আফ্রিকা মহাদেশের সুবিস্তৃত সাভানার জিম্বাবুয়ে অংশের মহারাজা ছিল সেসিল (Cecil)। রাজকীয় কেশর আর আকৃতির বিশালতার কারণে সে ছিল হুয়াঙ্গে ন্যাশনাল পার্কে আগত দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বনের অন্যান্য জীবজন্তু ক্যামেরা দেখলে যেমন পালিয়ে যায়, সে ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্যামেরার সামনে তার স্বাচ্ছন্দ্য ভাবভঙ্গি দেখে এক মহাতারকা বলে মনে হতো। দর্শনার্থীদের গাড়ি যতই কাছে যাক না কেন, সে ছিল মানুষের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত। কিন্তু ২০১৫ সালে মোহনীয় এই প্রাণীকে হত্যা করা হয়, একজন শিকারীর শখ পূরণের জন্য।
আমেরিকান ডেন্টিস্ট ওয়াল্টার পালমার অবসরে দেশ-বিদেশ ঘুরে বন্যপ্রাণী শিকার করা উপভোগ করেন। তার বরাবর ইচ্ছা ছিল আফ্রিকার বড় বিড়াল শিকার করা। সেই ইচ্ছা পূরণে তিনি পা রাখেন জিম্বাবুয়ের মাটিতে। কারণ সেখানে বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণী শিকার করা বৈধ। শুরু থেকেই তার চোখ ছিল সেখানকার সবচেয়ে বড় সিংহ সেসিলের দিকে। ২০১৫ সালের ১ জুলাই ওয়াল্টার ও তার সহযোগীরা গোটা একটি হাতির মৃতদেহ দিয়ে ফাঁদ পেতে সেসিলকে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে পাঁজরে তীর বিদ্ধ সেসিল ১০ ঘন্টা ধরে অসহনীয় মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। অন্যদিকে সেসিলের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করলেও আদতে তার হত্যাকারীদের তেমন কাউকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
তবে সেসিলের মৃত্যুর ঘটনাটি একক নয়। বরং প্রতিবছর পৃথিবীব্যাপী সিংহসহ বিভিন্ন প্রজাতির লক্ষাধিক বন্যপ্রাণী শিকারের নামে হত্যা করা হয়। আর বিনোদনের নামে বন্যপ্রাণী হত্যার প্রথা ট্রফি হান্টিং (Trophy Hunting) নামে পরিচিত। এখানে ট্রফি তথা পুরস্কার দ্বারা উদ্দেশ্য শিকারকৃত বন্যপ্রাণীর শরীরের যেকোনো অংশ। মূলত বিনোদন বা শখের বশে বন্যপ্রাণী শিকার করাকে ট্রফি হান্টিং বলে। ট্রফি শিকারীরা সাধারণত বন্যপ্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন- মাথা, চামড়া, শিং ও দাঁত ইত্যাদি সংগ্রহ করে পরবর্তীতে নিজেদের বীরত্ব ও সফলতার ট্রফি হিসেবে প্রদর্শন করে। ট্রফি শিকারীদের কাছে শিকারের জন্য আফ্রিকার বিগ ফাইভ নামে পরিচিত সিংহ, মহিষ, হাতি, চিতাবাঘ ও গন্ডার এই পাঁচ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বেশি জনপ্রিয়।
ট্রফি হান্টিং বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্য অভিশাপস্বরূপ হওয়ার পাশাপাশি মানুষের অসুস্থ বিনোদন প্রিয়তার বহিঃপ্রকাশ। এতদসত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপের বহু দেশের সরকার ট্রফি শিকারকে বৈধতা দিয়েছে। মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো ঐ সকল ধনী দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আফ্রিকার অনেক দেশ, যেমন- দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া ও বতসোয়ানা নিজেদের মাটিকে ট্রফি হান্টিংয়ের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। ট্রফি হান্টিং হলো মিলিয়নিয়ারদের শখের খেলা। তবে বর্তমানের পুঁজিবাদী বিশ্বে ধনীদের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ট্রফি শিকারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বর্তমানে এটি একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। তবে ট্রফি হান্টিং আধুনিক যুগে সৃষ্ট নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং এর ইতিহাস মানবজাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে যুক্ত।
পূর্ববর্তী যুগের রাজ-রাজড়ারা নিয়মিতই শিকার অভিযানে বের হতেন। সেই সব অভিযানে শিকারকৃত বন্যপ্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে মাথা ও চামড়া রাজাদের রাজদরবার ও প্রসাদের শোভা বৃদ্ধি করতো। এছাড়া অবসর কাটানোর পাশাপাশি বাঘ, সিংহ কিংবা হাতির মতো বৃহদকায় প্রাণী শিকার করা ছিল বড় বীরত্বের ব্যাপার। তবে বর্তমানে রাজাদের রাজকীয় কার্যকলাপ নেই ঠিকই, কিন্তু মানুষের মনে রাজকীয় শোভা ও আভিজাত্য দিয়ে নিজের বাড়ি সাজানোর আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেছে। সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে বর্তমানের ট্রফি হান্টিংয়ের সৃষ্টি। তবে অতীতের শিকার অভিযান এবং আধুনিক যুগের ট্রফি হান্টিংয়ের মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রথাগত পার্থক্য রয়েছে।
