বাইরে করোনা, ঘরে উদ্বেগ। প্রতিদিন নতুন নতুন মৃত্যুর খবরে বাড়ছে মানসিক চাপ আর বাইরের দুনিয়ার আকর্ষণ। কয়েকটা দিন ঘরে কাটানোর পর খোলা মাটিতে পা রাখার ইচ্ছা এখন দুর্নিবার। এই যখন ডাঙার অবস্থা, তখন কেমন কাটাচ্ছেন জলের মানুষেরা?
জলের মানুষ; এরা বছরের বড় সময় জলে কাটান। দরিয়ায় জাহাজ নিয়ে ভাসেন। বন্দর থেকে বন্দরে নোঙর করেন। অথই দরিয়ায় যারা ডাঙার স্বপ্নে বিভোর থাকেন, তাদেরকে ডাকা হয় নাবিক। এই করোনাকালে কেমন আছেন জাহাজের নাবিকেরা?
নাবিকজীবন রোমাঞ্চকর। দুঃসাহসিক। যারা জীবনকে ওভাবে দেখেন, তারা সিন্দাবাদের মতো। ডাঙায় এসেও মন টেকাতে পারেন না। দরিয়ার গর্জন তাদের ডাকে। সাগরের আকাশ থেকে হাতছানি দেয় অ্যালবাট্রস।
কিন্তু সিন্দাবাদের জীবন রুপকথার। একটা সময় নাবিকদের জীবন এমন রুপকথার মতোই ছিলো। এখনো আছে। হ্যাঁ, প্রযুক্তি মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে দিলেও এখনো প্রকৃতির বিশালতাকে ছুঁতে পারেনি মানুষ।
এখনো বিশাল সাগরে প্রতিটি ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে রহস্য। আছে বিপদ। ঝড়ের শঙ্কা। জলদস্যুর ভয়। কখনো কখনো মোড়ল দেশগুলোর লড়াইয়ের নিরীহ শিকারও হতে হয় নাবিকদের।
এত সব ঝুঁকির মুখে জাহাজে ভেসে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া, নতুন কিছু দেখা, আবিষ্কার আর দুঃসাহসিক যাত্রার মধ্যে আছে রোমাঞ্চকর আনন্দ। নাবিক-জীবনের পাওয়ার হিসাব এতটুকুই। এই এতটুকুর বিনিময়ে জলে ভেসে যায় তাদের স্বাভাবিক জীবন। যতদিন জলে থাকে, ততদিন ডাঙা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। সাগরযাত্রায় একেকটি দিন যায়, আর বাড়ি ফেরার স্বপ্ন একটু একটু করে এগিয়ে আসতে থাকে নাবিকের কাছে। কিন্তু এ বছর করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে নাবিকের সেই স্বপ্নের মাঠে।
সারা পৃথিবীতে পণ্যবাহী জাহাজগুলোর নাবিকেরা আটকে আছেন জাহাজের ভেতর। অথবা কোনো হোটেলে। আবার অনেকে জাহাজ নোঙর করতে পারছেন না বন্দরে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবী থেমে আছে। যে যেখানে ছিলো, সেখানেই থাকার নির্দেশনা রয়েছে। নাবিকেরাও আছেন সেভাবেই। যার কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই মাস আগে, তাকেও এখন অস্থির সময় কাটাতে হচ্ছে জাহাজের ডেকে। অথবা কোনো বন্দরের হোটেলে। এভাবে প্রতি মাসেই ১০ লাখের মতো নাবিকের চুক্তি শেষ হয় পণ্যবাহী জাহাজে। চুক্তি শেষে শুরু হয় নাবিকদের মুক্তজীবন। বাড়ি ফেরা। পরে নতুন চুক্তি শুরুর আগে আগে এসে জাহাজে উঠতে হয় নাবিকদের। কিন্তু এবার বাড়িতেই ফিরতে পারছে না ক্লান্ত নাবিকেরা। ফেরার পথ খোলা নেই। আকাশে বিমানে উড়ছে না। সড়কে চাকা ঘুরছে না। সুতরাং ডাঙায় থেকেও নাবিকদের ঘিরে ধরেছে অথৈ দরিয়ার অনিশ্চিত শঙ্কা।
