যদিও গত বছরটা আইসোলেশন আর লকডাউনের মধ্যেই কেটে গেছে; তবুও তারকাশোভিত আকাশ আমাদের মুগ্ধ করেছিল অদ্ভুত কিছু দৃষ্টিনন্দন মহাকাশীয় ঘটনার মাধ্যমে। তাই ২০২০ সালের অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ক্যালেন্ডার স্মৃতি আর নতুন আবিষ্কারে পূর্ণ।
বছর ঘুরে নতুন বছর এসেছে। সবকিছু শুরু হয়েছে নব উদ্যমে। আর অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ক্যালেন্ডারও ইতিমধ্যেই সেজে গেছে মহাকাশীয় ঘটনার সূত্র ধরে। ২০২১ সালের মহাকাশে ঘটতে চলেছে আরো দারুণ কিছু ঘটনা। সেসব ঘটনা নিয়েই আজকের আয়োজন।
জানুয়ারি, ২০২১
চতুষ্কোণ উল্কা বৃষ্টি, জানুয়ারির ২-৫ তারিখ
জানুয়ারি ৩ তারিখ পৃথিবীর আকাশে বিরল এক চতুষ্কোণ উল্কা বর্ষণ দেখা গিয়েছে। একে বলা যেতে পারে বার্ষিক উল্কাপিণ্ডের প্রদর্শন; তবে তা খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ছিল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের আকাশে দেখা গিয়েছিল এই উল্কা বৃষ্টি।
তিন গ্রহের সম্মিলিত রূপ, জানুয়ারির ৮-১১ তারিখ
পশ্চিমের আকাশের পরপর তিন দিন দেখা গেছে তিনটি গ্রহের সম্মিলিত ত্রয়ী রূপ। বুধ, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহ তিনটি একদম কাছাকাছি চলে এসেছিল; যেমনটা একটা থোকায় থাকে কয়েকটা ফল বা ফুল সেরকম। শেষবার এমন তিন গ্রহের ত্রয়ী রূপ দেখা গিয়েছিল ২০১৫ সালের অক্টোবরে; যখন শুক্র, বৃহস্পতি এবং মঙ্গল এমন ত্রিভুজকৃতি ধারণ করেছিল। সূর্য ডোবার ৪৫ মিনিট পর উত্তর আমেরিকার আকাশে দেখা গেছে এই তিন গ্রহের সম্মিলিত রূপ।
বুধ গ্রহের প্রতান*, জানুয়ারি ২৪ তারিখ
বুধ গ্রহ এদিন সূর্য থেকে ১৮.৬ ডিগ্রী পূর্ব দৈর্ঘ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন সূর্য ডোবার পর এটি আকাশের সর্বোচ্চ চূড়ায় দৃশ্যমান ছিল। তাই খালি চোখেই বুধগ্রহের পূর্ণ রূপ দেখা গেছে।
ফেব্রুয়ারি, ২০২১
শুক্র ও বৃহস্পতির গ্রহসংযোগ*, ফেব্রুয়ারি ১১ তারিখ
ভোরে ওঠা মানুষজন ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ আমাদের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল দুটি নক্ষত্র খালি চোখেই দেখতে পান। তবে টেলিস্কোপ থাকলে স্পষ্টই দেখা গিয়েছে গ্রহ দুটিকে। আর অতিরিক্ত পাওয়া হিসেবে, এই গ্রহসংযোগের ঠিক ডানদিকে উপরেই দেখা গিয়েছে শনি গ্রহ।
মার্চ, ২০২১
বৃহস্পতি ও বুধের মিলন, মার্চের ৫ তারিখ
ভোরের আকাশের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বুধ আর বৃহস্পতি গ্রহ দুটিকে খুব কমই দেখা গেছে। তবে মার্চ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতি ও বুঝের গ্রহসংযোগ হয়। সংযোগের সময় গ্রহ দুটির মধ্যে কেবল ০.৩৫ ডিগ্রীর পার্থক্য থাকে। আবার বুধ গ্রহও উজ্জ্বল বৃহস্পতির ঠিক উপরে বামে অবস্থান করে। সূর্যোদয়ের প্রায় আধা ঘণ্টা পুর্বে দুরবীনের সাহায্যে গ্রহ দুটির মিলন দেখা গিয়েছিল আকাশে।
গ্রহের চতুষ্কোণ গঠন আকৃতি, মার্চের মার্চের ৯-১০ তারিখ