ট্রফি হান্টিংয়ের আধুনিক যুগের সূচনা হয় ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে। ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রাথমিক যুগে স্থানীয় জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তাদের সামনে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে গিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। সেই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি ছিল নির্বিচারে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী হত্যা করা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐ বন্যপ্রাণীগুলো ছিল স্থানীয় জনগণের নিকট শক্তি, সামর্থ্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক। এমনকি অনেক গোষ্ঠীর ধর্মীয় উপাসনার উপজীব্য ছিল এরা। ইউরোপীয়রা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছিল কিনা বলা মুশকিল। তবে তাদের গৃহীত বর্বর পদ্ধতির ফলে এক ব্যতিক্রমী বিনোদন প্রথার সূচনা হয়।
তবে ইউরোপ থেকে আগত সকলের পক্ষে বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণী শিকার সম্ভবপর ছিল না। বরং ইউরোপীয় অভিজাতদের পক্ষেই সম্ভব ছিল ট্রফি হান্টিংয়ের জন্য দীর্ঘদিন বনজঙ্গলে ভ্রমণ করার ব্যয়ভার বহন করা। পরবর্তীতে ইউরোপের অভিজাত সমাজে ট্রফি হান্টিং একটি রোমাঞ্চকর খেলায় পরিণত। তারা আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়ার উপনিবেশগুলো ভ্রমণ করার সময় একবার হলেও চাইতো সেই রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে। এমনকি বন্ধু মহলে বড়াই করার জন্যও অনেকে ট্রফি শিকার করতো। ফলশ্রুতিতে উপনিবেশগুলোতে অভিজাত ইউরোপীদের আগমনের সাথে সাথে শিকারের নামে বন্যপ্রাণী হত্যার পরিমাণ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন নাগাদ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ট্রফি হান্টিংকে কেন্দ্র করে রীতিমতো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সেবা খাত চালু হয়ে যায়। আফ্রিকায় বসবাসরত কিংবা ইউরোপ থেকে আগত ইউরোপীয়দের মধ্যে যারা ট্রফি শিকারে আগ্রহী ছিল, তাদের জন্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা তথা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অভিজ্ঞ গাইড, আরামদায়ক যাতায়েত ব্যবস্থা, ভ্রমণের রসদ থেকে শুরু করে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী সদা প্রস্তুত থাকতো। যাতে ঐ অভিজাত ট্রফি শিকারীরা কোনো রকম অসুবিধার সম্মুখীন না হয় এবং সফর শেষে তারা যেন তাদের পছন্দের বন্যপ্রাণী শিকার করতে পারে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে ট্রফি হান্টিং এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক শিকারের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু হয়।
ইউরোপীয়রা শিকার করতো বিনোদনের জন্য। শিকারকৃত পশু খাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। অন্যদিকে স্থানীয়রা শিকার করতো জীবনধারণের জন্য। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারগুলো যখন ট্রফি হান্টিংয়ের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে তখন তা উল্টো স্থানীয় শিকারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যেমন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কাশ্মিরে সকল ধরনের শিকারীদের সরকারি লাইসেন্স সংগ্রহ আবশ্যক করা হয়। কিন্তু সেই লাইসেন্স সংগ্রহে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হতো তা ছিল স্থানীয় জনগণের নাগালের বাইরে। একইভাবে পশ্চিম আফ্রিকার কেনিয়ায় শুধু আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে শিকারের অনুমতি প্রদান করা হতো। ফলে স্থানীয় জনগণের পক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের সুযোগ না থাকায় তারা চরম বৈষম্যের শিকার হতো। আধুনিক যুগে এসেও সেই বৈষম্য বিদ্যমান। তবে বর্তমানে এসে সেই বৈষম্যের ধারা অব্যহত থাকলেও ট্রফি হান্টিংয়ের রূপ বিকাশ লাভ করেছে।
