Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন আছে আফ্রিকার শিশু সৈন্যরা?

আমি ও আমার বাবা ধানের চারা রোপণ করছিলাম। হঠাৎ রেভ্যলুশনারি ইউনাইটেড ফোর্সের সদস্যরা এসে আমাদের বন্দী করে। আমাকে মুক্তি দেয়ার জন্য বাবা করজোড়ে নিবেদন করেছিলেন তাদের কাছে, কিন্তু তারা কোনো কথাই শোনেনি। যেহেতু তারা আমাকে ছেড়ে দেবে না, তাই বাবা তাদেরকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তারা আমার বাবাকেই মেরে ফেলল।

উপরের কথাগুলো সিয়েরা লিওনের এক শিশু যোদ্ধার, যাকে ষোল বছর বয়সে সেখানকার মিলিশিয়া বাহিনীর কিছু সদস্য অপহরণ করে। পরবর্তীতে সে যোদ্ধা হিসেবে স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়। সিয়েরা লিওন নিয়ে আমরা বাংলাদেশিরা বেশ গর্ব করি। সেখানকার দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসেবে ‘বাংলা’ স্বীকৃতি পেয়েছে, আমাদের সৈন্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে সেখানে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে দুর্দান্ত ভূমিকা রাখছে– এসব কথা শুনলে আমাদের একধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ হয়। কিন্তু সেদেশেই যে অসংখ্য শিশু নিজেদের শৈশব বিসর্জন দিয়ে যোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত আছে– এ কথা আমাদের প্রায় সবারই অজানা।

হডওতজতকতক
আফ্রিকার অনেক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মিলিশিয়া বাহিনীগুলো নিয়মিত লোকালয়ে আক্রমণ চালায়; image source: rand.org

ইউরোপে কোনো শিশু হয়তো এই সময় টুকটাক পড়ালেখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে মহাতারকা হওয়ার স্বপ্নে ফুটবল একাডেমিতে সময় দিচ্ছে, এশিয়ার কোনো শিশু হয়তো স্কুল পর্যায়েই স্বপ্ন দেখছে কীভাবে তুখোড় গবেষণায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়া যায়, ওশেনিয়ার কোনো শিশু হয়তো মিচেল স্টার্ক কিংবা ট্রেন্ট বোল্টকে আইডল মেনে বলের পর বল করে যাচ্ছে নেটে, লাতিন আমেরিকার কোনো শিশু হয়তো এখনই সাহিত্যিক হিসেবে কীভাবে পৃথিবীকে কোনো ‘মাস্টারপিস’ উপহার দেয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। অথচ আফ্রিকায় এই সময় অনেক দেশেই গিয়ে দেখা যাবে কালাশনিকভ রাইফেল কাঁধে কোনো শিশু রণাঙ্গনে নিজের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছে। কিংবা কোনো কমান্ডারের পাশে দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োজিত আছে। বড় হয়ে গল্প করার মতো যে শৈশব, তা অনেক আফ্রিকান শিশুরই কপালে জোটে না।

আফ্রিকার অনেক দেশেই সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনীগুলো সেদেশের সরকারের বিরুদ্ধে কিংবা প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে যেসব মিলিশিয়া বাহিনী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় হতাহতের শিকার বেসামরিক মানুষজন। যেমন- উগান্ডার লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি বা এলআরএ-র কথাই ধরা যাক। এই সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনীর উত্থানের পেছনে উগান্ডা সরকারেরও দায় কম নয়। লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি প্রথমদিকে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও পরবর্তীতে উগান্ডার মানুষজন এই সশস্ত্র সংগঠনের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে শুরু করে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই পরাশক্তি বেশ কিছু মিলিশিয়া সংগঠনকে তহবিলের যোগান দিলেও পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তহবিলের যোগান বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দেখা গিয়েছিল যে গোষ্ঠীর মুক্তির জন্য তারা সংগ্রাম শুরু করেছিল, সেই গোষ্ঠীর অনেক সদস্যই পরবর্তীতে তাদের হাতে মারা পড়ে, অনেককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আফ্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে চোখের সামনে সহিংসতা দেখতে দেখতে।

ণাননসমামমাজাজ
আফ্রিকার অনেক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় মিলিশিয়া বাহিনীগুলো নিয়মিত লোকালয়ে আক্রমণ চালায়; image source: rand.org

কেন আফ্রিকার অসংখ্য শিশুকে যুদ্ধে মুখে ঠেলে দেয়া হয়? শিশুদের যুদ্ধ করার মতো শারীরিক সক্ষমতা কিংবা শক্ত মানসিকতা– কোনোটাই না থাকার পরও কেন বারবার তাদেরকেই মিলিশিয়া সংগঠনগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দেয়? এর পেছনে কারণ আসলে অনেকগুলো। যেকোনো মিলিশিয়া সংগঠনেই শিশুদের লালন-পালন করার খরচ অনেক কম। দেখা যায়, একজন সাধারণ পূর্ণবয়স্ক যোদ্ধার পেছনে মিলিশিয়া যত অর্থ খরচ করে, একজন শিশু যোদ্ধার পেছনে অনেক কম খরচ হয়। শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক বেশি সহজ, অস্ত্রের মুখে তাদেরকে যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করা যায়। পূর্ণবয়স্ক সৈন্যদের পরিবার থাকার কারণে তাদেরকে চাইলেও অল্প খরচে যুদ্ধের জন্য রাজি করা সম্ভব নয়। শিশু সৈন্যদের পরিবার থেকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়, অনেকে পরবর্তীতে সারাজীবনেও কখনও পরিবারের কথা মাথায় আনে না।