জমানো খাবার শেষ হয়ে এসেছে। পকেটের টাকায় টান পড়েছে। তবুও কাটছে না সঙ্কট। কবে কাটবে, তা-ও অনিশ্চিত। সময়টা আরো লম্বা হতে পারে বলেই সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এদিকে জাহাজের মালিকানা যেসব কোম্পানির, তাদের পক্ষ থেকেও আসছে না নির্দিষ্ট কোনো বার্তা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ কোম্পানি এপি মলার-মারস্ক তাদের নাবিকদের নিয়মিত পরিবর্তন বন্ধ করে দিয়েছে। নাবিকদের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
সংক্রমণমুক্ত থাকার এই প্রক্রিয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন নাবিকেরা। একদিকে আপনজনের কাছে যাওয়ার আকুতি। অন্যদিকে করোনার শঙ্কা। এই দুইয়ে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে জীবন। সাগরে জাহাজ ভাসছে। তবে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধে আটকে আছে ক্লান্ত নাবিক। এক নাবিক তার মাকে লিখেছেন, “মা, আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি।“
অথচ পণ্যবাহী জাহাজের নাবিকদের এসব খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হচ্ছে না সংবাদমাধ্যমগুলোতে। অন্যদিকে সামরিক জাহাজ ও নৌসেনাদের করোনা ঝুঁকি ও আক্রান্তর খবরগুলো ভাইরাল হতে দেখা গেছে। তবে মার্চ মাসের একটি খবরে জানানো হয়েছিলো- ২৬ তারিখ ইউক্রেন থেকে ছেড়ে আসা একটি পণ্যবাহী জাহাজ নোঙর করে ইস্তানবুলে। চীনের কসকো শিপিং লাইনসের এই জাহাজটি ক্যাপ্টেন ছাড়াই ইস্তানবুলে পৌঁছায়। নাবিকরা জানিয়েছেন, জাহাজের ডেকেই ক্যাপ্টেনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কীভাবে?
সবাই বলাবলি করছেন, তার মৃত্যুটা হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। ২৮ মার্চ জাহাজটি আবার যাত্রা শুরু করে। বসফরাস পেরিয়ে কৃষ্ণ সাগর হয়ে ৩০ মার্চ ইউক্রেনের ইউজনি বন্দরে নোঙর করে। পরে কসকো জানিয়েছে, ক্রুদের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
গত ২৭ মার্চ চীনের সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে পণ্যবাহী জাহাজ জি জেপট্রুড মায়েরসক এর কয়েকজন নাবিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। হংকং থেকে জাহাজটি চীনের নিংবো বন্দরে পৌঁছে ১৭ মার্চ। কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পর জাহাজ থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে নিংবো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পণ্যবাহী জাহাজে করোনা সংক্রমণের খবর এটিই ছিলো প্রথম। এরপর আরো কিছু খবর আসে। কিন্তু করোনাকালে অন্য পেশার লোকদের খবর যেভাবে আসছে, সে হিসেবে পণ্যবাহী নাবিকজীবন উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। অথচ বলা যায় পৃথিবীর অর্থনীতি টিকেই আছে এদের ওপর।