টাকায় বাঘের দুধ মেলে; বাংলায় প্রচলিত এই বাগধারার বাস্তব রূপ হলো ট্রফি হান্টিং। অতীতে পৃথিবীতে টাকাওয়ালাদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বদৌলতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর শহরে শহরে শত শত মিলিয়নিয়ার পাওয়া যায়, যারা বিনোদনের জন্য কয়েক হাজার ডলার খরচ করাকে কিছু মনে করে না। এমনকি তাদের জন্য রয়েছে ট্রফি হান্টিং প্যাকেজ। ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার ডলার খরচ করলেই বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, হরিণ, জেব্রা, বন্য শূকর ও জিরাফের বন্যপ্রাণী শিকার করা সম্ভব। তবে সিংহ শিকার করতে ৯ থেকে ৬০ হাজার ডলার খরচ করতে হয়। অন্যদিকে বিলুপ্তপ্রায় গন্ডার শিকারে গুনতে হয় সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ২৫ হাজার ডলারের বেশি। তবে অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি ট্রফি শিকার করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু অনেকে সেই পরিমাণ সময় ব্যয় করতে চায় না।
পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে যারা পশুদের নির্দিষ্ট একটি বেষ্টনীর ভিতর আটকে রেখে কোনো রকম পালানোর সুযোগ না দিয়ে শিকার করে আনন্দ পায়। একইসাথে সেই পশু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিংহ, শিকারের কৃতিত্ব দাবি করে। বিনোদনের নামে বন্যপ্রাণীদের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে হত্যা করার বর্বর রীতি হলো ক্যান্ড হান্টিং (Canned Hunting)। এটি ট্রফি হান্টিংয়ের নিষ্ঠুরতম রূপ। এই রীতি ব্যবহার করে বন্যপ্রাণী শিকার করা অধিকাংশ ব্যক্তি অনভিজ্ঞ শিকারী। মূলত তারা একজন আসল ট্রফি শিকারীর মতোই বন্যপ্রাণী শিকারের তথাকথিত রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চায়। কিন্তু দিনের পর দিন সেই ট্রফির জন্য বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর ধৈর্য্য বা সময় তাদের নেই। তাই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাদের জন্য ক্যান্ড হান্টিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। আর ঐ সকল প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ সময় বন্যপ্রাণী সংগ্রহ করে থাকে বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রগুলো থেকে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় ১৬০টি সিংহ প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। সেই কেন্দ্রগুলোতে দেখা মিলে ছোট্ট সিংহ শাবক থেকে শুরু করে অনেক প্রাপ্তবয়স্ক বৃহদকায় সিংহের। সেখানে দর্শনার্থীদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানেন না সেই প্রজনন কেন্দ্রগুলোর অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে। কারণ এগুলো থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্যান্ড হান্টিংয়ের জন্য সিংহ সরবারহ করা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান এই বর্বর শিকার রীতি পরিচালনা করে তাদের রয়েছে বিশেষ ওয়েবসাইট। এটা অনেকটা অনলাইন শপিংয়ের মতো। ওয়েবসাইটে ছবি দেখে পছন্দমতো সিংহ অর্ডার করার পর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেখে অর্ডারকৃত সিংহটিকে একটি সীমাবদ্ধ এলাকায় শিকার তো সময়ের ব্যাপারমাত্র। কারণ সিংহটির পলায়ন করা তো দূরের কথা, লুকানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।
