Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কীভাবে দিল্লি পরিণত হলো গ্যাস চেম্বারে?

গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ভেন্যু ছিল দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম। সেই ম্যাচে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ৭ উইকেটের দাপুটে জয়ের মাধ্যমে সিরিজে দারুণ সূচনা করেছে টাইগাররা। সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু একপর্যায়ে ম্যাচটি মাঠে গড়ানো নিয়েই জেগেছিল শঙ্কা। কারণ- দিল্লির বায়ুদূষণ।

ঠিক কতটা অসহনীয় ও লাগামছাড়া দিল্লির এই বায়ুদূষণ, তা বোঝা যাবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একটি কথায়। তিনি বলেছেন,

দিল্লি পরিণত হয়েছে একটি গ্যাস চেম্বারে।

কেন এত শোরগোল?

দিল্লির বায়ুদূষণ অবশ্যই নতুন কোনো খবর নয়। এমনকি একে ‘গ্যাস চেম্বার’ হিসেবে আখ্যায়িত করাকেও অনেকের কাছেই অতি স্বাভাবিক একটি বিষয় বলে মনে হতে পারে। কেননা গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নয়া দিল্লি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। এছাড়া এই দুটি সংস্থার মতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহরের সাতটিও অবস্থিত ভারতে।

তারপরও দিল্লির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী শোরগোল চলছে, কারণ তা সাম্প্রতিক অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এ দিল্লির বায়ুতে দূষণের পরিমাণ এখন ৫০০-র বেশি, অর্থাৎ দিল্লির অবস্থা “severe-plus emergency” ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত।

ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দিল্লি; Image Source: Hindustan Times

অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, ভার‍তের রাজধানী জুড়ে গণস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তীব্র বায়ুদূষণের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে শহরের প্রায় ২ কোটি বাসিন্দার জীবন।

দেশের অন্যান্য স্থান এবং বিদেশের সাথে যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে এই বায়ুদূষণের কারণে। গত ৩ নভেম্বর শহরের আকাশে ধুলো ও ধোঁয়ার এত বেশি পরিমাণ আস্তরণ ছিল যে, রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিলম্বিত কিংবা অপসারিত হয়েছিল মোট ৩৭টি ফ্লাইট!

প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপ

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সকল স্কুল বন্ধ রাখা, পাশাপাশি যেকোনো নির্মাণকাজ নিষিদ্ধেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রণীত হয়েছে ‘জোড়-বিজোড়’ নীতিও, অর্থাৎ জোড় সংখ্যার তারিখগুলোতে রাস্তায় কেবল জোড় অঙ্ক দিয়ে শেষ হওয়া নিবন্ধন নম্বরের যানবাহন রাস্তায় চলাচল করতে পারবে, এবং বিজোড় সংখ্যার তারিখগুলোতে শুধু বিজোড় অঙ্ক দিয়ে শেষ হওয়া যানবাহন।

এছাড়া দিল্লি সরকার গত ১ নভেম্বর থেকে রাজ্যব্যাপী মাস্কও বিতরণ করছে। এ প্রসঙ্গে কেজরিওয়াল বলেছিলেন,

আমাদের জন্য এই বিষাক্ত বাতাস থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলোর মাধ্যমে আমরা ৫০ লক্ষ মাস্ক বিতরণ শুরু করেছি। আমি দিল্লিবাসীকে আহ্বান জানাব যখনই দরকার হয় তারা যেন এই মাস্কগুলো ব্যবহার করেন।

তীব্র স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দিল্লিবাসী; Image Source: India TV

সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য

দিল্লি সরকার এ ধরনের অভিনব বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বায়ুদূষণের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছে বটে, এবং জনগণের সহানুভূতি আদায়েরও চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টায় মন গলছে না অনেকেরই। তাদের মধ্যে রয়েছে স্বয়ং ভারতের সুপ্রিম কোর্টও। দিল্লি সরকারের এসব কর্মকাণ্ডকে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ‘প্রতারণাপূর্ণ কৌশল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশা বলেছেন,

দিল্লি প্রতিবছরই দূষিত বায়ুতে বিষম খাচ্ছে, কিন্তু আমরা (এটি ঠেকাতে) কিছুই করতে পারছি না। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত, তারাও যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা কেবল একজন আরেকজনের ওপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। সকলে শুধু ছলচাতুরি আর নির্বাচনের ব্যাপারেই আগ্রহী। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে কারো কোনো হেলদোল নেই।

কেন হচ্ছে এমন বায়ুদূষণ?

প্রতিবছরই অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এমন ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার হয় ভারতের রাজধানী। এর পেছনে একটি বড় কারণ পার্শ্ববর্তী রাজ্যের কৃষকদের জমি পরিষ্কারের লক্ষ্যে ফসলের উচ্ছিষ্ট পোড়ানো।

পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোয় ফসলের উচ্ছিষ্ট পোড়ানো দিল্লির বায়ু দূষণের প্রধান কারণ; Image Source: Bilal Kuchay/Al Jazeera

প্রচুর পরিমাণে ফসলের উচ্ছিষ্ট পোড়ানোর কারণে বাতাসে যুক্ত হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য বস্তুকণার এক ভয়াবহ মিশ্রণ। সেটি আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে দীপাবলি উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে প্রচুর পরিমাণে বাজি পোড়ানোর ফলে। এছাড়া যানবাহন, কলকারখানা ও নির্মাণাধীন অবকাঠামোর কালো ধোঁয়াও বড় ভূমিকা রাখে বায়ুকে আরো বেশি বিষাক্ত করে তুলতে।

কী হতে পারে এর ফলাফল?

বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে বাঁচার একমাত্র কার্যকর উপায় হলো ঘরের বাইরে না যাওয়া। কারণ ঘরের বাইরে গেলেই দূষিত বায়ুর করাল গ্রাসের শিকার হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হচ্ছে যেসব পেপার মাস্ক, সেগুলো দিয়ে দূষিত বায়ুর তীব্রতা খুব কমই ঠেকানো যায়। তাছাড়া কিছু মাস্ক তো আছে এতই দুর্বল যে, সেগুলো পরার পরও বাতাসের কটু গন্ধ ঠিকই নাকে আসে।

কিন্তু এখন কথা হলো, একজন মানুষের পক্ষে তো আর সারাদিন ঘরে বসে থাকা সম্ভব না। তাদেরকে ঘরের বাইরে বেরোতেই হবে, আর তখনই দূষিত বায়ু তাদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। এবং সেই ঝুঁকির পরিমাণও নেহাত কম নয়।

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অভ শিকাগো থেকে এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে:

বায়ুদূষণের ফলে ইন্দো-গঙ্গা সমতল, অর্থাৎ পাঞ্জাব, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল সাত বছর পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ওপর করা গবেষণা থেকে আরো উঠে এসেছে যে, উত্তর ভারতের বায়ুদূষণ দেশের বাকি অংশের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভয়ঙ্কর

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

একটু আগে যানবাহনের যে ‘জোড়-বিজোড়’ নীতির কথা বললাম, ২০১৬ সাল থেকেই সেটি চলে আসছে। বায়ুদূষণের পেছনে রাস্তায় অত্যধিক যানবাহন একটি বড় কারণ বটে, কিন্তু দিল্লি ও ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন (এনসিআর)-এর বিশেষজ্ঞরা বলছেন বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধানে এই প্রকল্প যথেষ্ট নয়।

নয়া দিল্লিতে অবস্থিত সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান অনুমিতা রায়চৌধুরী বলছেন, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, তাতে বছরব্যাপী বায়ুদূষণের গড় পরিমাণই কেবল কমেছে, কিন্তু তারপরও বছরের এই বিশেষ সময়গুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা এখনো খুবই বেশি।

পরিচ্ছন্ন বায়ুর স্ট্যান্ডার্ড লাভ করতে আমাদেরকে বর্তমান দূষণের আরো ৬৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে, যা একটি ব্যাপক লক্ষ্যমাত্রা। শিল্প, যানবাহন, বিদ্যুৎক্ষেত্রসহ সবখানে আমাদের প্রযুক্তি ও জ্বালানীর বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।

বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের চিত্র

শুধু দিল্লি কিংবা ভারতই নয়, পুরো পৃথিবীই এখন বায়ু দূষণের হুমকির সম্মুখীন। এ বছরের মার্চে এয়ার ভিজুয়ালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, পরবর্তী এক বছরের গোটা বিশ্বে ৭০ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হবে এই বায়ু দূষণ। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর থাকবে বিশাল প্রভাব।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল,

“মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি বায়ু দূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী ২২৫ বিলিয়ন ডলার শ্রমের অপচয় হবে, এবং কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে চিকিৎসা খাতেও। অর্থাৎ বায়ু দূষণ আমাদের স্বাস্থ্য ও ওয়ালেট দুইয়ের উপরই থাবা বসাবে।”

এই সমস্যা বিশেষত দেখা যাবে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ২০টি শহরের মধ্যে ১৮টিই রয়েছে শুধু ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে এই তিন দেশের যে শহরগুলোতে, অর্থাৎ দিল্লি, লাহোর ও ঢাকাও রয়েছে এই তালিকায়।

বায়ুদূষণে বাংলাদেশ

বায়ুদূষণ আমাদের বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চিন্তার নাম। স্টেট অভ গ্লোবাল এয়ার তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, কেননা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কোনো দূষিত এলাকায় বাস করে।

শুধু বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মৃত্যু ঘটছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের। বায়ুদূষণের শিকার হয়ে যে দশটি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এছাড়াও শীর্ষ দশে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো।

বায়ু দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে বেইজিং; Image Source: Imaginechina/Corbis

দৃষ্টান্ত হতে পারে চীন

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার প্রধানেরা অজুহাত দাঁড় করাতে পারেন যে, এসব দেশে যেহেতু জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেশি, তাই বায়ুদূষণ রোধ করাও অসম্ভব। কিন্তু আসলেই কি বিষয়টি সেরকম? মোটেই না। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে চীনকে।

একসময় বিশ্বব্যাপী শহুরে বায়ুদূষণের ‘পোস্টার বয়’ ছিল চীন। অথচ সেই দেশটিই সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণ রোধে দারুণ সফলতা পেয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যেই চীনের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে পুরো ১২ শতাংশ। ফলে দেশটির রাজধানী বেইজিং-ও বেরিয়ে গিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০০ শহরের তালিকা থেকে।

চীনের পক্ষে বিপুল জনসংখ্যা এবং অগণিত কলকারখানা, যানবাহন ও অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বায়ু দূষণের রাশ টেনে ধারা সম্ভব হয়েছে তাদের সঠিক ও বাস্তবসম্মত জাতীয় নীতি এবং সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার ফলে। তারা যদি পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে, তাহলে আমরাই বা পিছিয়ে থাকবো কেন?

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিশ্ব’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about the present air pollution crisis in New Delhi, the capital of India. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Press Trust of India

Related Articles