সিরীয় গৃহযুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ এখন পর্যন্ত চলমান, এবং সহসা এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই যুদ্ধটিকে ‘গৃহযুদ্ধ’ বলা হয়, কিন্তু যুদ্ধের প্রথম থেকে এই যুদ্ধটি আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। হাজার হাজার বিদেশি যোদ্ধা এই যুদ্ধে বিভিন্ন পক্ষে লড়াই করেছে এবং এখনো করছে। এদের মধ্যে বিদেশি সৈন্য, সামরিক পুলিশ, স্পেশাল ফোর্স সদস্য ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিদেশি মিলিট্যান্ট, মার্সেনারি এবং মিলিশিয়া সদস্য। এমনই একটি মিলিশিয়া হচ্ছে ‘লিওয়া আজ–জায়নাবিউন’ বা ‘লিওয়া জাইনাবিউন’, যেটি গঠিত হয়েছে পাকিস্তানি শিয়া যোদ্ধাদের নিয়ে।
লিওয়া আজ–জায়নাবিউন সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরীয় সরকারের পক্ষে। সিরীয় গৃহযুদ্ধের প্রথম থেকেই যুদ্ধটি একটি সাম্প্রদায়িক রূপ ধারণ করেছে, যেখানে সিরীয় শিয়া ও আলাউয়িরা মূলত সিরীয় সরকারের সমর্থক এবং সিরীয় সুন্নিরা মূলত বিভিন্ন সিরীয় বিদ্রোহী গ্রুপের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অবশ্য সিরীয় যুদ্ধের বাস্তবতা মোটেই এতটা সরল নয়। সিরীয় রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদ এবং তার শীর্ষ সহযোগীদের অনেকেই আলাউয়ি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং সিরীয় শিয়ারা প্রধানত সিরীয় সরকারের সমর্থক। কিন্তু অন্যদিকে আবার বাশার আল–আসাদের স্ত্রী আসমা আল–আসাদ স্বয়ং সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং সিরীয় সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর বড় একটি অংশ সুন্নি। একইভাবে, সিরীয় বিদ্রোহী দলগুলোর সমর্থকদের সিংহভাগই সুন্নি, কিন্তু এমনকি কিছু আলাউয়ি ধর্মীয় নেতাও সিরীয় সরকারের বিরোধিতা করেছে।
অবশ্য সিরীয় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেরকমই হোক না কেন, বহির্বিশ্বে সিরীয় যুদ্ধ বৃহত্তর শিয়া–সুন্নি দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করেছে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সুন্নি–অধ্যুষিত সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক সিরীয় বিদ্রোহীদের সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে আসছিল এবং এখন পর্যন্ত তুরস্ক সিরীয় বিদ্রোহীদের সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে চলেছে। অন্যদিকে, শিয়া–অধ্যুষিত ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সিরীয় সরকারকে সহায়তা করছে। ইরানি সৈন্যরা (বিশেষত ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র সদস্যরা) সরাসরি সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে এবং ইরানিদের তত্ত্বাবধানে ইরাকি, লেবানিজ ও আফগান শিয়া যোদ্ধারা সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অনুরূপভাবে, ইরানিদের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানি শিয়াদের একটি দল সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে এবং দলটি ‘লিওয়া আজ–জায়নাবিউন’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছে।
সিরীয় গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায় থেকেই সিরীয় সরকারি বাহিনী জনবল সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। হাজার হাজার সিরীয় সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয় অথবা দলত্যাগ করে বিদ্রোহীদের বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগদান করে। এই জনবলের ঘাটতি মোকাবিলা করার জন্য সিরীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান বিভিন্ন রাষ্ট্র (ইরাক, লেবানন, আফগানিস্তান প্রভৃতি) থেকে শিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের সিরিয়ায় প্রেরণ করতে শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাসকারী শিয়াদের মধ্যে এ রকম একটি অংশ রয়েছে, যারা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে আগ্রহী। ইরানিরা তাদের এই মনোভাবকে কাজে লাগায় এবং সিরীয় যুদ্ধের জন্য তাদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে শুরু করে। অন্যান্য শিয়া–অধ্যুষিত অঞ্চলের মতো পাকিস্তান থেকেও ইরানিদের আহ্বানে সাড়া আসে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানি সরকার প্রথম থেকে সিরীয় গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানের জনসংখ্যার সিংহভাগ সুন্নি ইসলামের বিভিন্ন ধারার অনুসারী (দেওবন্দি, বারলেভি, সুফি, সালাফি/ওয়াহাবি)। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ২০–২৫ শতাংশ শিয়া ইসলামের অনুসারী। সেদিক থেকে পাকিস্তানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস। শিয়ারা প্রধানত পাকিস্তানের গিলগিট–বালতিস্তান অঞ্চলে এবং সিন্ধু ও পাঞ্জাবের গ্রাম্য অঞ্চলে বসবাস করে। খাইবার পাখতুনখোয়া ও বালুচিস্তান প্রদেশদ্বয়ে শিয়াদের সংখ্যা তুলনামূলক কম, কিন্তু খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কুররাম জেলার রাজধানী পারাচিনার শিয়া–অধ্যুষিত। আর এই পারাচিনারই পরিণত হয়েছে সিরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ইরান কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের একটি বড় কেন্দ্রে।
২০১৩ সালের ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) মিলিট্যান্টরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘সায়্যিদাহ জায়নাব মসজিদে’র ওপর রকেট হামলা চালায় এবং এর ফলে মসজিদটির বাইরের দেয়াল বিধ্বস্ত হয়। উল্লেখ্য, ইমামিয়া শিয়াদের (‘Twelver Shias) বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমা (রা.)–এর মেয়ে জায়নাব বিনতে আলী (রা.)–এর কবর অবস্থিত। জায়নাব ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর দৌহিত্রী এবং ইমাম হুসেইন (রা.)–এর বোন, সুতরাং ইমামিয়া শিয়াদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান।
পাকিস্তানি বিশ্লেষক ফারহান জাহিদের মতে, ১০০৯ সালে ফাতিমীয় শাসক আল–হাকিম বি–আমর আল্লাহ কর্তৃক জেরুজালেমে অবস্থিত ‘চার্চ অফ দ্য হোলি সেপুলকারে’র ধ্বংসসাধন যেমন খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্রুসেডে অংশগ্রহণের জন্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল, আইএস কর্তৃক সায়্যিদাহ জায়নাব মসজিদের ওপর পরিচালিত আক্রমণ পাকিস্তানি শিয়াদের সিরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুরূপ উদ্দীপনা যোগায়।
২০১৩ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সিরিয়ায় যেতে আরম্ভ করে। তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, সিরিয়ায় অবস্থিত শিয়াদের পবিত্র স্থানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রথমে পাকিস্তানি শিয়ারা ইরানি–নিয়ন্ত্রিত ও আফগান স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা গঠিত ‘লিওয়া আল–ফাতিমিউন’ মিলিশিয়ার অংশ হিসেবে যুদ্ধ করে, কিন্তু ক্রমশ তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৪ সাল নাগাদ তারা একটি স্বতন্ত্র মিলিশিয়া গঠন করে। এই মিলিশিয়াটির নামকরণ করা হয় ‘লিওয়া আজ–জায়নাবিউন’ বা ‘জায়নাবের অনুসারী ব্রিগেড’ (Followers of Zainab Brigade)। প্রাথমিকভাবে এই মিলিশিয়াটিকে দামেস্কের সায়্যিদাহ জায়নাব মসজিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লিওয়া আজ–জায়নাবিউন গঠনের পূর্বে ‘লিওয়া আবুল ফাদল আল–আব্বাস’ নামক একটি মিলিশিয়ার ওপর এই মসজিদটি এবং আলেপ্পোয় অবস্থিত শিয়াদের পবিত্র স্থানগুলো রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। এটি মূলত সিরীয় ও ইরাকি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের মে মাসে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘হারাকাত নূর আল–দিন আল–জেনকি’ মিলিট্যান্ট গ্রুপের কাছে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের পর লিওয়া আজ–জায়নাবিউনের নিকট মসজিদটি রক্ষার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।
লিওয়া আজ–জায়নাবিউন গঠনের প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণভাবে ইরান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই মিলিশিয়াটি গঠিত হয় এবং মিলিশিয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সিরিয়ায় মিলিশিয়াটির সার্বিক কার্যকলাপও ইরানিরা তত্ত্বাবধান করে থাকে। এমনকি মিলিশিয়াটির নিহত সদস্যদেরও ইরানেই কবর দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, সিরিয়ায় নিহত পাকিস্তানি শিয়া যোদ্ধাদের ইরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে মহিমান্বিত করা হয়। অর্থাৎ, মিলিশিয়াটি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন, কিন্তু সার্বিকভাবে ইরান কর্তৃক গঠিত, প্রশিক্ষিত ও পরিচালিত।
