Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বব্যাপী তেলের দামের বিপর্যয় ও অর্থনীতির লড়াই

বিশ্বজুড়ে জ্বালানী তেলের দাম অনেকদিন ধরেই কমতির দিকে। মাত্র কয়েক মাস আগেই যে অপরিশোধিত জ্বালানী তেল বা ক্রুড অয়েলের প্রতি ব্যারেলের দাম ৬৫ ডলার ছিল, মধ্য এপ্রিলে তার দাম ১৫ ডলার ছুঁয়েছে।

অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামের পড়তি

 

এই পড়তি দামের কারণ হিসেবে মনে হতে পারে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়া। এটা যদিও সত্য যে করোনা ভাইরাসের প্রভাব তেলের বাজারে মন্দার কারণ, তবে এর ক্রমাগত দাম কমে যাওয়ার পেছনে যে জিনিসটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি সেটি মূলত সৌদি আরব-রাশিয়া-আমেরিকার মধ্যে চলা বিশ্ব তেল বাণিজ্যের আধিপত্যের লড়াই। এই সংঘাত শুধু যে তেলের দাম কমিয়ে বাজারে মন্দা তৈরি করছে এমন নয়, বরং এর কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিভিন্ন দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বড় পরিবর্তন আসছে।

এই বিশ্লেষণে যাবার আগে আমাদের আবার মনে করা দরকার অর্থনীতির একদম মূল একটি কথা। যেকোনো হস্তক্ষেপমুক্ত বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম নির্ভর করে তার যোগান ও চাহিদার উপর। যদি চাহিদার পরিমাণ বেশি হয় এবং যোগান সীমিত থাকে সেক্ষেত্রে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

অর্থনীতি চাহিদা-যোগান ও দামের সম্পর্ক; Image: darkness

এই ব্যপারটিই ঘটেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি অপরিশোধিত তেল উৎপাদনকারী দেশ আমেরিকা, রাশিয়া ও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে। এই ৩টি দেশ সহ অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী সকল দেশের লক্ষ্য থাকে তাদের উৎপাদনের পরিমাণ যেন বেশি হয় এবং বাজারে দামও যেন বেশি হয়, যাতে করে লাভের পরিমাণ বেশি থাকে। কিন্ত যে দেশগুলো তেল কেনে তাদের লক্ষ্য থাকে কোথা থেকে কিনলে দাম সবচেয়ে কম পাওয়া যাবে।

সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী ১০ দেশ 

 

এই অবস্থার কারণে উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে কে কার থেকে কম দামে বিক্রি করতে পারে যেন লাভের পরিমাণ কিছুটা কম হলেও, বিক্রির সংখ্যার দিক থেকে যেন এই লাভের কমতি কাটিয়ে উঠা যায়। এতেও প্রতিযোগিতা যেহেতু কমবে না, তাই এর সমাধান হলো সকল উৎপাদনকারী দেশ একসাথে বসে যদি তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয় এবং বিশ্ববাজারে তেলের যোগানও নির্ধারিত পরিমাণে রাখে। এতে সকল দেশেরই লাভ। এই উদ্দেশ্যে একটি সংস্থাও আছে, যার নাম ওপেক বা অর্গানাইজেশন ফর পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ। ১৩টি দেশের একে অপরের সাথে এটি মূলত একটি চুক্তি যে, তারা একসাথে ঠিক করবে তাদের তেলের দাম কেমন হওয়া উচিত এবং সরবরাহ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকা এবং রাশিয়া এর সদস্য নয়।

OPEC দেশসমূহ; Image: stock.adobe.com

বাজার স্থিতিশীল করলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ওপেক কিছু ওপেক বহির্ভুত দেশগুলোকেও চুক্তির আওতায় আনে যে তারা বাজার ঠিক রাখতে প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কম বাজারজাত করবে। এই চুক্তিতে ওপেকের ১৩ দেশের সাথে ঐক্যমত হয় ওপেকের বাইরের ১০ টি দেশের মধ্যে। এর মধ্যে রাশিয়াও ছিল। এর নাম দেয়া হয় ওপেক+ এবং একসাথে এই ২৪ দেশ বিশ্বের ৫৫% তেলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া–সৌদি আরব সম্পর্ক নতুন মোড় নেয় । 

OPEC+ দেশসমূহ; breakthroughfuel.com

এখন ফেরা যাক করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজ ও আমদানী রফতানী শিল্প পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়ায় জ্বালানী তেলের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে। এই পরিস্থিতে যেহেতু তেলের দাম কমে যাবে তাই ওপেক ২০২০ এর মার্চে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে একটি জরুরি মিটিং তলব করে এবং প্রস্তাব করে প্রতিদিন ১.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কম উৎপাদন করে সাপ্লাই কমিয়ে যেন দামের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। কিন্তু রাশিয়া তার ভোল পাল্টে ফেলে এবং এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শুধু তাই নয়, রাশিয়া বরং আগের চেয়ে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় অনেক বেশি পরিমাণে যার ফলে এত কম চাহিদার বিপরীতে এতো বেশি তেল উৎপাদিত হয় যে দাম একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