একটি উড়োজাহাজ কয়েকশ’ টন পণ্য উড়িয়ে নিতে পারে। অন্যদিকে একটি জাহাজ জলে ভাসিয়ে টানতে পারে হাজার হাজার থেকে কয়েক লাখ টন। এ কারণেই জাহাজে পরিবহন খরচ পড়ে কম। সাধারণত কিছু কৃষিপণ্য, কারখানার কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য জাহাজে করেই নেওয়া হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। এতে অন্য অনেক পেশার মতো ঝুঁকিতে পড়েছে নাবিকজীবনও। বিশ্বব্যাপী সমুদ্রগামী ৫০ হাজার ট্যাংকার ও কার্গো জাহাজের ১৬ লাখ নাবিকের জন্য তৈরি হয়েছে অনিশ্চিত পরিস্থিতি। এদের অনেকেই জাহাজের ডেকে প্রহর গুনছেন।
নিক চাব নামের জাহাজের এক সাবেক নেভিগেটর বলেন, জাহাজে কাজ করা মানে কারাগারে থাকা। কারাগারে টিভি দেখার সুবিধা আছে। জাহাজে এটাও নেই। চুক্তির মেয়াদ যখন শেষ হতে থাকে তখন নাবিকরা অস্থির হয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার জন্য মন আনচান করতে থাকে। একবার একটি তেলের ট্যাংকারের নাবিকদের সঙ্গে চার মাসের চুক্তিকে আরো তিন সপ্তাহ বাড়ানো হয়। এতেই গন্ডগোল লেগে যায়। করোনা পরিস্থিতির মুখে পড়ে অনেক নাবিক নিজেদের পরিবার থেকে নয় মাস দূরে আছেন বলেও জানান তিনি।
আরো কতদিন থাকতে হবে, সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। তারা কি মুক্ত থাকতে পারবেন এই ভাইরাস থেকে?
একটি জাহাজে সাধারণত ২৩-৩০ জন নাবিক থাকেন। পণ্য লোড করা থেকে শুরু করে খালাস করা পর্যন্ত এদের দায়িত্ব। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এদের চলতে হয় ঘড়ির কাটা আর সাগরের ঢেউকে সঙ্গে নিয়ে। সময় ও সাগর তাদের কাছে একঘেয়ে। দিন ও রাতের হিসাবে নেই বৈচিত্র্য। আবার কখনো নাবিকের কাছে সাগর মোহময়। কখনো সাগরের রুদ্ররুপও নাবিককে দিতে পারে নান্দনিক সুখ। নাবিক জাহাজ ভাসায়। অথই দরিয়া কখনো আলোর ঝলকানি দেখায়। অভিভাবদন জানায়। যখন বন্দর ঘনিয়ে আসে, দূরে দেখা যায় একটা রেখা।
ওই রেখাতেই দোলায়িত হন নাবিক। কোনো দেশের বন্দরে পৌঁছার অন্তত সাতদিন আগে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখেন ক্যাপ্টেন। বন্দরের জানা থাকে জাহাজের পরিচয়, বন্দরে পৌঁছানোর সময়, জাহাজে কী পণ্য আছে, নাবিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যসহ কিছু নথি।
বন্দরের কর্তৃপক্ষ যদি জাহাজটিকে নিরাপদ মনে করেন, তখনে নোঙর করার অনুমতি দেন। জাহাজ ভিড়ে বহিঃনোঙরে। সেখানে নাবিকদের সহযোগিতা করেন বন্দরের একজন। জাহাজ যখন জেটিতে ভিড়ে তখন আসেন এজেন্ট, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, স্বাস্থ্যকর্মী, সার্ভেয়ার আর পণ্য খালাসিরা।
এত লোকের সঙ্গে বিনিময় হয় নাবিকদের। এদের যে কেউ হতে পারেন করোনাভাইরাসের বাহক। কোনো খালাসির শরীর থেকে সংক্রমণ হতে পারে নাবিকের। তারপর সেই নাবিক থেকে অন্য নাবিকের। অতঃপর সাগর পাড়ি দিয়ে করোনাভাইরাস যেতে পারে অন্য কোনো বন্দরে। অথবা মধ্যসাগরে তৈরি হতে পারে হৃদয়ফাঁটা কোনো পরিস্থিতিও!