এত ছোট ছোট একেকটা ভিডিও যে, সেগুলোকে শর্ট-ফিল্ম বললেও শর্ট-ফিল্ম কথাটার অপমান হবে। অথচ সেগুলোই কিনা হাইলাইটেড হচ্ছে একটি বিশ্বখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপের ‘হটেস্ট ভিডিও’ হিসেবে।
বুঝতেই পারছেন, কথা হচ্ছে টিকটকের ব্যাপারে।
কোটি কোটি শর্ট ভিডিও ক্লিপের আখড়ায় পরিণত হয়েছে টিকটক। সেগুলোতে বুঁদ হয়ে তরুণ প্রজন্ম তো নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেই, সেই সঙ্গে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে সিলিকন ভ্যালির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের। এত দ্রুতগতিতে চারা গাছ থেকে মহীরূহে পরিণত হয়েছে অ্যাপটি যে, তা বিস্ময় উদ্রেক ঘটিয়েছে অন্য সব প্রতিযোগীদের মনেও। চোখের পলকে বিজ্ঞাপনী ডলারের একটা বড় অংশ নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে এই অ্যাপ।
একই ঘরানার অন্য অনেক অ্যাপই এখন টিকটকের দেখানো পথে হাঁটছে। রি-রাইট করে টিকটকের আঙ্গিকে ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেদের। তবে টিকটকও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ই-কমার্স দুনিয়ায় তাদের আগমনের ফলে খোলনলচে বদলে যেতে পারে ওই ইন্ডাস্ট্রির চেহারাও।
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সরকারের টিকটককে নিয়ে টেনশন অবশ্য অন্য জায়গায়। চীন থেকে উঠে আসা প্রথম ভোক্তামুখী অ্যাপ যখন বেইজিংয়ের গর্বের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গার রাজনীতিবিদরা তখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আশঙ্কা করছে, টিকটকের চীনা মালিকানা তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে না তো! তাদের ভয়, ব্যবহারকারীদের সংবেদনশীল, গোপনীয় তথ্য হয়তো চলে যাবে ভুল লোকের হাতে; কিংবা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু একটু করে পরিবর্তন আনতে তৎপর হবে চীনা প্রোপাগান্ডিস্টরা।
প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যেই ভারত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে টিকটক। যুক্তরাষ্ট্র এখনও অমন চরম পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও, সম্ভাব্য অনেকগুলো করণীয় বিষয়কেই বিবেচনাধীন রেখেছে।
অথচ, বর্তমান বিশ্বকে শাসন করছে যে টিকটক, তার পথচলা মোটেই খুব বেশিদিন আগে নয়।
যেভাবে শুরু