মার্চ মাসের ৯-১০ তারিখ দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্তে এক মহাজাগতিক ভিড় দেখা যায় যখন চারটি গ্রহ কাছাকাছি চলে আসে। বুধ, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহ তিনটি সর্বোচ্চ কাছাকাছি অবস্থানে অবস্থা করে এবং অর্ধচন্দ্রাকৃতির চাঁদ এই ত্রয়ীর পাশেই নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল।
এপ্রিল, ২০২১
লিরিডস উল্কা বর্ষণ, এপ্রিলের ২১-২৩ তারিখ
আমেরিকান মিটিওর সোসাইটি থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালের এপ্রিলের ১৬-৩০ তারিখ অবধি লিরিডস উল্কাবর্ষণ হবে অবিরাম; যা উত্তর গোলার্ধ থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হবে। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, ২১-২৩ এপ্রিল ৬৮ শতাংশ চাঁদের আলোয় এই উল্কা বর্ষণ আরো বেশি স্পষ্ট দেখা যাবে। আর চাঁদ ডুবে যাবার ঘন্টাখানেক আগে প্রবল উল্কা বর্ষণ দেখা যাবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
মে, ২০২১
ব্লাডমুন বা পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ, ২৬ মে
মে মাসের ২৬ তারিখ উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমাংশ, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা থেকে রক্তিম চাঁদ বা ব্লাডমুন দেখা যাবে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণকেই ব্লাডমুন বলা হয়ে থাকে, কেননা এই সময়ে চাঁদ লালচে আভায় ছেয়ে থাকে। যখন পৃথিবী এবং সূর্য চাঁদের গতিপথের মাঝে চলে আসে তখনই মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানের এমন নাটকীয় ঘটনা ঘটে থাকে।
জুন, ২০২১
রিং অফ ফায়ার বা বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ, ১০ জুন
জুনের ১০ তারিখ, সূর্য ওঠার সাথে সাথেই রাশিয়া, কানাডা এবং গ্রীনল্যান্ডের কিছু অংশ সরাসরিই আকাশে রিং অফ ফায়ার বা আগুনের আংটা কিংবা বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। এই চমকপ্রদ ঘটনা তখনই ঘটে যখন চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী এমনভাবে সংযুক্ত হয় যেখানে চাঁদের ছায়া সূর্যকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করতে পারে না। ফলে সূর্যের আলো চাঁদের ছায়াকে ঘিরে আলোর আংটির মতো রিং তৈরি করে। আন্তর্জাতিক সময়ানুযায়ী বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটবে ৯:৪৯ মিনিটে এবং শেষ হবে ১১:৩৩ মিনিটে।
জুলাই, ২০২১
শুক্র ও মঙ্গলের গ্রহসংযোগ, ১২ জুলাই
২০২০ সালের ডিসেম্বরে সংঘটিত বৃহস্পতি আর শনির গ্রহসংযোগের মতোই জুলাইয়ের ১২ তারিখ শুক্র আর মঙ্গলের গ্রহসংযোগ হবে। এই সময় এই দুটো গ্রহ এতটাই কাছাকাছি চলে আসবে যে সাধারণ দূরবীন দিয়েই তা দৃষ্টিগোচর করা যাবে।
আগস্ট, ২০২১
শনির প্রতিযোগ, ১২ আগস্ট
যখন কোনো গ্রহের প্রতিযোগ হয় তখন পৃথিবী এবং সূর্যের সাথে এটি একটি সরলরেখা তৈরি করে, আর পৃথিবী তখন থাকে তিনটির কেন্দ্রে। লন্ডনের রয়্যাল অবজারভেটরি অনুসারে, এরকম প্রতিযোগ দূরবর্তী গ্রহ, যেমন – বৃহস্পতি, ইউরেনাস এবং নেপচুনকে দেখার সুযোগ করে দেয়। কেননা, প্রতিযোগের সময়ে এই গ্রহগুলো উজ্জ্বল হয় এবং আকাশের উঁচুতে দ্বীপ্তিমান থাকে। আর আগস্টের ২ তারিখ শনির প্রতিযোগের কারণে ব্যাপারটি আবার ঘটতে চলেছে।
