(পর্ব ১ এর পর থেকে)
৩
কুয়ালালামপুরের বিমানবন্দরে কিম জং ন্যাম মারা যাওয়ার সময় তার কূটনৈতিক পাসপোর্টের নাম ছিল কিম চোল। শুরুতে বলা হয়েছিল তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ নার্ভ এজেন্টের কোনো সূত্র ধরতে পারেনি। তারা যে একজন ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিয়ে কাজ করছে, সেটা সম্পর্কেও ধারণা ছিল না। কর্তৃপক্ষকে চমকে দেয় তার ব্যাকপ্যাকে পাওয়া ১,২০,০০০ মার্কিন ডলারের ক্যাশ। বিশেষজ্ঞরা পরবর্তীতে ধারণা করেন এগুলো তিনি পেয়েছেন এক সিআইএ এজেন্টের সাথে দুই ঘণ্টার আলোচনা করার পর। সম্ভবত সেটা ছিল উত্তর কোরিয়া রেজিমের কোনো তথ্যের বিনিময়ে দেওয়া।
পরের দিন দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থাগুলো প্রচার করতে থাকে, কিম জং ন্যাম খুন হয়েছেন। রয়টার্স জানায়, মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হয়ে উত্তর কোরিয়ার জায়গায় দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ এই ভুলের ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও কিম জং ন্যামের পরিচয় প্রথমে সিউল থেকে প্রচার হওয়ার ব্যাপারটা এই ভুলকেই নির্দেশ করে। এক জাপানি সংবাদমাধ্যমে যখন বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস হয়ে যায়, তখন এই সংবাদ বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়। প্রভাবশালী গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে প্রচার হতে থাকে। ওই দুই নারীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু পরের দিন সকালে পর্যবেক্ষকরা জানতে পারেন, ওই দুই নারী একা কাজ করেননি। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, অন্তত চার জন লোক এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। দুই দিন পর পুলিশের সন্দেহভাজনের তালিকায় সাত উত্তর কোরীয় নাগরিকের নাম চলে আসে। ইতোমধ্যে রসায়নে পিএইচডি করা এক উত্তর কোরীয়কে গ্রপ্তার করা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর মধ্যরাতের একটু আগে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত জং ন্যামের মৃতদেহ রাখা মর্গের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি প্রতিবাদ করে বলেন, ‘কিম চোল’ উত্তর কোরিয়ার নাগরিক। তিনি মালয়েশিয়াকে দায়ী করে বলেন, তারা উত্তর কোরিয়ার ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে। সম্ভবত এতে দক্ষিণ কোরিয়ার হাতও আছে। তিনি মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিও জানান।
পুলিশ জানায়, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ উত্তর কোরিয়ার কাছে মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে মর্গে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা হয়। পিয়ংইয়ং ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট ব্যবহারের দায়ও উড়িয়ে দেয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘চোল’ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। নার্ভ এজেন্ট নিয়ে সন্দেহ পোষণকারী অন্যরা বলেন, যদি এটা ব্যবহার করা হতো, তাহলে ওই দুই নারীও বিষ প্রয়োগের শিকার হতেন।
এই কূটনৈতিক স্থবিরতার কারণে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। মালয়েশিয়া সরকার উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। অন্যদিকে পিয়ংইয়ং মালয়েশিয়ান নাগরিকদের উত্তর কোরিয়া ত্যাগের অনুমতি আটকে দেয়। অনেকটা তাদেরকে জিম্মি হিসেবেই আটকে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা ভেস্তে যায়। উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী চীন দেশটি থেকে কয়লা আমদানি করা বন্ধ করে দেয়, যা ছিল উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।
দেড় মাস পর মালয়েশিয়া তার নাগরিকদের মুক্ত করার জন্য হঠাৎ করেই মৃতদেহ হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয় এবং দূতাবাসে লুকিয়ে থাকা তিন উত্তর কোরীয় আসামিকে দেশে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দেয়। তখন বাকি থাকে বিচারের অপেক্ষায় থাকায় জেলবন্দী দুই নারী, মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী যারা খুন করে থাকলে ফাঁসি হওয়ার কথা।
কিন্তু ওই দুই নারীর পরিচয় আর উদ্দেশ্য তখনো রহস্যজনক ছিল। একজনের ব্যাপারে বলা হয়েছিল তিনি ইন্দোনেশিয়ার এক পতিতা, এবং অন্যজন ভিয়েতনামের এক নারী। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের দুই তরুণী কীভাবে একটা আন্তর্জাতিক হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়লেন? তাদেরকে কেন কিম জং ন্যামকে এমন ভয়ঙ্করভাবে হত্যায় জড়ানো হলো?