মিলিশিয়াটিতে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক যোগদান করেছে, তাদের অনেকেই পারচিনারের বিভিন্ন ট্রাইবের সদস্য। পাকিস্তানে বসবাসরত আফগানিস্তান থেকে আগত হাজারা শরণার্থীদের (যাদের সিংহভাগই শিয়া) মধ্য থেকেও কিছু স্বেচ্ছাসেবক মিলিশিয়াটিতে যোগদান করেছে বলে অনুমান করা হয়। তাছাড়া, বেশ কিছু বালুচও এই মিলিশিয়াটিতে যোগদান করেছে, কিন্তু তারা পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ থেকে এসেছে, না ইরানের সিস্তান–বালুচিস্তান প্রদেশ থেকে এসেছে, সেটি স্পষ্ট নয়। তদুপরি, ইরানে বসবাসকারী পাকিস্তানি শরণার্থীদের মধ্য থেকেও কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবককে নিযুক্ত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সব মিলিয়ে মিলিশিয়াটিতে মোট ৮০০ থেকে ২,৫০০ সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মিলিশিয়াটির সদস্য সংখ্যা কত, সেটি যাচাই করা খুবই কঠিন কাজ।
মিলিশিয়াটি গঠনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহু পাকিস্তানি এটিকে ‘পাকিস্তানি হিজবুল্লাহ’ হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করে। কিন্তু কার্যত ‘হিজবুল্লাহ পাকিস্তান’ নামে যে সংগঠনটি পাকিস্তানে সক্রিয় রয়েছে, সেটির সঙ্গে এই মিলিশিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।
স্বেচ্ছাসেবক হতে আগ্রহী ব্যক্তিরা ইরানের কোম শহরে আসে এবং সেখানে তাদেরকে বাছাই করা হয়। সাধারণত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সমর্থ ব্যক্তিদের নিযুক্ত করা হয়। তাদেরকে ইরানে দেড় মাস প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং এরপর সিরিয়ায় ছয় মাস অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকদের ইরানি সরকার বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা প্রদানের অঙ্গীকার করে থাকে, এবং এজন্য বেশ কিছু মানুষ মিলিশিয়াটিতে যোগ দানের জন্য উৎসাহিত হয়। যেমন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন অনুসারে, স্বেচ্ছাসেবকদের ইরানি সরকার মাসে ১,২০,০০০ রূপি বেতন প্রদান করবে এবং তিন মাস পর পর ১৫ দিনের ছুটি দেবে। এছাড়া কোনো স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধে নিহত হলে তার সন্তানদের শিক্ষার খরচ ইরানি সরকার প্রদান করবে এবং নিহত ব্যক্তির পরিবার প্রতি বছর ইরানি সরকারের খরচে ইরান, ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়াদের পবিত্র স্থানগুলোতে তীর্থযাত্রা করার সুযোগ পাবে।
পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবকরা সিরিয়ায় প্রথমে কেবল সায়্যিদাহ জায়নাব মসজিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করত এবং এর বাইরে অন্য কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত না। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আলেপ্পো, দেইর ইয–যর, দারা ও ইদলিব প্রদেশসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করে। বিভিন্ন সময়ে তারা মার্কিন, ইসরায়েলি ও তুর্কি বিমান হামলারও শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চে প্রাপ্ত এক হিসেব অনুযায়ী, যুদ্ধের শুরু থেকে তখন পর্যন্ত ১৬০ জন লিওয়া আজ–জায়নাবিউন সদস্য নিহত হয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলি ও মার্কিন বিমান হামলায় নিহত মিলিশিয়া সদস্যদের এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সুতরাং ২০১৩ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সিরীয় রণক্ষেত্রে নিহত পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা যে এরচেয়ে অনেক বেশি, এটি সহজেই আন্দাজ করা যায়।
সিরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু বিভিন্ন রণক্ষেত্রে সিরীয় সরকারের সহায়ক জনবল হিসেবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য ইরান কর্তৃক পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের সিরীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের বিভিন্ন সমালোচনাও রয়েছে। লিওয়া আজ–জায়নাবিউনের কিছু কিছু সদস্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, কিন্তু কিছু কিছু সদস্যকে কার্যত একটি রাইফেল ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র দেয়া হয় না। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ইরান সিরিয়ায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই মিলিশিয়া সদস্যদের সহজলভ্য ও সহজে খরচযোগ্য সৈন্য (cannon fodder) হিসেবে ব্যবহার করছে। তাছাড়া, ইরানি অর্থনীতির বর্তমান দুর্দশার প্রেক্ষাপটে ইরানিরা এই স্বেচ্ছাসেবকদেরকে প্রতিশ্রুত সুযোগ–সুবিধা প্রদান করতে সক্ষম কিনা, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সিরীয় যুদ্ধে পাকিস্তানি শিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কীরূপ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, সেটি নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বিশেষত ১৯৮০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানে শিয়া–সুন্নি দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ ধারণ করেছে। সেসময় থেকে এখন পর্যন্ত শিয়া–সুন্নি পাল্টাপাল্টি সংঘাতে দশ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশেষত ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের মাত্রা ছিল খুবই তীব্র, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মাত্রা অংশত হ্রাস পেয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেবল পাকিস্তানি শিয়ারাই সিরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, এরকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। শত শত পাকিস্তানি সুন্নিও সিরিয়ায় গিয়েছে এবং আইএসসহ বিভিন্ন সুন্নি বিদ্রোহী গ্রুপে যোগ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে পাকিস্তানি পুলিশ পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে আইএসের একটি শাখাকে নির্মূল করেছে। কেবল এই শাখাটিই আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ১০০ জনের বেশি পাকিস্তানি নাগরিককে সিরিয়ায় প্রেরণ করেছে। অর্থাৎ, পাকিস্তানি নাগরিকরা সিরীয় সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের পক্ষেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং করছে।
কিন্তু শিয়ারা যেহেতু পাকিস্তানে সংখ্যালঘু, সুতরাং ইরানিদের তত্ত্বাবধানে সিরীয় যুদ্ধে তাদের একাংশের অংশগ্রহণের ফলে পাকিস্তানে শিয়া–সুন্নি দ্বন্দ্ব আগের চেয়েও তীব্র হয়ে উঠতে পারে, এরকম একটি আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পাকিস্তানি সুন্নি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘লস্কর–ই–ঝাংভি’ পারাচিনার অঞ্চলে (সিরিয়ায় যুদ্ধরত পাকিস্তানি শিয়াদের বড় একটি অংশের উৎপত্তিস্থল) একটি ভয়াবহ বোমা হামলা চালায়, যার ফলে অন্তত ২৩ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।
গ্রুপটির মতে, এই হামলাটি ছিল সিরিয়ায় ‘সুন্নিদের বিরুদ্ধে শিয়াদের সংঘটিত অপরাধগুলো’র প্রত্যুত্তর। তারা আরো হুমকি প্রদান করেছিল, পারাচিনারের শিয়ারা যদি সিরিয়ায় যোদ্ধা প্রেরণ বন্ধ না করে, তাহলে এরকম হামলা আরো চালানো হবে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে (ও বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশে) বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তদুপরি, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সিরিয়ায় যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর যুদ্ধে অভিজ্ঞ ও যুদ্ধের ফলে চরমপন্থী হয়ে উঠা পাকিস্তানি শিয়ারা পাকিস্তানে ফিরে আসবে এবং দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে। এই শিয়া মিলিট্যান্টরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইরানের প্রভাব বিস্তারের ভূমিকা রাখতে পারে এবং সিরিয়ায় অর্জিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে পাকিস্তানি সুন্নি মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে। এর ফলে পাকিস্তানের নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। তদুপরি, চলমান সৌদি–ইরানি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পাকিস্তান যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিরিয়া থেকে শিয়া মিলিট্যান্টদের প্রত্যাবর্তনের পর যদি পাকিস্তানে তীব্র সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান সৌদি–ইরানি প্রক্সি যুদ্ধের একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, লিওয়া আজ–জায়নাবিউন সদস্যরা সিরীয় যুদ্ধে সিরীয় সরকারের সহায়ক জনবল হিসেবে কাজ করেছে এবং বিভিন্ন রণক্ষেত্রে তাদের সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে। এই মিলিশিয়াটির সদস্য সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারা একটি তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠতে পারে।