Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে দেশে কোনো মশা নেই

পৃথিবীতে প্রাণীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। প্রকৃতিতে বিচিত্র সব প্রাণীর অস্তিত্ব দেখতে পাই আমরা। অসংখ্য প্রাণী আছে, যাদের আক্রমণাত্মক স্বভাব ও বিষাক্ততা অনেক সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী কোনটি?’, তাহলে সবাই হয়তো খুব বেশি না ভেবে কিছু বিষাক্ত প্রজাতির সাপ ও মাকড়সা, নরমাংসভোজী বাঘ কিংবা কুমিরের নাম বলতে পারেন। জানাশোনা আরেকটু বেশি থাকলে হয়তো সমুদ্রের ছদ্মবেশী ঘাতক স্টোনফিশ কিংবা সাগরের আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক বক্স জেলিফিশের নাম বলতে পারেন। কিন্তু সত্যি বলতে এদের কোনোটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী নয়। ‘হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা’র পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে ‘মশা’ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী। শুনতে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই?

জগলহলহল
মশা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীগুলোর একটি; image source: theconversation.com

আকারে ছোট্ট একটা প্রাণী, যেটি কামড়ালে ক্ষতস্থানে সামান্য চুলকানি ও ফোলা ছাড়া তেমন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই– এমন একটি প্রাণীকে যখন ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, তখন বিস্মিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, প্রতি বছর পুরো বিশ্বজুড়ে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে মশার কামড়ে। জিকা ভাইরাস, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, কিংবা ডেঙ্গু জ্বরের মতো অসংখ্য প্রাণঘাতী রোগের জীবাণু বহন করে মশা। কামড়ের ফলে এসব মানবদেহে প্রবেশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মশাবাহিত রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। মানবদেহ থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডে আকৃষ্ট হয়ে মশা তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। মাত্র তিন মিলিমিটারের একটি প্রাণী যখন লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই প্রাণীকে আর ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী’ না বলে উপায় আছে?

মজার বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর একটি দেশে কোনো মশা নেই। হ্যাঁ, আপনি ঠিক পড়েছেন, একটি মশাও নেই সেই দেশে। উত্তর ইউরোপের কয়েকটি দেশকে বলা হয় ‘নর্ডিক দেশ’। এই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইসল্যান্ড। এই দেশটি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশে একটি মশাও নেই। দেশটিতে সর্বশেষ মশা পাওয়া গিয়েছিল প্রায় চল্লিশ বছর আগে, যাকে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারের চিন্তার বিষয় হচ্ছে কীভাবে জনগণকে মশার প্রাণঘাতী কামড় থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু আইসল্যান্ড সরকারের এমন কোনো চিন্তা নেই, কারণ সেই দেশে কোন মশাই নেই! গত কয়েক দশকে মশার কামড়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে বেশ কয়েকবার মহামারী সৃষ্টি হয়েছিল আফ্রিকায় ও এশিয়ায়। এসব মহামারীতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়াও প্রতিবছর প্রায় সত্তর কোটি মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হন। সাধারণত গ্রীষ্মকালে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা বেড়ে যায়, কারণ উষ্ণ আবহাওয়ায় মশার বংশবৃদ্ধি বেশি হয়। আইসল্যান্ডে যেহেতু মশা নেই, তাই মশাবাহিত রোগের বিস্তার ঘটবে, এমন সম্ভাবনাও নেই।

হতেগেগপগ
আইসল্যান্ডে সর্বশেষ মশা পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮০ সালের দিকে; image source: businessinsider.com

আইসল্যান্ডে কোনো মশা নেই কেন– এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও উদ্ভাবন ঘটেনি, কিংবা এটি এমন কোনো রহস্যময় ঘটনাও নয়, যার রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। দেশটিতে কেন মশা নেই– এর পেছনে দুটো ব্যাখ্যা রয়েছে। একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়, আইসল্যান্ডের আবহাওয়া এত বেশি প্রতিকূল যে মশার টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই সেখানে। মশার বংশবৃদ্ধির জন্য কিছুটা উষ্ণতার প্রয়োজন হয়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, যেসব দেশের আবহাওয়ায় উষ্ণতা যত বেশি, সেসব দেশে মশার উৎপাত বেশি, মশাবাহিত রোগের সংক্রমণও বেশি। আফ্রিকা যেহেতু পৃথিবীর উষ্ণতম মহাদেশগুলোর একটি, তাই এই মহাদেশের সহায়ক আবহাওয়ায় মশার বংশবৃদ্ধি খুব বেশি হয়। মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপও বেশি দেখা দেয় এই মহাদেশে। আইসল্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এখানে বছরে তিনবার ভয়াবহ শীত নেমে আসে। শীতল আবহাওয়া যেহেতু মশার বংশবৃদ্ধির পক্ষে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে, তাই দেশটির বিরূপ আবহাওয়ায় মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে না।