মাত্র বছর দশেক আগে, ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড়, বইপড়ুয়া চীনা উদ্যোক্তা ঝাং ইয়েমিং প্রতিষ্ঠা করেন বাইটডান্স নামের একটি সফটওয়্যার ফার্ম। সেই ফার্মের গোড়ার দিককার সৃষ্টিগুলোর একটি ছিল নেইহান দুয়ানজি (ইনসাইড জোকস), যে প্ল্যাটফর্মে হাস্যরসাত্মক গ্যাগ শেয়ার করা যেত; এবং ছিল তৌতিয়াও (হেডলাইন্স) নামের একটি নিউজ অ্যাগ্রেগেটরও। অ্যাপ দুটো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করত ইউজাররা কোন ধরনের স্কেচ বা স্টোরি পছন্দ করে। সে অনুযায়ী একেকজন ইউজারের সামনে স্কেচ ও স্টোরি হাজির করত তারা। এভাবে ব্যবহারকারীদের মন জুগিয়ে চলতে পারায় সাফল্যের দেখা পায় অ্যাপ দুটো। আজ তো ৩৬০ মিলিয়ন ইউজার নিয়ে তৌতিয়াও গোটা চীনের বৃহত্তম নিউজ অ্যাগ্রেগেটর সার্ভিস।
এই দুই অ্যাপের সাফল্যের পর থেকেই ঝাং চিন্তাভাবনা করছিলেন, তিনি তার অ্যালগরিদম নিয়ে আর কী করতে পারেন। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে বাইটডান্স রিলিজ করে দৌইন (শেকিং সাউন্ড) নামের একটি অ্যাপ, যা দিয়ে লিপ-সিঙ্ক রেকর্ড ও শেয়ার করা যায়। দৌইন মূলত নির্মিত হয়েছিল আরেক চীনে-নির্মিত লিপ-সিঙ্ক অ্যাপ মিউজিকাল.লি’র আদলে, যেটি ততদিনে আমেরিকান তরুণদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। তবে বাইটডান্সের নিজস্ব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিসকভারি ইঞ্জিন ওই পুরনো মডেলকেই এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ফলে দৌইনও হিট হয়ে যায়।
এর পরের বছর বাইটডান্স চীনের বাইরে দৌইনের একটি টুইন অ্যাপ রিলিজ দেয়। নতুন অ্যাপের ইন্টারফেস ও অ্যালগরিদম ছিল দৌইনের মতোই, কিন্তু কনটেন্ট ছিল আলাদা। আবার দৌইনেরই লোগো ব্যবহার করে অ্যাপটি, কিন্তু নামকরণ হয় নতুন: টিকটক।
শুরুর দিকে অবশ্য এশিয়ার বাইরে তেমন একটা পরিচিতি পায়নি টিকটক। কিন্তু ২০১৭ সালে মিউজিকাল.লি কিনে নেয় বাইটডান্স, এবং অচিরেই মিউজিকাল.লি’র ১০০ মিলিয়ন ইউজার ট্রান্সফার করে নেয় টিকটকে। সেই থেকে টিকটকের বেড়ে ওঠার সূচনা, এবং সেই প্রবৃদ্ধি অভূতপূর্ব। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে, যখন টিকটকের বয়স মাত্র চার বছরের একটু বেশি, তখনই তারা ছুঁয়ে ফেলে এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীর মাইলফলক। এই মাইলফলকে পৌঁছাতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের সময় লেগেছিল আট বছর। অবশ্য এটাও ঠিক যে আগে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ছিল ঢের কম। তবে সে যা হোক, ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকেই টিকটক হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোডকৃত মোবাইল অ্যাপ। দিন দিন ফেসবুকের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ পড়তির দিকে থাকলেও, টিকটকের প্রতি তাদের ভালোবাসা এখনও রয়েছে অটুট, কিংবা বলা চলে ক্রমবর্ধিষ্ণু। ডেটা কোম্পানি ইমার্কেটারের বিশ্বাস, টিকটকের ৪৪ শতাংশ ইউজারেরই বয়স ২৫-এর নিচে, যেখানে ফেসবুকের একই বয়সসীমায় ব্যবহারকারী মাত্র ১৬ শতাংশ।
কেন এত জনপ্রিয় টিকটক?