উত্তরগুলো উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দ্বারা সবার চোখের সামনেই লুকানো ছিল। তাদের পরিচয় উন্মোচনকে সাজানো হয় বিশ্ব ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য।
৪
সিসিটিভি ফুটেজ থেকে সহজেই নারী ঘাতকদের পরিচয় বের করে ফেলা হয়। ভিয়েতনামির সাদা সোয়েটারে ইংরেজি হরফে এলওএল লেখা থাকায় ঘোলা ফুটেজে তাকে শনাক্ত করা সহজ গিয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয় খুব সহজে। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন তিনি যখন আবার বিমানবন্দরে ফিরে আসেন, তখনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৯ বছর বয়সী ডোয়ান থি হুয়োং ভিয়েতনামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্বপ্ন ছিল তারকা হওয়ার। কিন্তু ভিয়েতনাম আইডলে ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই বাদ পড়ে গেলে তার স্বপ্ন সেখানেই শেষ হয়ে যায়। এরপর হ্যানয়ে মডেল হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। সেখান থেকেই এক উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচর তাকে নিয়োগ দেন।
হত্যাকাণ্ডের পর রাত ২টায় মালয়েশিয়া পুলিশ সদস্যরা কুয়ালালামপুরের ফ্ল্যামিঙ্গো হোটেলের স্যাঁতস্যাঁতে হলওয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। চতুর্থ তলার এক কক্ষে আরেক সন্দেহভাজন খুনি ২৫ বছর বয়সী ইন্দোনেশিয়ান তরুণী সিতি আয়েশা কেবল এক মালয়েশিয়ান লোককে মনোরঞ্জন করা শেষ করেছিলেন। পুলিশ সদস্যরা তালা না দেওয়া দরজা দিয়ে কক্ষে ঢুকে পড়লে ওই লোক বের হয়ে যান।
সিসিটিভি ফুটেজে পরিষ্কারভাবে ডোয়ান ও সিতির অপরাধ দেখা গেলেও তাদের জেরা করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে অন্য তথ্য। তারা দুজনই আলাদাভাবে জবানবন্দি দেন, তারা মনে করেছিলেন একটা লুকানো ক্যামেরার টিভি শোয়ের জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন কোনো তরল পদার্থ কিম জং ন্যামের ওপর নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের এই দাবি উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, এই দুই সন্দেহভাজন মহিলা জানতেন ওই তরলটা বিষাক্ত ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, কিম জং ন্যামের মুখে তরলটি লাগিয়েই তারা শৌচাগারের দিকে দৌড়ে যান তাদের হাত থেকে বিষ মুছে ফেলতে।
কিন্তু নিজেদের নির্দোষ দাবি করতে ওই দুই তরুণী নাছোড়বান্দা ছিলেন। তারা কাউকে খুন করা দূরের কথা, কোনো প্রকার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যই ছিল না তাদের।
সিতিকে উত্তর কোরীয়রা ৫ জানুয়ারি ২০১৭ রাত তিনটায় কুয়ালালামপুরের এক কুখ্যাত বারের বাইরে থেকে নিয়োগ দেয়। কাগজে কলমে তিনি ফ্ল্যামিঙ্গো হোটেলের স্পাতে মালিশের কাজ করতেন। তবে পর্দার আড়ালে তিনি পতিতা হিসেবেই কাজ করতেন।
কোনো কোনো সন্ধ্যায় সিতি স্পায়ের কাজ শেষে সেজেগুজে বের হয়ে যেতেন। তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকা বিচ ক্লাবে যেতেন। সেখানে একটা ক্যাফের সামনে ছোট ছোট জামা পরা ধূমপানরত ইন্দোনেশিয়ান ও ভিয়েতনামি নারীদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতেন আর ফোনে সময় দেখতেন। রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ক্লাবের মিউজিক বেজে উঠত, ফগ মেশিন চালু করা হতো আর সেখানে কাজ করা নারীরা এক এক করে চলে আসতেন। তারপর সেখানে আসা আমেরিকান ও জাপানি পুরুষদের মনোরঞ্জন করতেন।
ওই জায়গা ভালোই জনপ্রিয় ছিল। সেখানে কাজ করা কর্মীরা বলেন, কিম জং ন্যাম মাঝেমাঝেই আসতেন। সিতিও সেখানে কাজ করতেন নিয়মিত।
এক রাতে সিতি বিচ ক্লাবের বাউন্সারকে অতিক্রম করে রাস্তায় একাই বের হয়ে চলে আসেন। ওই সন্ধ্যাটা সফল ছিল না। কিন্তু তখন রাস্তায় থাকা ট্যাক্সির সারি থেকে ‘জন’ নামে তার পূর্বপরিচিত এক ট্যাক্সিচালক তাকে ডাক দেন। এক লোক তার কাছে কিছু মেয়ের খোঁজ এনে দিতে বলে, যারা অপরিচিত লোকদের মুখে লোশন মাখিয়ে দেবে আর ওই লোক সেটা চিত্রধারণ করবে।