পারসেইড উল্কাবর্ষণ, ১১-১২ আগস্ট
গ্রীষ্মের উষ্ণ তাপমাত্রা এবং একফালি মোমের মতো চাঁদের কারণে আশা করা যায় যে, পারসেইড উল্কাবর্ষণ পরিস্থিতি তৈরি হবে এই বছরের আগস্ট মাসে। পারসেইড হচ্ছে আলো আর রঙের বিস্ফোরণ যা মূলত ধূমকেতুর ধ্বংসাবশেষ থেকে সৃষ্টি হয়। প্রতি বছর সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খাবার সময় ধুমকেতু ১০৯পি/সুইফট-টাটল এই ধ্বংসাবশেষগুলো পেছনে ছেড়ে যায় যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে মেশে। এগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষ করে তখন রাতের আকাশে জ্বলন্ত রেখা দৃশ্যমান হয়। আগস্টের ১১-১২ তারিখ প্রতি ঘণ্টায় ৮৩টি উল্কা দেখা যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেপ্টেম্বর, ২০২১
নেপচুনের প্রতিযোগ, ১৪ সেপ্টেম্বর
বরফ জায়ান্ট, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুন, এমন একটি গ্রহ যা খালি চোখে কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই শক্তিশালী টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এমন দূরবর্তী একটি গ্রহ খালি চোখে দেখা সৌভাগ্যই বলা চলে। আর সেই সুযোগটি আসছে সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখে।
অক্টোবর, ২০২১
ড্রাকোনিড উল্কাবর্ষণ, ৮ অক্টোবর ৮
ড্রাকো – দ্য ড্রাগন নক্ষত্রমণ্ডলী থেকেই মূলত ড্রাকোনিড নামকরণ হয়েছে। ড্রাকোনিড সাধারণত সন্ধ্যা নামার পর থেকে মধ্যরাতের সময়কালেই বেশি দেখা যায়। অক্টোবরের ৮ তারিখ উত্তর গোলার্ধের স্থানীয় মধ্যরাতে ড্রাকোনিড উল্কাবর্ষণ দেখা যাবে আকাশজুড়ে।
নভেম্বর, ২০২১
আংশিক চন্দ্রগ্রহণ, ১৯ নভেম্বর
বছরের দ্বিতীয় চন্দ্রগ্রহণে পৃথিবী চাঁদের পৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারবে না। খানিকটা অংশ বাকি থাকবে বলেই আশা করছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। নভেম্বরের ১৯ তারিখ এই চন্দ্রগ্রহণ শুরু হয়ে যাবে। আর ঠিক ২টা বেজে ১৮ মিনিটের সময়ে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরিতল অতিক্রম করবে। পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদের পৃষ্ঠের প্রায় ৯৫ ভাগ ঢেকে যাবে এই চন্দ্রগ্রহণে।
ডিসেম্বর, ২০২১
পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, ৪ ডিসেম্বর
বছরের একদম শেষভাগে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। এটি দেখা যাবে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে। তবে এই সূর্যগ্রহণেরই আংশিক রূপ দেখা যাবে চিলি, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে।
টীকা:
* কোনো গ্রহ এবং সূর্যের মধ্যবর্তী কৌণিক দূরত্বকে প্রতান (Elongation) বলা হয়। অপর নাম দ্রাঘন।
* প্রতান ০ ডিগ্রী হলে সে অবস্থানকে গ্রহসংযোগ (Conjunction) বলে।
* প্রতান ১৮০ ডিগ্রী হলে সে অবস্থানকে প্রতিযোগ (Opposition) বলে।
* প্রতান ০ ডিগ্রী হলে সে অবস্থানকে পাদসংস্থান (Quadrature) বলে।