ফিল্ম তৈরিকে বড্ড সহজ করে তুলেছে টিকটক। এক দশক আগে ইনস্টাগ্রাম যেভাবে ফটো-এডিটিংয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল, ভিডিও-এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে ঠিক একই কাজই করেছে টিকটক। নিতান্ত অ্যামেচার মানুষজনও এখন হাতে মোবাইল থাকলে দুর্দান্ত সব ফিল্ম তৈরি করতে পারছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, টিকটকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ডিসকভারি অ্যালগরিদমের বদৌলতে অজানা-অপরিচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও অনায়াসে ভাইরাল হয়ে যেতে পারছে, যা ফেসবুকে তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। তাই তো ফেসবুকের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টগুলো বিভিন্ন অ্যাথলেট, সঙ্গীতশিল্পী বা অন্যান্য অঙ্গনের সেলিব্রিটিদের; অথচ টিকটকে যারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, তাদের পরিচয় তারা কেবলই টিকটকার। এখানে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন খাবি লেম নামের একজন সেনেগালিজ সাইলেন্ট কমিক, যার ফলোয়ার সংখ্যা এখন ১৫০ মিলিয়ন ছুঁই ছুঁই করছে।
টিকটকে ভিডিও দেখাও খুব সহজ। অন্য অধিকাংশ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে যেখানে ব্যবহারকারীর নিজের বন্ধু নেটওয়ার্ক থেকে নানা কনটেন্ট রিকমেন্ড করা হয়, সেখানে টিকটকে এমন কোনো নেটওয়ার্কেরই প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি কিছু লিখে সার্চ দেওয়া বা লগইন করাও লাগে না।টিকটকের রয়েছে বিশাল আর্কাইভ, আর দারুণ শক্তিশালী অ্যালগরিদম। এই দুইয়ের সহযোগে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রত্যেক ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ-অপছন্দের নাগাল পেয়ে যায় অ্যাপটি।
টিকটকের এই ফরম্যাট এতটাই নেশাজাগানিয়া যে, আমেরিকায় একেকজন টিকটক ব্যবহারকারী দিনে গড়ে ৪৬ মিনিট অ্যাপটিতে সময় কাটায়, যা ইউটিউবের থেকে খানিক, এবং ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের চেয়ে ১৬ মিনিট বেশি।
ইউজারদের মনোযোগকে পুঁজি করে বেশ ভালোই আয় করছে টিকটক। গত বছর তাদের আয় ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার। এই বছর সেটি ১২ বিলিয়ন ছোঁয়ার কথা রয়েছে, এবং ২০২৪ সালে তা পৌঁছে যাবে ২৩ বিলিয়নে। এবং এই আয়ের প্রায় সবটাই তারা করবে স্রেফ বিজ্ঞাপন থেকে।
ইমার্কেটারের করা এই পূর্বাভাস যদি সত্য হয়, তাহলে টিকটক সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বিতীয় স্তরে থাকা টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, পিন্টারেস্ট ও অন্যান্য অ্যাপকে পেছনে ফেলে দেবে, এবং ইউটিউবের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে। তবে টিকটকের পক্ষে আরো অনেক বড় হওয়াও সম্ভব, যদি আমরা দৌইনের কেস স্টাডি মাথায় রাখি। চীনে প্রচলিত ওই অ্যাপটিতে দিনে গড়ে ১০০ মিনিট করে থাকে প্রতি ব্যবহারকারী, এবং সব মিলিয়ে শুধু ওই একটি অ্যাপেই দৈনিক অনলাইন-ঘণ্টার ১২ শতাংশ সময় কাটায় চীনারা। দৌইনসহ আরো বেশ কিছু চীনা অ্যাপের মালিক-প্রতিষ্ঠান বাইটডান্স গত বছর দেশটির ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজারের ২৮ শতাংশ কবজা করেছিল, যা প্রতিদ্বন্দ্বী টেনসেন্ট ও বাইডুর থেকে বেশি।