ট্রফি হান্টিং হোক কিংবা ক্যান্ড হান্টিং, একজন শিকারীর জন্য পশু শিকার করা যথেষ্ট নয়। বরং সে চায় তার শিকারকৃত পশুটির নির্দিষ্ট একটি অংশ নিজের সাথে নিয়ে যেতে। সাধারণত শিকারের পর পশুর শরীরের বাছাইকৃত অংশ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ প্রক্রিয়াজাত (Taxidermy) করা হয়। অতঃপর প্রক্রিয়াজাতকৃত অংশগুলো নিজের সাথে নিয়ে যায় ট্রফি শিকারীরা। এক্ষেত্রে পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৫-১৪ সাল পর্যন্ত দেশটির ট্রফি শিকারীরা ১২শ প্রজাতির ১২ লক্ষ ৬০ বন্যপ্রাণী হত্যা করা হয়েছে ট্রফির জন্য। এর মধ্যে ২ লক্ষ ছিল বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বন্যপ্রাণী। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক গুণ পিছিয়ে থাকলেও জার্মানি, স্পেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকার ট্রফি শিকারীরাও এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ট্রফি শিকারীদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হলো কানাডা। পাহাড়ি সিংহ, মুস, এল্ক, হরিণ, ভাল্লুকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার শিকারী সেখানে যায়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত ট্রফির প্রায় অর্ধেক এসেছে কানাডা থেকে। অন্যদিকে আফ্রিকার বিগ ফাইভ শিকার করা আরও বড় কৃতিত্বের ব্যাপার। তবে এর জন্য অবশ্যই আফ্রিকায় যেতে হবে। আর আফ্রিকায় ট্রফি শিকারীদের প্রধান গন্তব্য হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ঐ দেশে বিগ ফাইভের পাশাপাশি জেব্রা, জিরাফ, ইমপালা, বাবুন, কুমির, জলহস্তীসহ অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী শিকার করা হয়। এছাড়া নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী শিকার করা হয়। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতে ট্রফি হান্টিং সফলতার সাথে টিকে ছিল। তবে স্বাধীন ভারতে ১৯৭২ সালে এই বর্বর বিনোদন প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
বর্তমানে ট্রফি হান্টিং ব্যক্তিগত শখ পূরণের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক খেলায় রূপ নিয়েছে। শিকারীদের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নামিদামি ট্রফি হান্টিং ক্লাব। এদের মধ্যে সাফারি ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ও ডালাস সাফারি ক্লাব অন্যতম। এই ক্লাবগুলো ট্রফি শিকারীদের আইনি সহায়তা থেকে শুরু করে একদম মাঠপর্যায়ের কাজেও সহযোগিতা করে। বর্তমানে সাফারি ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজার। এই ক্লাবগুলো শিকারীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন ও পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি নিজস্ব রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে ট্রফি শিকারীরা তাদের কর্মকান্ডকে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্য উপকারী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালায়। যেমন, ২০১৫ সালে নামিবিয়ায় একজন শিকারী বিলুপ্তপ্রায় একটি গন্ডার শিকার করতে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার প্রদান করেছিল। তার মতে তার আসল উদ্দেশ্য উক্ত অর্থ দিয়ে প্রজাতিটি রক্ষা করার ব্যবস্থা করা।
আফ্রিকা মহাদেশের সুবিস্তৃত সাভানার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের ভূমিকা বিশাল। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐ অঞ্চলের বিচিত্র সব প্রাণী দেখতে হাজির হয়। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারগুলো সেই প্রাণীদের শিকার করার অনুমতি দেয়। কিন্তু এজন্য কয়েক গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থ দেশগুলোতে অবস্থিত সাফারি পার্কসমূহ পরিচালনা, পশুপাখি চোরাচালান রোধ এবং পার্কগুলোর আশেপাশে বসবাসরত স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু দেশগুলোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণে সেই অর্থ সঠিক খাতে ব্যয় হয় না। তবে ট্রফি হান্টিংয়ের গুনকীর্তন করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু আসল কথা হলো- বন্যপ্রাণী হত্যার ফলে জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি সাধিত হয় তা কি কাগজের টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব?
