ঈশ্বরের নিজস্ব যমজ গ্রাম কোদিনহিতে আপনাকে স্বাগতম।
গ্রামে ঢোকার পথেই নীল রঙের সাইনবোর্ডে ঠিক এই লেখাটিই চোখে পড়বে। গ্রামটির অবস্থান ভারতের কেরালা রাজ্যের মালাপ্পুরম জেলায়।
আয়তন ও জনসংখ্যায় বিশাল দেশ ভারতে বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই দেশটি ভাষা, ধর্ম কিংবা প্রকৃতি সবদিক দিয়েই বৈচিত্র্যে ভরপুর। ভারতের বৈচিত্র্যের বিশেষ এক স্থান দখল করে নিয়েছে কেরালার কোদিনহি গ্রাম, বিশ্বজুড়ে যার পরিচিতি ‘টুইন ভিলেজ’ বা ‘যমজ গ্রাম’ নামে।
জেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রায় বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম কোদিনহি। গ্রামের তিন পাশেই পানি। মাত্র একদিকে ভূমি, যেখান দিয়ে নিকটবর্তী তিরুরাঙ্গাদি শহরের সাথে গ্রামের মানুষের যোগাযোগ।
এই গ্রামে সবমিলিয়ে দুই হাজারের কিছু বেশি পরিবারের বসবাস, জনসংখ্যার মোট হিসেবে অঙ্কে ১১ হাজারের মতো, যাদের ৮৫ ভাগই মুসলিম। বাদ বাকি সব হিন্দু পরিবার। তবে এই গ্রামের অবাক করা তথ্য হলো, মাত্র দুই হাজার পরিবারের মধ্যে জমজের সংখ্যা ৪৫০ জোড়া!
ভারতে জাতীয়ভাবে যমজ সন্তান জন্মের গড় হার প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জন, সারা পৃথিবীতে যা প্রতি হাজারে ৬ জন। কিন্তু কোদিনহি গ্রামে প্রতি হাজারে প্রায় ৪৫ জন যমজ সন্তানের জন্ম হয়ে থাকে, যা বৈশ্বিক গড়ের আট গুণের কাছাকাছি।
তবে কোদিনহি গ্রামে যমজ সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০-৭০ বছর আগে থেকে। এর আগে এই গ্রামে যমজ সন্তান জন্মের হার স্বাভাবিকই ছিল। এবং বর্তমানে এই গ্রামে যমজ সন্তান জন্মের হার আগের চেয়েও বেড়েছে।
২০০৮ সালে এক হিসাব অনুযায়ী, কোদিনহি গ্রামে ২৬৪ জোড়া যমজ ভাই-বোন ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ৪৫০ জোড়ায় ঠেকেছে। এই সংখ্যা অবশ্য পুরোপুরি সঠিক নয়। পদ্ধতিগতভাবে গণনা করলে সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গ্রামে প্রকৃতভাবে পাঁচ শতাধিক যমজ ভাইবোন রয়েছে।
কোদিনহি গ্রামে প্রতি বছরই গড়ে ১৫ জোড়া যমজ সন্তানের জন্ম হয়। এমনকি গ্রামের মোট সংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ যমজ ভাইবোন। স্কুল থেকে শুরু করে পাড়ার মাঠ, সবখানেই যমজের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে এ নিয়ে বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয় অনেকের। বিশেষ করে গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলার সময়। যমজ ভাইদের সব সময় একই দলে রাখা হয়। কারণ দুই ভাই দুই দলে খেললে অন্যরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।
কোহিনদি গ্রামের এই রহস্য দীর্ঘদিন মানুষের কাছে অজানা ছিল। ২০০৮ সালের দিকে সাধারণ এক খবরের হাত ধরে সংবাদমাধ্যমে কোদিনহি গ্রামের বিষয়টি উঠে আসে। এরপরই পুরো বিশ্বে এই গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি কোদিনহির বাসিন্দারাও জানতেন না তাদের গ্রামে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক যমজ ভাইবোন বাস করে। এরপর তারাও এই রহস্যের সমাধান জানতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
কোদিনহি গ্রামের যমজ সন্তানের কথা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে জেনেটিক বিশেষজ্ঞরা এর রহস্য উদঘাটনের সিদ্ধান্ত নেন। হায়দরাবাদের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি, কোচির কেরালা ইউনিভার্সিটি অব ফিশারিজ অ্যান্ড ওশানিক স্টাডিজ, জার্মানির টিউবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের মোট ১২ জনের এক বিশেষজ্ঞ দল ২০১৬ সালে কোদিনহি গ্রামের যমজদের উপর গবেষণা চালান।