শিশু সৈন্যদের যুক্ত করার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে– যেকোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তাদেরকে সামনে এগিয়ে দেয়া যায়। শিশুদের চিন্তার গভীরতা থাকে কম, যেকোনো বিষয়ের আগপিছ না ভেবেই তারা সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য দেখা যায়, কোনো পূর্ণবয়স্ক সৈন্য হয়তো পরিবারের এবং নিজের কথা চিন্তা করে অপারেশনে একটু গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু শিশু সৈন্যদের ক্ষেত্রে সেটি হবে না। বয়সের দোষে তারা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায় কোনো বিপদের কথা চিন্তা না করেই। এছাড়া অনেক মিলিশিয়া বাহিনী তাদের শিশু সৈন্যদের মগজধোলাই করে, তাদেরকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে যুদ্ধের মাঠে লেলিয়ে দেয়। উগান্ডার লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি অপহরণের পর ছোট শিশুদের মগজ এমনভাবে ধোলাই করত যে, পরবর্তীতে তারা অস্ত্র নিয়ে তাদের বাবা-মাকে খুন করতে আসত!

এবার আসা যাক মিলিশিয়া বাহিনীগুলো কীভাবে শিশু সৈন্য সংগ্রহ করে, তা নিয়ে। প্রধানত অপহরণের মাধ্যমেই শিশু সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই খাবার ও অর্থ সংগ্রহের জন্য বেসামরিক এলাকাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় খাবার ও অর্থ তো তারা সংগ্রহ করে থাকেই, এর পাশাপাশি ছোট শিশুদের জোর করে বাবা-মায়েদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে তারা।

আরেকভাবে তারা শিশু সংগ্রহ করে থাকে। যেসব শিশুর বাবা-মা মিলিশিয়া বাহিনীর হয়ে কাজ করে, তারা ছোট থেকেই মিলিশিয়া বাহিনীর আদর্শগুলোর নিজের মধ্যে ধারণ করা শিখে নেয়। এই শিশুদের আসলে মগজধোলাই কিংবা অপহরণের প্রয়োজন পড়ে না, তারা স্বেচ্ছায় মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেয়।

তজচহচজআৃ
ছোট শিশুদের অপহরণ করার পর দেয়া হয় সামরিক প্রশিক্ষণ; image source: takepart.com

ছেলেদের পাশাপাশি এবার একটু মেয়েদের নিয়েও কথা বলা যাক। ছেলেদের অপহরণ করে এনে প্রশিক্ষণের পর সশস্ত্র সৈন্যে রূপান্তর করা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে কী ঘটে? উত্তর হচ্ছে, মেয়েদেরকে অপহরণ কিংবা জোরপূর্বক ধরে আনার পর স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা হয় কিংবা যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। এছাড়া রান্নাবান্নার কাজেও তাদেরকে নিয়োজিত করা হয়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দুর্ভোগ অনেক বেশি। পালিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে ছেলেরা অনেক সময় বাড়ি ফিরতে পারলেও মেয়েরা কখনোই আর বাড়ি ফিরতে পারে না। মিলিশিয়া বাহিনীর শিবিরে স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনো বালাই নেই, তাই অসংখ্য মেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

বর্তমানে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর চাপে অনেক সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী শিশু সৈন্যদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনছে। উগান্ডায় লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মিকে প্রায় ত্রিশ হাজার শিশু অপহরণের জন্য দায়ী করা হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, তাদের শিশু সৈন্যের সংখ্যা বর্তমানে কয়েকশো। এছাড়া দক্ষিণ সুদানের মিলিশিয়া বাহিনী এসপিএলএ গত কয়েক বছরে অনেক শিশু সৈন্যকে মুক্তি দিয়েছে। পুরো পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ শিশু সৈন্যই আফ্রিকায় বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনীর হয়ে কাজ করছে, যদিও দিন দিন এই সংখ্যা কমে আসছে। তবে যেসব শিশু সৈন্যকে মুক্তি দেয়া হয়, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে হয়। শিক্ষা ছাড়া মানসম্পন্ন জীবিকার্জনের উপায় নেই। এই শিশুরা তাদের শৈশবের বড় অংশ কোনো রকমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই পার করে ফেলে, যার প্রভাব পড়ে পরবর্তী জীবনে।

আফ্রিকার শিশু সৈন্যদের জীবন মোটেও আনন্দের নয়। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় তাদের। যে সময় তাদের বন্ধুবান্ধবের সাথে খেলাধুলা করে, স্কুলে বিশাল উৎসাহে পড়ালেখা করার কথা ছিল, সেসময়ে তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

Related Articles