এ রকম অনুরোধ তাদের কাছে খুব একটা উদ্ভট মনে হয়নি। গাড়ি চালকরা পর্যটক ও পতিতাদের মাঝে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে আসে। জন ও সিতির আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বি, যিনি বিচ ক্লাবেও কাজ করতেন, তিনি বলেন, তারা মনে করেছিলেন জনের খদ্দের কোনো পর্ন ছবি বানাতে চাচ্ছেন।
সিতির মনে যদি কোনো দ্বিধা থেকে থাকত, সেটা ১০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি পরিমাণ প্রস্তাবিত পারিশ্রমিকের কথা শুনে চলে যায়। তার স্পায়ের কাজে প্রতি খদ্দেরের ক্ষেত্রে মাত্র ১৫ মার্কিন ডলার করে নিজের শেয়ার পেতেন, বাকি অংশ তার উর্ধ্বতনরা নিয়ে যেতেন। তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন, কারণ এতে তার তিন গুণ আয় হতো। এটা দিয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় থাকা দরিদ্র বাবা-মা ও ছেলের ভরণপোষণ করতে পারতেন। তার স্বপ্ন ছিল নিজের গ্রামে একটা বাড়ি বানানো, আর সেখানে তার পরিবার নিয়ে থাকা।
সাত ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই জন সিতিকে ট্যাক্সিতে করে নিতে আসেন। সিতি একটা আঁটসাঁট জিন্স আর তার একটা প্রিয় লাল গলবদ্ধ সোয়েটার পরে আসেন। হাসি দিলে তার দাঁতের ব্রেসগুলো বের হয়ে আসে। তাকে ২৪ বছরের চেয়েও কম বয়স্ক মনে হচ্ছিল।
ব্যয়বহুল প্যাভিলিয়ন মলের এক দোকানে নিয়ে জন তাকে জেমস নামের এক সুদর্শন ৩০ বছর বয়সী ‘জাপানি’ লোকের সাথে পরিচয় করে দেন। সিতি তাকে নিদাইয়া নামে পরিচয় দেন। ইন্দোনেশিয়ায় তিনি প্রায়ই এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। (এমনকি বি এর মতো কাছের বন্ধুরাও টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার আগে সিতির প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না)। জেমস ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার ভাষায় কথা বলতে না পারায় তারা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলেন। মাঝে মাঝে গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করেন। জেমস তাকে ব্যাখ্যা করেন, তিনি একটা গোপন ক্যামেরার কমেডি শো প্রযোজনা করতে চাচ্ছেন, যেটা চীন ও জাপানে ইউটিউবে আপলোড করা হবে।
জেমস তখন সিতিকে একটা বাচ্চাদের তেল জাতীয় জিনিস দিয়ে এক ভিয়েতনামি মহিলার মুখে লাগিয়ে দিয়ে আসতে বলেন, আর তিনি স্মার্টফোনে সেটা ভিডিও করেন। এতে তেমন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি, কারণ সবকিছুই জনসম্মুখে পরিচালনা করা হয়েছে। জেমস সিতিকে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও জোর করেন।
ওইদিন সকালে তারা আরেকটি অভিজাত শপিং মলে যান। সিতিকে আবারো পারিশ্রমিক দেন জেমস। জেমস যখন তাকে বললেন, পরের দিন বিমানবন্দরে একটা ভিডিও শ্যুট করবেন, সিতি সানন্দেই রাজি হয়ে যান। তিনি একদিনে যা আয় করেন, কয়েক মিনিটে তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করে ফেলছিলেন। তাছাড়া তার সবসময়ের স্বপ্ন ছিল অভিনেত্রী হওয়ার।
জন শুধুমাত্র একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করেন, জেমস যখনই তাকে ফোন দেন, প্রতি বারই ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন করেন। কিন্তু বি মনে করেন, জন হয়তো তার দালালির আয় করার সুযোগ হারাতে চাচ্ছিলেন না। আর রাস্তাঘাটে এমন কাজ করায় ছোটখাট গোপনীয়তা রাখা অস্বাভাবিক কিছুও ছিল না।
জন আশা করছিলেন, তার দালালির কাজটা করে যেতে পারবেন। কিন্তু সিতি তাকে বলেন, তিনি আর জেমসের সাথে দেখা করবেন না। বি মনে করেন, সিতি সম্ভবত জনকে তার ভাগের অর্থ দিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু আসলে প্ররের চার দিন জেমসের সাথে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সিতি এটাকে মনে করেছিলেন এটা তাকে তারকা হতে সাহায্য করবে।
(এরপর ৩য় পর্বে)