ট্রফি শিকারীরা সবসময় চায় যেকোনো প্রজাতির সবচেয়ে বড় প্রাণীটি শিকার করতে। যেমনটি ঘটেছিল সেসিলের ক্ষেত্রে। এছাড়া লম্বা দাঁতের হাতি কিংবা লম্বা শিংয়ের গন্ডারের প্রতি তাদের আগ্রহ নেহাত কম নয়। কিন্তু এর চেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী শিকারে তাদের চিন্তাভাবনা। কারণ, যখন কোনো প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির পথ ধরে, তখন তারা উঠেপড়ে লাগে সেই প্রাণী শিকার করতে। যাতে বিলুপ্ত হওয়ার আগেই শিকারকৃত প্রাণীর তালিকায় ঐ প্রজাতির প্রাণীর নাম ওঠানো যায়। অর্থাৎ সারা পৃথিবী যেখানে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী রক্ষায় এগিয়ে আসছে, তখন ট্রফি শিকারীরা ব্যস্ত নিজেদের তালিকা সমৃদ্ধ করতে।
তবে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার চেয়েও অধিক ভয়ানক হলো ট্রফি শিকারীদের মানসিকতা। যদিও শিকার করার পর শিকারকৃত প্রাণীটির মৃতদেহ সাথে নিয়ে ছবি তোলা তাদের জন্য সাধারণ বিষয়। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়টি অসাধারণ করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার এমন কাজ করে থাকে যা একজন বিবেকবান মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমন- একজন ট্রফি শিকারী একটি জিরাফ হত্যার পর সেই জিরাফের হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে তোলা ছবি পশুপাখি প্রেমিদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে, বেশিরভাগ ট্রফি শিকারী অপেশাদার ও অনভিজ্ঞ। ফলশ্রুতিতে তাদের শিকার করা প্রাণী তাদেরই অনভিজ্ঞতার কারণে বেশি কষ্ট পেয়ে মারা যায়।
এতকিছুর পরও ট্রফি হান্টিং রোধ করতে দায়িত্বশীল সরকারগুলো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আইন প্রণয়ন ছাড়া তেমন কিছুই করেনি। তবে সত্য বলতে এই বর্বরতা যদি আইন করে সর্বত্র নিষিদ্ধ তাতেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ এটি মাদকের মতোই এক নেশা। যদিও সেই নেশায় আসক্তদের সংখ্যা ধনীদের মধ্যে সীমিত। তবে মাদক যেমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাজারে সয়লাব, তেমন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ট্রফি শিকারীরা এদের শিকার চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গোপনে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে নিজেদের কৃতিত্বের প্রদর্শনীর জন্য। তবে এভাবে চলতে থাকলে যে হারে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাবে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে গরু, ছাগল, ভেড়া আর মুরগির মতো হাতে গোনা কয়েকটি প্রজাতির প্রাণী ছাড়া কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।
সুতরাং অতি শীঘ্রই ট্রফি হান্টিং সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং অন্যকেও সচেতন করতে হবে। যারা ট্রফি শিকারে আগ্রহী তাদের মনে মনুষ্যত্বের চেতনার সঞ্চার করতে হবে। ট্রফি হান্টিং হোক কিংবা বুল ফাইটিং, কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া কিংবা হত্যা করা মনুষ্যত্বের চোখে বিনোদন হতে পারে না। এছাড়া এই পৃথিবীতে মানুষ একা বাস করে না। বরং তার সাথে আরো অনেক অংশীদার আছে যারা সহিংসতা নয় সহাবস্থানের দাবিদার। আর এই সহাবস্থানের চেতনাই পারে মানুষ নামক খামখেয়ালি প্রাণীর হাত থেকে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে।