Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

করোনা ভ্যাকসিন ও রাজনীতির মারপ্যাঁচ

গত বছরের নভেম্বরে যখন করোনাভাইরাসের প্রথম কেস পাওয়া যায় চীনের হুবেই প্রদেশে, তখন আসলে কেউ জানতো না এই ভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলবে। খুব দ্রুতই অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা পুরো সমাজকে স্থবির করে দিয়ে এক অজানা আতঙ্কের ছায়া নেমে আসবে পুরো বিশ্বে– এরকমটা এই বছরেরও শুরুতেও ভাবা দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে অকল্পনীয় সব ঘটনাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে, হচ্ছে, সামনে হয়তো আরও হবে।

করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে, রাজনীতি নতুন মাত্রা পাচ্ছে, ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে, সমাজের অনেক কিছু পুনর্গঠিত হচ্ছে, অনেক চিরন্তন নীতি ভেঙে পড়ছে। মোট কথা, করোনাভাইরাস সবকিছুতেই অল্প সময়ে এত বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে যে, এগুলো নিয়ে ভাবতে গেলেও মগজের সংকীর্ণতা গ্রাস করে আমাদের।

করোনাভাইরাস যখন এ বছরের শুরুর দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তখন উৎপত্তির দেশ হিসেবে চীনকে সমালোচনার ঝড় সহ্য করতে হয়েছে। অবশ্য চীনকে একেবারে নির্দোষ আখ্যা দেয়ার উপায় নেই। প্রাথমিকভাবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তথ্য গোপন করেছিল। গোপন না করলে হয়তো বাকি দেশগুলো আরেকটু সতর্ক হতে পারতো, করোনার প্রস্তুতি নিতে আরেকটু সময় পেত।

যা-ই হোক, সবকিছু বিবেচনায় না নিয়ে আমরা আমেরিকা ও তার দীর্ঘ দিনের মিত্র ইউরোপ যেভাবে জাতীয়তাবাদের মিশেলে বর্ণবাদী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিয়েছে মিডিয়ার মাধ্যমে, সেটিও আদতে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যেটি চূড়ান্ত রকমের বর্ণবাদী আচরণ হিসেবে সমালোচিত হয়েছে পুরো বিশ্বে। করোনার ফলে বিভিন্ন নিও-লিবারেল নীতিতে চলা পুঁজিবাদী দেশের স্বাস্থ্যখাত যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দিতে জাতীয়তাবাদী কিংবা বর্ণবাদী প্রোপাগান্ডা চালানো নতুন কোনো অস্ত্র নয়। রাজনৈতিক নেতারা অনেক আগে থেকেই এমনটা করে আসছেন।

Zbbss
করোনা ভাইরাসকে একপর্যায়ে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যেটি পুরো বিশ্বে সমালোচিত হয়; image source: vt.co

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কার হবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। সম্প্রতি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ইতিবাচক ফলাফল আমাদের আশাবাদী চোখকে আরেকটু উজ্জ্বল করেছে। পৃথিবীকে আগের অবস্থায় ফিরে পেতে সবাই একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে ভাইরাস হানা দেওয়ার পর থেকেই। লকডাউনের ফলে যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিটি দেশকে, তা থেকে মুক্তির অন্যতম প্রধান উপায় একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা তৈরি করা। অনেক দেশেরই রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন সেক্টরে ইতোমধ্যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের সেসব ব্যর্থতার গল্প আড়াল করতে পারে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন, যা করোনাভাইরাসের ধ্বংসযজ্ঞ থামিয়ে দেবে, অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। এজন্য রাজনীতিবিদ কিংবা দেশের সাধারণ জনগণ– সবার জন্যই করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

অনেক দেশেরই শতাধিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কোমর বেধে নেমেছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। এর মধ্যে অনেকগুলো বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। অনেক দেশ সরকারিভাবে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনের সবচেয়ে বড় করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রজেক্টে অর্থায়ন করছে চীনের শি জিনপিং সরকার। আমেরিকাতেও ট্রাম্প সরকার বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মে সরকারি অনুদান দিচ্ছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার কীরকম তিক্ত সম্পর্ক ছিল, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ১৯৫৮ সালে আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়া যৌথভাবে গুটিবসন্ত নির্মূলে এক হয়ে কাজ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। ফলাফল– মাত্র এক যুগেরও কম সময়ে পুরো বিশ্ব থেকে গুটিবসন্তের বিদায়। স্নায়ুযুদ্ধের সেসময়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এই ঘটনা পৃথিবীর অনেক শান্তিকামী মানুষের মনে শীতল বাতাস বয়ে এনেছিল। কিন্তু এবার শুরুর দিকেই যেভাবে মার্কিনীরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে চীন-মার্কিন যৌথ করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রজেক্টের চিন্তা দিবাস্বপ্ন ব্যতীত কিছু নয়। বাস্তবে তা হয়ওনি।

Sbsbsbs
আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা, যাদের যৌথ উদ্যোগে যেবার বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল;
image source: nlm.nih.gov

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাথে যেহেতু বিশাল সম্মান ও মর্যাদা জড়িত আছে, তাই শক্তিধর দেশগুলো নিশ্চিতভাবেই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাইবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যেই দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মগুলোকে চাপ দিচ্ছেন দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে– এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। রাশিয়ার হ্যাকারদের মাধ্যমে আমেরিকা, ব্রিটেন ও কানাডার সরকারি সার্ভারে হানা দিয়ে ভ্যাকসিন আবিস্কার সম্পর্কিত তথ্য চুরি করার চেষ্টা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়ার হ্যাকাররা পুতিন সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সহায়তা পেয়ে থাকে। আমেরিকার পারমাণবিক বোমা প্রজেক্টের গোপন তথ্যও সোভিয়েত রাশিয়ানরা গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমেই হাতিয়ে নিয়েছিল।

ধরুন, আমেরিকায় করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো। আমেরিকা যেহেতু এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে চলে, তারা সন্দেহাতীতভাবেই আগে নিজেদের জনগণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করবে, তারপরে গোটা পৃথিবীর কথা চিন্তা করবে। এখন বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার সব মানুষের জন্য করোনা ভ্যাকসিন তৈরি করার পর বাকি পৃথিবীর জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করতে, সেই ভ্যাকসিন প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করতে অনেকটা সময় চলে যাবে। এই সময়ে আরও অনেক মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হবে।

আমেরিকার আলো ঝলমলে ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্ম থেকে আফ্রিকার দুর্গম এলাকার কোনো গ্রামে ভ্যাকসিন পৌঁছতে বেশ খানিকটা সময় যে লাগবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সময়ের মধ্যে আরও অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। মোট কথা, আবিষ্কারের পর পরই যদি ভ্যাকসিনের পেটেন্ট উন্মুক্ত করে দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে আবিষ্কারক দেশ বাদে সবাই বিপদে পড়বে। সবচেয়ে বিপদে থাকবে আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো।

আমেরিকা নিজেদের দেশে তো চেষ্টা করছেই, সেই সাথে বাইরের দেশের প্রজেক্টেও একাধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। জার্মানির একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ‘কিউরভ্যাক’ এর সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের সবকিছু নিজের দেশের জনগণপর কিনে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফ্রান্সের একটি বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি স্যানোফি জানিয়েছিল, আমেরিকার সবচেয়ে বেশি প্রি-অর্ডার করার অধিকার রয়েছে, যেহেতু তারা বিনিয়োগের ঝুঁকি দেখিয়েছে। কীসের জোরে আমেরিকা বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মগুলোর মধ্যে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছে, তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। ভ্যাকসিনের আবিষ্কার জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা হতে যাচ্ছে, সেই সাথে এটি একটি বিশাল রাজনৈতিক ঘটনাও।

Sbsbsb
বিশ্বব্যাপী অনেক কোম্পানি বিশাল মুনাফার লক্ষ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে;
image source: businessinsider.com

অতিমাত্রায় ডানপন্থী পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে কে কত দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারে। কারণ যে কোম্পানি আগে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে, সে-ই করোনাভাইরাসের এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লুটতে পারার সামর্থ্য রাখবে। পুঁজিবাদে মুনাফাই শেষ কথা, নীতি-নৈতিকতা কিংবা মানবতার বালাই নেই। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সামাজিক নিরাপত্তাহীন অসচ্ছল জনগোষ্ঠী। যাদের উঁচু দরে ভ্যাকসিন কেনার সামর্থ্য নেই তাদের ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার বিষয়টি দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতিবিদেরা যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বেধে দেয়া উঁচু দরই মেনে নিতে হবে। তখন করোনা ভ্যাকসিন শুধু গুটিকয়েক অভিজাত ও মধ্যবিত্ত ব্যক্তিরাই ভোগ করবে, নিম্নবিত্তদের আর ভ্যাকসিনের মুখ দেখতে হবে না।

করোনা ভ্যাকসিন যে দেশই আবিষ্কার করুক না কেন, তা বৈশ্বিক আবিষ্কার হিসেবেই পরিগণিত হবে। বিজ্ঞান কোনো ব্যক্তি কিংবা দেশের কল্যাণে কাজ করে না, সব দেশের সকল মানুষের জন্যই বিজ্ঞান। রাজনীতির ফায়দা লোটার জন্য যদি করোনা ভ্যাকসিনকে নির্দিষ্ট স্থানের মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় কিংবা পুঁজিবাদের নির্মমতার গ্যাড়াকলে পড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখা হয়, তাহলে তা হবে চরম অমানবিক ঘটনা। ভূ-রাজনীতিতে বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রে সেই শত্রুতা টেনে আনা মোটেও সুখকর নয়।

Bsbbsb
উগ্র-জাতীয়তাবাদী কিংবা পুঁজিবাদীদের হাতে বন্দী না হয়ে ভ্যাকসিন হোক সব দেশের, সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত;
image source: flickr.com

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের আবিষ্কার ও প্রাপ্যতা একটি রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। তাই মানবতার কথা চিন্তা করে হলেও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক করোনা ভ্যাকসিনের পেটেন্ট। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে করোনা ভ্যাকসিন শুধু নিজ দেশের জন্য বরাদ্দ রেখে দিলে তা চরম বৈষম্যের উদাহরণ হয়ে থাকবে। করোনা ভ্যাকসিনের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতারা শত্রুতা ভুলে গিয়ে সবাইকে সহযোগিতার মনমানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করার প্রত্যাশা রাখে পৃথিবীর শান্তিকামী সাধারণ মানুষ।

Related Articles