Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চল: সোভিয়েত সামরিক সরঞ্জামের এক অদ্ভুত গোরস্থান

গোরস্থান বা সমাধিক্ষেত্র মানুষের জন‍্য– এটাই আমরা জানি। কিন্তু সামরিক সরঞ্জামের জন‍্যও যে পৃথিবীতে গোরস্থান আছে– এটা হয়তো আমাদের মধ‍্যে অনেকেই জানি না। বস্তুত বিশ্বে এরকম বেশ কিছু ‘গোরস্থান’ রয়েছে, যেখানে ব‍্যবহৃত ও পরিত‍্যক্ত সামরিক সরঞ্জামাদি ও যানবাহন রেখে দেয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ায় এরকম বেশকিছু ‘গোরস্থান’ রয়েছে। কিন্তু এদের মধ‍্যে খুবই অদ্ভুত একটি সামরিক সরঞ্জামের ‘গোরস্থান’ হচ্ছে ইউক্রেনের চেরনোবিলে অবস্থিত সোভিয়েত সামরিক যানবাহনের গোরস্থান!

চেরনোবিলে পরিত‍্যক্ত সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একটি ট‍্যাঙ্ক; Source: Wikimedia Commons

১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রের প্রিপিয়াত শহরের নিকটবর্তী চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এই দুর্ঘটনার ফলে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার কারণে প্রায় ১০০ মানুষ সরাসরি মৃত‍্যুবরণ করে এবং পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৯,০০০ থেকে ১৬,০০০ মানুষ মারা যায়। এদের মধ‍্যে প্রায় ৪,০০০ জন ছিল প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্র ইউক্রেন, বেলারুশ ও রাশিয়ার অধিবাসী এবং বাকি প্রায় ৫,০০০ থেকে ১২,০০০ জন ছিল ইউরোপের অন‍্যান‍্য রাষ্ট্রের অধিবাসী।

চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলে পরিত‍্যক্ত সোভিয়েত সামরিক যান; Source: Pinterest

চেরনোবিল দুর্ঘটনার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ চেরনোবিলের চারপাশের ১০ কি.মি. বিস্তৃত অঞ্চলকে ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ (exclusion zone) হিসেবে ঘোষণা করে এবং সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনী প্রিপিয়াত শহর ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে প্রায় ৪৯,০০০ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে এই নিষিদ্ধ অঞ্চলের পরিধি ৩০ কি.মি.–এ বর্ধিত করা হয় এবং আরো প্রায় ৬৮,০০০ মানুষকে ঐ অঞ্চলটি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার পর ১৯৮৬ সালের ৪ মে সোভিয়েতরা চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন‍্য সোভিয়েত প্রচুর হেলিকপ্টার ব‍্যবহার করেছিল; Source: Artificial Owl

১৯৮৬ সালের ২৭ এপ্রিল সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চল’ (Чернобыльская зона отчуждения, ‘চেরনোবিলস্কায়া জোনা আতচুঝদেনিয়া’) বর্তমানে ইউক্রেনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রশাসনিকভাবে অঞ্চলটি ইউক্রেনের কিয়েভ ও ঝিতোমির প্রদেশের অংশ এবং জনবিহীন অঞ্চলটির আয়তন প্রায় ২,৬০০ বর্গ কি.মি.। অঞ্চলটিতে মানুষের প্রবেশ এখনো বিপজ্জনক এবং অল্প কিছু কৌতূহলী পর্যটক ছাড়া আর কাউকে এখানে ঢুকতে দেয়া হয় না। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৬৫ সালের আগে এই অঞ্চলের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না।

মানচিত্রে ‘চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চল’ এবং পরিত‍্যক্ত প্রিপিয়াত শহর; Source: Wikimedia Commons

প্রিপিয়াত ছিল একটি পরিকল্পিত শহর এবং চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের জন‍্য এটি নির্মিত হয়েছিল। শহরটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ‘আদর্শ শহর’ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসতে চাইত। অথচ, এই শহরটি ভাগ‍্যচক্রে পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জনবিহীন ভূতুড়ে নগরীতে!

