
চীনের স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে ‘রাজ্য পর্যায়ের শহর’গুলো একে উপরের ধাপে অবস্থান করে। এই শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে বেইজিং, সাংহাই, তিয়ানজিন ও চুংকিংয়ের মতো বিখ্যাত সব শহর। আয়তন, জনসংখ্যা ও গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে এই শহরগুলো বলতে গেলে প্রদেশগুলোর মতোই সুবিধা ভোগ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই শহরগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অনেক অভিজ্ঞ ও চৌকস রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে। চুংকিং একসময় সিচুয়ান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ১৯৯৭ সালে একে স্বতন্ত্র ‘রাজ্য পর্যায়ের শহর’ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ২০০৭-১২ সালের মধ্যে এই শহরের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন বো জিলাই। তার সময়ে বেশ কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, যেগুলোকে সামগ্রিকভাবে ‘চুংকিং মডেল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
২০০৭ সালে ১৭তম পার্টি কংগ্রেসে বো জিলাই’কে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চুংকিং শহর শাখার সম্পাদক ও পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। উক্ত পদগুলোতে নির্বাচিত হওয়ার আগে বো জিলাই একই শহরের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার পূর্বসুরী ওয়াং ইয়াংকে গুয়াংদং প্রদেশের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
প্রাথমিকভাবে বো জিলাই তার এই দায়িত্ব পাওয়ায় খুশি ছিলেন না বলে জানা যায়। কারণ তার পরিকল্পনা ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রবেশ করা। সেখানে একটি শহরের দায়িত্ব পাওয়ায় একে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের একটি ‘অবনমন’ হিসেবেই দেখেন তিনি। তারপরও যেহেতু তার উপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দায়িত্ব অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই তিনি তেমন কোনো বিরোধিতা করেননি। তিনি যে সময় চুংকিংয়ের দায়িত্ব লাভ করেন, তখন বায়ু দূষণ, উচ্চ অপরাধ হার, ধনী-দরিদ্রের সম্পদের পার্থক্য বেড়ে যাওয়া ও থ্রি জর্জেস বাঁধের জটিলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল শহরটি। সুতরাং তার দায়িত্ব ছিল বেশ কিছু সংস্কার এনে চুংকিংয়ের সমস্যাগুলো সমাধান করা।

দায়িত্ব পেয়ে সম্পাদক বো জিলাই যে সংস্কারগুলো গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলো বর্গীকরণ করলে ‘নয়া-বামপন্থী’ নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তিনি স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ব্যাপক আকারে উৎপাদনমুখী শিল্পের উপর জোর দিচ্ছিলেন, দরিদ্রদের আবাসনের সমস্যা দূর করতে সরকারি অর্থে বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। চীনে সেই সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে যখন হু জিনতাও এবং ওয়েন জিয়াবাওয়ের মাধ্যমে মাওবাদী নীতিগুলো থেকে সরে এসে বিভিন্ন উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করছিল, তখন বো জিলাইয়ের এইসব নয়া-বামপন্থী নীতিগ্রহণের সিদ্ধান্ত অবাক করেছিল অনেককেই৷
চুংকিং কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক বো জিলাই সামাজিক পর্যায়ে দুর্নীতি ও সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি যখন দায়িত্ব পান, তখন শহরে প্রচুর অপরাধ সংঘটিত হচ্ছিল। তিনি এর বিরুদ্ধে ‘স্ট্রাইক ব্যাক’ (দা হেই) ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এই ক্যাম্পেইনের মূল কথা ছিল অপরাধ কিংবা দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ পেলেই সাথে সাথে বিচারের মুখোমুখি করা। এই ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল শহরটির পুলিশ প্রধান ওয়াং লিজুংয়ের হাতে। ২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ৫,৭০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। অনেকে বলে থাকেন, নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একঘরে করে ফেলতে বো জিলাই এই ক্যাম্পেইনের সূচনা করেন। যা-ই হোক, এই ক্যাম্পেইনের ফলে চুংকিং শহরে অপরাধের হার অনেক কমে। এই ক্যাম্পেইনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে পুরো চীনজুড়ে বো জিলাইয়ের প্রশংসা করা হতে থাকে। চীনের অন্যান্য শহর ও রাজ্যেও এই ক্যাম্পেইন অনুসরণ করার দাবি উঠেছিল।

তবে কিছু ক্ষেত্রে বো জিলাইয়ের সমালোচনাও করা হয়। অনেকে বলতে শুরু করেন, বো জিলাই আইনের শাসন থেকে সরে এসেছেন। কারণ এই ক্যাম্পেইনের ফলে দেখা যাচ্ছিল অনেক ব্যক্তি বিচারের সঠিক ব্যবস্থা ব্যতিরেকেই শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছিল। প্রায় ১,০০০ মানুষকে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে বাধ্য করা হয় এই ক্যাম্পেইনের অধীনে। যেসব ক্ষেত্রে আইনজীবীরা অভিযুক্তদের সাহায্য করতে অগ্রসর হচ্ছিল, তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। একজন আইনজীবীকে আঠারো মাসের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়াও পুলিশের হেফাজতে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগও উত্থাপন করা হয় বিভিন্ন কেইসে। এছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের এই ক্যাম্পেইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ উত্থাপন করে তাদের সম্পত্তি জব্দ করা হয়, পরবর্তীতে সেগুলো বো জিলাইয়ের সামাজিক আবাসন প্রকল্পের অর্থায়নে সহযোগিতা করতে পারে।
বো জিলাইয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নীতি ছিল- তিনি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্র চীনা নাগরিকের তফাত কমিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। এই নীতিকে অনেকে ‘রেড জিডিপি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই নীতির অধীনে মৌলিক অধিকারগুলো ঠিকমতো ভোগ করা হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়৷ বো জিলাইয়ের পুরো শাসনকালে শহরে প্রায় ষোল বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল আবাসন খাতের জন্য। এই আবাসন প্রকল্পের পেছনে বো জিলাইয়ের যুক্তি ছিল শহরটির নাগরিকদের আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় থাকার জায়গার পেছনে। এই ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যদি আবাসন দেয়া যায়, তাহলে হয়তো তারা তাদের বাসস্থানের পেছনে ব্যয়ের অর্থটি অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে ব্যয় করে নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে পারবে। শহরের যেসব অধিবাসীর আয় তিন হাজার ইউয়ানের কম, তারা চাইলেই এই আবাসন প্রকল্পের অধীনে স্বল্পমূল্যে বাড়ি ভাড়া নিতে পারতো। এছাড়া তিন বছর ভাড়া করা সরকারি বাড়িতে থাকলে পরবর্তীতে বাড়ি কেনারও নিয়ম ছিল।
বো জিলাই ছিলেন শুদ্ধ মাওবাদী। তিনি চেয়ারম্যান মাওয়ের শাসনামলের অনেক সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটনা। বেশ কিছু ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তিনি দলবেধে জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত গাওয়া, ছাত্রদের গ্রামে গিয়ে অর্থনৈতিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করা কিংবা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যাবলি করতে উৎসাহ প্রদান করেন। চীনের ষাটতম স্বাধীনতা দিবসের পূর্বমুহূর্তে তিনি প্রায় দেড় কোটি মোবাইল ব্যবহারকারীর সেলফোনে লাল ফন্টের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। ২০১১ সালে শহরটির গণমাধ্যম বিভাগ ‘লাল সঙ্গীত ক্যাম্পেইন’ শুরু করে। এই ক্যাম্পেইনের অধীনে সকল প্রতিষ্ঠানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসামূলক গান বাজানো বাধ্যতামূলক করা হয়।

বো জিলাইয়ের এসব পদক্ষেপে সমাজের কিছু অংশের মানুষ অনেক খুশি হলেও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তার এসব নীতিতে মোটেও খুশি হয়নি। তার পুলিশ বাহিনী প্রায়ই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের উপর চড়াও হতো। ৫৭ বছর বয়সী একজন আইনজীবী ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন,
আমি লাল নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে শিক্ষকদের মার খেতে দেখেছি। এটি ছিল বেশ ভয়ানক। উপরমহল থেকে ক্যাম্পেইনগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হতো। ২০০৯ সালে একজন মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা আত্মহত্যা করেন, যার কারণ ছিল তাকে উপর থেকে কমিউনিস্ট ভাবধারার সঙ্গীত গাওয়ার জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দেয়া হচ্ছিল। বো জিলাইয়ের সমালোচকরা এসব নীতি প্রণয়নের কারণে তাকে ‘লিটল মাও’ হিসেবে ব্যঙ্গ করতেন।
চুংকিং শহরের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক বো জিলাইয়ের শেষটা হয়েছিল আরও খারাপ। তার পুলিশ চিফ আমেরিকান দূতাবাসে পালিয়ে গিয়ে তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। কীভাবে বো জিলাই একজন ব্রিটিশ নাগরিকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্তে হস্তক্ষেপ করেছিলেন– তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন সেই পুলিশ চিফ৷ একপর্যায়ে বো জিলাইকে চুংকিং শহরের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে তাকে পলিটব্যুরো থেকে সরানো হয়। তাকে প্রাতিষ্ঠানিক পদগুলো থেকে সরিয়ে দেয়ার পর তিনি যে নীতিগুলো অবলম্বন করছিলেন, তার প্রায় সবগুলোই রদ করা হয়।