প্রশ্ন আসতে পারে কেন রাশিয়া এমন করলো এবং এই অবমূল্যে রাশিয়া নিজেসহ সকল তেল উৎপাদনকারী দেশেরই কেন ক্ষতি করলো। উত্তর হলো রাশিয়ার এই আক্রমণ মূলত ছিল আমেরিকার প্রতি। রাশিয়া আমেরিকার দ্বৈরথ ১৯৫০-এর দশকে শুরু হলেও তেল নিয়ে এই যুদ্ধ মূলত শুরু হয় ২০১৪ সালে। আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগেও আমেরিকাকে নিজের চাহিদা মেটাতে অপরিশোধিত তেল আমদানী করতে হতো কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৪ এর কোন এক সময়ে আমেরিকার অপরিশোধিত তেলের শিল্পে নতুন এক প্রযুক্তির বিল্পব শুরু হয়ে যায়। ‘শেইল এনার্জি’ নামের এই প্রযুক্তি হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং ও হরিজন্টাল ড্রিলিং নামের দুটি প্রযুক্তির সহায়তায় তেলকুপ থেকে আগের চেয়ে অনেক কম খরচে অনেক বেশি পরিমাণ তেল তুলতে পারতো। এই ‘শেইল ওয়েল’ এত বেশি বৈপ্লবিক ছিল যে এটি সৌদি আরব ও রাশিয়াকে পেছনে ফেলে আমেরিকাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানী তেল উৎপাদনকারী দেশ বানিয়ে দেয়। শেইল ওয়েল উৎপাদন হতেই বিশ্বে তেলের যোগান প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়ে যায় এবং দাম দ্রুত পড়তে থাকে।

Shale Technology তে তেল উৎপাদন; Image: hydraulics.thesetupwarrior.com

এর বিপরীতে ওপেক চিন্তা করলো তারা তেলের উৎপাদন আরো বেশি বাড়িয়ে দেবে যেন তেলের দাম আরো পড়ে যায়। এতে লাভের পরিমাণ এতো বেশি কমে যাবে যে আমেরিকার কাছে এই ব্যবসা আর লাভজনক মনে হবে না এবং ব্যবসা গুটিয়ে সরে যাবে। রাশিয়া এবং আরব বিশ্বের তেল উত্তোলনে জড়িত কোম্পানিগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত ফলে সাময়িক ক্ষতি তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব। আমেরিকার কোম্পানিগুলো প্রাইভেট, ফলে এই ক্ষতিতে তারা দেউলিয়া হলেও আমেরিকা সরকার তাদের সাহায্য করবে না। এই ছিল পুরো প্ল্যান। এছাড়া রাশিয়া ইউক্রেন ইস্যুসহ অন্যান্য কিছু বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এটি ছিল আমেরিকার নগ্ন হস্তক্ষেপের উপর রাশিয়ার প্রতিশোধ। 

ইউক্রেন আমেরিকা সম্পর্ক রাশিয়ার মাথাব্যথার কারণ; Image: BBC

এই প্ল্যানের ফলে আপাতদৃষ্টিতে প্ল্যান কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হবে মনে হলেও বাস্তবে এতে ছোট ছোট কোম্পানির ক্ষতি হলেও এক্সন কিংবা শেভরনের মতো বড়  কোম্পানীগুলো এই ধকল সহ্য করে নিতে পারবে। এছাড়া আমেরিকা সরকার নিজেও এই খাতের উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে ফান্ডের ব্যবস্থা করছে। রাশিয়ার কাছে স্বল্পমেয়াদে এই ক্ষতি সহ্য করে নেয়ার উপায় থাকলেও দীর্ঘদিন এমন চলতে থাকলে রাশিয়ার তেল নির্ভর নাজুক অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। সৌদি আরবও থেমে নেই। যদি রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং আমেরিকাও এই ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ায় এই আশায় সৌদি সরকারও তেলের সাপ্লাই বাড়িয়ে দিয়েছে। 

এই ধনীদের যুদ্ধে যেই জিতুক না কেন, ক্ষতিতে পড়ে যাচ্ছে ইরান, ইরাক, আর্জেন্টিনা, আইভেরিকোস্ট, মালোয়েশিয়া, আজারবাইজান বা কাজাকিস্তানের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো। এই যুদ্ধে মাঝখান দিয়ে লাভ করছে সেই দেশগুলো যারা প্রচুর পরিমাণে তেল আমদানী করে। এর মধ্যে আছে জাপান, ভারত ও চীন।

আরেকটা ব্যপার এখানে রয়ে যাচ্ছে বিশ্ব জলবায়ুর। তেলের দাম কমায় বিদ্যুৎ বা সৌর চালিত গাড়ি বা যোগাযোগ প্রযুক্তির চাহিদা আগের চেয়ে কমে যাবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুকি আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। এছাড়া তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় শক্তির অন্যান্য উৎসের সাথে জড়িত ব্যবসাগুলোর লোকসান গুনতে হচ্ছে যার কারণে বেড়ে যাচ্ছে বেকারত্ব।

এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা; stock.adobe.com

 

বিশ্বায়নের এই সময়ে আজকের কোন পদক্ষেপে স্বল্পমেয়াদে কে জয়ী হচ্ছে আর দীর্ঘমেয়াদে কে জয়ী হবে সেটি ধারণা করা অনেক জটিল ব্যপার। সে জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সময়ের আর তেলের মতো অনবায়নযোগ্য শক্তির বদলে ব্যবহার বাড়াতে হবে নবায়নযোগ্য শক্তির।

Related Articles