বিশেষজ্ঞরা সেখানকার যমজ বাচ্চাদের জিন স্ক্রিনিং করার পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। সেই সাথে কোদিনহি গ্রামের মাটি, বাতাস ও খাবার থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই বিশেষজ্ঞ দল এখন পর্যন্ত কোদিনহি গ্রামের অতিমাত্রার যমজ সন্তান জন্মের বিষয়ে কোনো কারণ উল্লেখ করতে পারেননি! ফলে তা এখনো রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।
স্থানীয় লোকজন এর পেছনে অবশ্য অনেক প্রচলিত গল্পের পাশাপাশি কিছু অবৈজ্ঞানিক কারণের কথা বলে থাকেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সেসব বিষয়কে মেনে নেননি। কিছু বিশেষজ্ঞ এর পেছনের কারণ হিসেবে জিনকে দায়ী করেছেন। কিন্তু তারা কোনো জেনেটিক প্রমাণ দিতে পারেননি।
স্থানীয় এক চিকিৎসক ডা. কৃষ্ণান শ্রিবিজু কোদিনহির রহস্য উদঘাটনের জন্য কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ধারণানুযায়ী, এর পেছনে জেনেটিক, বায়োলজিক্যাল, মলিকিউলার কিংবা জলবায়ুগত কারণ থাকতে পারে। তবে তা বের করার জন্য আরো বড় আকারে গবেষণা প্রয়োজন।
ঈশ্বরের আশীর্বাদ
কোদিনহি গ্রামে বর্তমানে সবচেয়ে বয়স্ক যমজ নারীদের মধ্যে রয়েছেন পাথুটি ও তার বোন কুনহি পাথুটি। তাদের দুজনের বয়স বর্তমানে ৭২ বছর। তাদের দুজনের মতে, তাদের গ্রাম ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। পাথুটি বলেন,
এটি একমাত্র ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এছাড়া আর কিছুই নয়। বিজ্ঞান কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। আমরা তো বর্তমানে তিন সন্তান, চার সন্তান হতে দেখছি। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেও না।
অদ্ভুত বিষয় হলো- কোদিনহি গ্রামে পুরুষরা যদি অন্য গ্রামের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন তাদেরও যমজ সন্তান হয়। আবার এখানকার মেয়েরা অন্য গ্রামে গিয়ে যমজ সন্তানের মা হয়েছেন। কেউ কেউ প্রথমবারেই একসাথে দুই সন্তানের জননী হয়েছেন। আবার অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের সময় যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
কোদিনহি গ্রামের নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কৃত্রিম উপায় গ্রহণ করেন না। আবার তারা জন্ম নিরোধক কোনো ওষুধ কিংবা পদ্ধতিও গ্রহণ করেন না। তবে যেসব নারী যমজ সন্তানের মা হয়েছেন, তাদের অধিকাংশেরই বয়স কম ছিল এবং প্রথমবারেই এমন হয়েছে।
তবে কোদিনহি গ্রামের যমজ সন্তান হওয়ার রহস্য উদঘাটিত না হলেও তা পর্যটনের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছে। ভারত এবং ভারতের বাইরের থেকে আসা যে সকল পর্যটক কেরালা ভ্রমণে যান, তারা কোদিনহি গ্রামে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে করে এই গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বেশ পরিবর্তন হয়েছে।
কোদিনহি একমাত্র গ্রাম নয়
এর আগে কোদিনহির মতো আরো দুটি গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি নাইজেরিয়ার ইগবো ওরা, অন্যটি ব্রাজিলের ক্যানডিডো গোডোই। এই দুই গ্রামেও প্রচুর সংখ্যক যমজ ভাইবোন রয়েছে। তবে তা কোদিনহির চেয়ে কম। তদুপরি বিজ্ঞানীরা নাইজেরিয়া ও ব্রাজিলের গ্রাম দুটির যমজ সন্তান হওয়ার রহস্যের সমাধান করেছেন।
ইগবো ওরা গ্রামে যমজ সন্তান জন্ম হওয়ার পেছনে নারীদের দেহে একপ্রকার রাসায়নিককে দায়ী করা হয়। এছাড়া সেখানকার মানুষ অতিমাত্রায় মিষ্টি আলু খেয়ে থাকে। সেখানকার এই আলুও যমজ সন্তান হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে।
অন্যদিকে ক্যানডিডো গোডোই গ্রামটি ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে মাত্র ছ’হাজার মানুষ বাস করেন। গ্রামে অল্প সংখ্যক মানুষের বসবাসের কারণে তারা নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক গড়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা এই গ্রামে যমজ সন্তান হওয়ার পেছনে এই বিষয়কে দায়ী করেছেন।