এবার দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক। মশার বংশবৃদ্ধির জন্য জলাশয় দরকার হয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, আইসল্যান্ডের জলাশয়গুলোতে রাসায়নিক পদার্থের যে অনুপাত রয়েছে, সেটি মশার বংশবৃদ্ধি দারুণ কঠিন করে তোলে। এর পাশাপাশি বদ্ধ জলাশয়ের দরকার হয়, যেখানে স্রোত নেই। মশার ডিম থেকে লার্ভা, এরপর লার্ভা থেকে মূককীট, মূককীট থেকে পরিণত বাচ্চা– এই চক্রের জন্য সময় ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পাশাপাশি স্রোতহীন জলাশয়ের প্রয়োজন হয়। আইসল্যান্ডে স্রোতহীন বদ্ধ জলাশয়ের বেশ অভাব রয়েছে, তাই মশার বংশবৃদ্ধির পক্ষে কোনো যৌক্তিক কারণ খোঁজার অবকাশ নেই এই দেশে। এছাড়া প্রথম ব্যাখ্যা অনুযায়ী- যেহেতু দেশটিতে বছরে তিনবার ভয়াবহ শীত নেমে আসে, তাই জলাশয়গুলোর পানি তিনবার বরফে পরিণত হয়। ফলে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার যে চক্র, সেটি ব্যাহত হয়। এভাবে চরম প্রতিকূল পরিবেশে যে মশার বংশবৃদ্ধি হওয়া সম্ভব নয়, সেটি সহজেই অনুমেয়।

তইডওডওডআ
আইসল্যান্ডে এত বেশি শীত পড়ে যে, সেখানে মশার প্রজননের কোনো সম্ভাবনা নেই; image source: wakeupreykjavik.com

এবার মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, আইসল্যান্ডে প্রচন্ড শীতের কারণে যেহেতু মশা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না, তাহলে ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলোতে কীভাবে মশার অস্ত্বিত্ব আছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আইসল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী দেশ গ্রিনল্যান্ডের দিকে তাকালেই চলবে। গ্রিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে বলা যায়, যখন শীতকাল শুরু হয় দেশটিতে, তখন মশা শীতনিদ্রায় চলে যায়। এরপর যখন শীত শেষে বরফ গলা শুরু হয়, তখন মশা ডিম পাড়তে শুরু করে। আইসল্যান্ডের মতো এখানে শীত শেষ হওয়ার পর আবার হঠাৎ শীত নেমে আসে না, মোটামুটি ঋতুচক্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশ আইসল্যান্ডের তুলনায় উষ্ণতা বিরাজ করে। তাই এই দেশে মশা নিজের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর চক্র পূর্ণ হতে যে সময় দরকার, সেটি পেয়ে থাকে। এজন্য পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে আইসল্যান্ডে মশার বংশবৃদ্ধি না ঘটলেও ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য শীতপ্রধান দেশে মশার বংশবৃদ্ধি ঠিকই ঘটতে থাকে।

তবে আইসল্যান্ড ভবিষ্যতে ঠিক কতদিন ‘মশাবিহীন দেশ’-এর স্বীকৃতি ধরে রাখতে পারবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমরা সবাই বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচনার বিষয় ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’ সম্পর্কে অবগত। অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের ফলে প্রয়োজনের অধিক মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের জন্য বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। যে হারে এই নেতিবাচক বৈশ্বিক পরিবর্তন ঘটছে, তাতে যদি একসময় আইসল্যান্ডের আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে শুরু করে, গতানুগতিক বছরে তিনবার শীত নামার বদলে যদি উষ্ণতার আধিক্য দেখা দেয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীর বাকি সব দেশের মতো আইসল্যান্ডেও মশার প্রজনন শুরু হবে। মশার বংশবৃদ্ধি হওয়া মানে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ ঘটার সুযোগ তৈরি হওয়া। বর্তমানে মশার অনুপস্থিতিতে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ শূন্যের কোটায় থাকায় আইসল্যান্ডের সরকার কিংবা জনগণ যেভাবে নির্ভার রয়েছে, হয়তো একসময় এরকম নির্ভার থাকা হবে না।

Related Articles