটলান্টিক জোটের সদস্য এবং উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু নানা কারণে পশ্চিমা বিশ্ব ও তুরস্কের মধ্যেকার সম্পর্কে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন, রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক ‘এস–৪০০ ত্রিউম্ফ’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় এবং এর প্রত্যুত্তরে ‘এফ–৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরির প্রকল্প থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তুরস্কের বহিষ্কার ও তুর্কি সামরিক শিল্পের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ভূমধ্যসাগরের জ্বালানি সম্পদ নিয়ে গ্রিস ও ফ্রান্সের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধ, নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্ব ও লিবীয় গৃহযুদ্ধে তুরস্ক ও ফ্রান্সের বিপরীতমুখী অবস্থান, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যেকার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরদোয়ানের সরকারের ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের নিন্দা জ্ঞাপন, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান ও এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী (এবং তুর্কি সরকারি ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী) ফেতুল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় প্রদান, এবং সর্বোপরি, সিরীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ও মার্কিন–সমর্থিত সিরীয় কুর্দিদের বিরুদ্ধে চলমান তুর্কি সামরিক অভিযান– এসব কারণে বর্তমানে তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ নেতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে।
কার্যত তুরস্ক বর্তমানে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিস ও ফ্রান্সের সঙ্গে, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় ফ্রান্সের সঙ্গে এবং সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অঘোষিত ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ লিপ্ত। তুরস্ক একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের মাত্রাকে প্রশমিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, অন্যদিকে তুর্কি সরকার–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম বিগত দশক জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে এবং এর ফলে তুর্কি জনমত ক্রমশ মার্কিনবিরোধী হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে তুর্কি সরকারের পক্ষে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সীমিত পর্যায়ে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
অনুরূপভাবে, সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ারও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বিস্তৃত সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু একইসঙ্গে তাদের মধ্যে বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগর্নো–কারাবাখে তুরস্ক ও রাশিয়া কর্তৃক বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ, ইউক্রেন, দক্ষিণ ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় তুর্কিদের নিজস্ব প্রভাব বিস্তার ও রুশ প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা, রাশিয়ার উত্তর ককেশাস ও বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তুর্কিদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা, রাশিয়ায় ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তিকে স্বীকৃতি প্রদানে তুর্কিদের অনীহা, তুরস্ক কর্তৃক উত্তর ককেশাস থেকে আগত মিলিট্যান্টদের আশ্রয় প্রদান, পূর্ব ইউরোপের রুশবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সুসম্পর্ক, তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের ‘বৃহত্তর তুরান’ প্রকল্প, তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগ রক্ষা, রাশিয়া কর্তৃক সময়ে সময়ে তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রদান এবং বিশ্ব অস্ত্রবাজারে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের প্রতিযোগিতা– এসব কারণে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী সম্পর্কে দ্বান্দ্বিক দিকটি ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে।
কার্যত তুরস্ক বর্তমানে পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় তুরস্কের সঙ্গে একধরনের ‘ছায়াযুদ্ধে’ লিপ্ত। একদিকে তুর্কি সরকার রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বকে সীমাবদ্ধ বা ‘কম্পার্টমেন্টালাইজড’ রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অন্যদিকে তুর্কি প্রচারমাধ্যম খোলাখুলিভাবে রুশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে এবং রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের পাশাপাশি দক্ষিণ রাশিয়ার বিস্তৃত অংশ অধিকার করে নেয়ার কথাও আলোচনা করছে। ঐতিহাসিক রুশ–তুর্কি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে তুর্কি জনমত ব্যাপকভাবে রুশবিরোধী, কিন্তু তুর্কি জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করছে বলে প্রতীয়মান হয়, কারণ সম্প্রতি পরিচালিত একটি জরিপে অংশগ্রহণকারী তুর্কি নাগরিকদের ৭৯% যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছে।
এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে– পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে উভয় পক্ষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুবিধা আদায় করে নেয়া এবং একইসঙ্গে তুরস্ককে একটি একচ্ছত্র আঞ্চলিক শক্তি ও বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্য তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বগুলোকে যতদূর সম্ভব সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী। আর এক্ষেত্রে ইস্তাম্বুল খাল খনন তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করবে। উক্ত খাল খননের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসুক হয়ে উঠবে। রুমানিয়াভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘গিওর্গে ব্রাতিয়ানু ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ জিওপলিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’–এর প্রধান কনস্তান্তিন কর্নেয়ানুর ভাষ্যমতে, আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক খেলাগুলোয় তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এরদোয়ান বরাবর যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন, ইস্তাম্বুল খাল সেই প্রচেষ্টার একটি নতুন হাতিয়ারে পরিণত হবে।