চেরনোবিল দুর্ঘটনাটি ছিল বহির্বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন‍্য খুবই লজ্জাজনক। এজন‍্য সোভিয়েত সরকার এই দুর্ঘটনাটি যত দ্রুত সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালায় এবং এজন‍্য প্রচুর অর্থ, জনবল ও সরঞ্জাম কাজে লাগায়। প্রায় ৫,০০,০০০ সোভিয়েত কর্মী (যাদের মধ্যে ছিল সোভিয়েত সৈন‍্য, পুলিশ, অভ‍্যন্তরীণ সৈন‍্য, বেসামরিক নিরাপত্তারক্ষী, অগ্নিনির্বাপক কর্মী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা) চেরনোবিল দুর্ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নেয় এবং এই দুর্ঘটনাটি মোকাবেলা করতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রায় ১,৮০০ কোটি সোভিয়েত রুবল (বা বর্তমান ৬,৮০০ কোটি মার্কিন ডলার) ব‍্যয় করতে হয়!

চেরনোবিলে পরিত‍্যক্ত সোভিয়েত সাঁজোয়া যান; Source: Artificial Owl

চেরনোবিল দুর্ঘটনা মোকাবেলার জন্য সোভিয়েতরা প্রচুর বাস, বুলডোজার, অ‍্যাম্বুলেন্স, দমকল যান এবং সশস্ত্রবাহিনীর ট‍্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান, ভারী ট্রাক, ট্রেন ও হেলিকপ্টার ব‍্যবহার করে। কিন্তু কাজ শেষে যখন এই যানবাহনগুলোকে গাইগার কাউন্টার দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, তখন দেখা যায় যে, এগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ মারাত্মক বেশি। বিশেষত প্রকাণ্ড আকৃতির মিল এমআই–৬ হেলিকপ্টারগুলোকে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আগুন নেভানোর কাজে ব‍্যবহার করা হয়েছিল এবং এগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ছিল খুবই বেশি। বলাই বাহুল্য, যেসব সৈন‍্য ও কর্মীরা দুর্ঘটনা মোকাবেলায় অংশ নিয়েছিল, তাদের শরীরেও মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল।

চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চল জুড়ে এরকম বহু পরিত‍্যক্ত সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে; Source: Artificial Owl

এমতাবস্থায় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এই যানবাহনগুলোর সংক্রমণমোচন (decontamination) করাতে গেলে আরো বহুসংখ্যক সোভিয়েত সৈন‍্য ও কর্মী তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হবে এবং এজন‍্য এগুলোকে তেজস্ক্রিয়তামুক্ত না করে চেরনোবিল অঞ্চলেই ফেলে রাখা উচিত। এরপর সোভিয়েতরা দুর্ঘটনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো যানবাহন ব‍্যবহার করে এবং একইভাবে সেগুলোও পরিত‍্যক্ত হয়।

এর ফলে হাজার হাজার টন অত‍্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পরিত‍্যক্ত হয়। অঞ্চলটি পরিণত হয় প্রচুর অত‍্যাধুনিক সোভিয়েত সামরিক যানের কবরস্থানে। এদের মধ‍্যে সর্ববৃহৎ হচ্ছে রাশোখা ‘সমরযান সমাধিক্ষেত্র’, যেটি চেরনোবিল বিদ‍্যুৎকেন্দ্রের ২৫০ কি.মি. দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থিত। কয়েক হাজার অত‍্যাধুনিক সোভিয়েত ট‍্যাঙ্ক, ভারী ট্রাক, সাঁজোয়া যান এবং হেলিকপ্টার এখানে পরিত‍্যক্ত অবস্থায় রয়েছে, যেগুলোর প্রত‍্যেকটিই অত‍্যন্ত তেজস্ক্রিয়।

রাশোখা ‘সমরযান সমাধিক্ষেত্রে’ প্রচুর পরিত‍্যক্ত ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার ও অন‍্যান‍্য সামরিক যানবাহন সারিবদ্ধ অবস্থায় সাজানো রয়েছে; Source: Artificial Owl

চেরনোবিলে সোভিয়েত সামরিক যানের আরেকটি বৃহৎ কবরস্থান হচ্ছে পরিত‍্যক্ত ‘বুরিয়াকিভকা’। গ্রামটি রাশোখার নিকটবর্তী। গ্রামটির একটি খোলা মাঠে পরিত‍্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ১,৩৫০টি সোভিয়েত সামরিক যান, যেগুলোতে এখন মরিচা ধরে গেছে। এই দুইটি স্থান ছাড়াও চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এরকম ছোট–বড় বেশ কিছু সামরিক যানের ‘কবরস্থান’ রয়েছে।

স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেন এই তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ যানবাহনগুলোকে ভেঙে মাটির নিচে পুঁতে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয় সরকার প্রচুর সময় ও অর্থ ব‍্যয় করেছে এবং ইউক্রেনীয় বিশেষজ্ঞরা চেরনোবিলে ব‍্যবহৃত ও পরিত‍্যক্ত সুবৃহৎ দমকল যানগুলোকে বড় বড় পরিখার মধ‍্যে ‘সমাধিস্থ’ করেছে। কিন্তু এরপরও চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা পরিত‍্যক্ত সামরিক সরঞ্জামাদি পুরোপুরিভাবে সরিয়ে ফেলতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বুরিয়াকাভকা গ্রামের নিকটে কয়েকটি পরিত‍্যক্ত সোভিয়েত সামরিক যান; Source: Wikimedia Commons

এর মধ‍্যে ভিন্ন ধরনের একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু লোক গোপনে এই নিষিদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করে পরিত‍্যক্ত যানবাহনগুলোর অংশবিশেষ (যেমন: ইঞ্জিন, হেলিকপ্টারের পাখা, ক‍্যাটালাইটিক কনভার্টার প্রভৃতি) খুলে নিচ্ছে এবং সেগুলোকে রিসাইকেল করে বাজারে বিক্রি করছে। এতে করে জনসাধারণের মধ‍্যে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনীয় অভ‍্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসবিইউ’ (Служба безпеки України, ‘স্লুঝবা বেজপেকি উক্রাইন’) চেরনোবিল নিষিদ্ধ অঞ্চলের কাছে একটি ট্রাকসহ ৬ জনকে আটক করে। ট্রাকটিতে সামরিক যন্ত্রাংশ ছিল যেগুলো চেরনোবিলের সামরিক যানবাহন ‘কবরস্থান’ থেকে চুরি করে নিয়ে আসা হয়েছিল। ‘এসবিইউ’ জানতে পারে, ইউক্রেনের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কিছু কর্মকর্তাও এই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত।

চেরনোবিলে বিক্ষিপ্তভাবে রেখে যাওয়া কিছু পরিত‍্যক্ত সোভিয়েত যানবাহন; Source: Shutterstock

ইউক্রেনীয় সরকার চেরনোবিল থেকে সমস্ত পরিত‍্যক্ত সামরিক সরঞ্জামাদি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এই কাজ এখনও অসমাপ্ত রয়েছে। এদিকে ইউক্রেনীয় সরকার চেরনোবিলকে একটি পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ প্রচুর মানুষ, বিশেষত অ‍্যাপোক‍্যালিপ্টিক ফিকশনের ভক্ত তরুণ–তরুণীরা, মানব ইতিহাসের অন‍্যতম বিপর্যয়ের এই স্থানটি নিজের চোখে দেখতে আগ্রহী। তাই কারো যদি সোভিয়েত সামরিক সরঞ্জামাদির এই অদ্ভুত গোরস্থানটি নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে থাকে, তিনি বর্তমান করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ইউক্রেনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যেতে পারেন!

Related Articles