দৌইনের দৃষ্টান্ত থেকে আরো ধারণা করা যায় যে, বিজ্ঞাপনী খাতের বাইরেও টিকটকের আয়ের আরো রাস্তা খোলা রয়েছে। দৌইন এখন চীনে ই-কমার্সের অন্যতম বৃহৎ চালিকাশক্তি। অবশ্য গত বছর নভেম্বরে ব্রিটেন ও ইন্দোনেশিয়ায় চালু হওয়া টিকটকের প্রথম ই-কমার্স ভেঞ্চার টিকটক শপ ডাহা ফেল মেরেছে। তাই কিছু ‘কিন্তু’ এখানে রয়েই যায়, যদিও টিকটক যে হাল ছাড়বে না এত সহজে, সে-কথাও বলাই বাহুল্য।
টিকটকের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাও অবশ্য খুব সহজে হার মানছে না। গত এপ্রিলেই মার্ক জাকারবার্গ ঘোষণা দিয়েছেন যে গত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ইউজারদের সামনে বন্ধুদের পোস্ট তুলে ধরা ফেসবুক নিউজ ফিড এবার ‘ডিসকভারি ইঞ্জিন’-এ পরিণত হবে, এবং গোটা ইন্টারনেট জগতেরই হরেক রকমের কনটেন্ট সেখানে দেখা যাবে, ঠিক টিকটকের মতো। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতেও বার্ষিক উপার্জন বিষয়ক এক বৈঠকে তিনি পাঁচবার টিকটকের নাম উচ্চারণ করেন। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটা, রিল নামে টিকটকের মতো একটি শর্ট-ভিডিও ফরম্যাটও চালু করেছে, যা উভয় অ্যাপের সঙ্গেই যুক্ত করা হয়েছে।
টিকটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এমন ক্লোন এখন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। স্ন্যাপচ্যাট স্পটলাইট, ইউটিউব শর্টস, পিন্টারেস্ট ওয়াচ, এমনকি নেটফ্লিক্সের ফাস্ট লাফসও টিকটকের দেখানো পথেই হেঁটেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সফলতার দেখাও পেতে শুরু করেছে। এখন রিলসেই কাটে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের ২০ শতাংশ সময়। ইউটিউব শর্টের রয়েছে মাসিক দেড় বিলিয়ন ইউজার, যা সম্ভবত স্বয়ং টিকটকের থেকেও বেশি।
আবার টিকটক নিজেও কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে টুকটাক আইডিয়া গ্রহণ করছে। ইউটিউবের বাজারে ছোবল হানার জন্য তারা ভিডিওর সর্বোচ্চ সময়সীমা ১০ মিনিটে উন্নীত করেছে। স্ন্যাপচ্যাটের ‘স্টোরিজ’-এর দেখাদেখি তারাও ডিস্যাপেয়ারিং ক্লিপ লঞ্চ করেছে। আবার অ্যামাজনের লাইভ ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টুইচে ইউজাররা অর্থের বিনিময়ে ক্রিয়েটরদের চ্যানেলে অ্যাক্সেস পায়। টিকটকও অনুরূপ সাবস্ক্রিপশন মডেলের ট্রায়াল শুরু করেছে। সম্প্রতি তারা ক্রিয়েটরদের একাংশকে লভ্যাংশ দিতেও শুরু করেছে, যা ইউটিউব অনেক আগে থেকেই করে আসছে।
একসময় যে বাজারকে প্রতিযোগিতাহীন মনে করা হতো, সেখানে এ ধরনের অনুশীলনকে স্বাস্থ্যকরই বলা যায়। ২০২০ সালে আমেরিকার ফেডারাল ট্রেড কমিশন মেটার বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিট্রাস্ট কেস করেছিল। কিন্তু এখন টিকটক মেটার কাছ থেকে ব্যবহারকারী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের ছিনিয়ে নিচ্ছে, ফলে মেটার বাজার দর এ বছর অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। সুতরাং বর্তমানে প্রতিযোগিতাহীনতা নিয়ে চিন্তার কারণও হ্রাস পেয়েছে।
ওয়েপন অভ মাস ডেস্ট্রাকশন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদরা টিকটকের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অন্য একটি কারণে: জাতীয় নিরাপত্তা। টিকটকের মালিক-প্রতিষ্ঠান বাইটডান্সে বিনিয়োগকারী হিসেবে রয়েছে অনেকে, আমেরিকার জেনারেল আটলান্টিক থেকে শুরু করে জাপানের সফটব্যাংক পর্যন্ত। জেনারেল আটলান্টিকের প্রধান এবং বাইটডান্সের বোর্ড মেম্বার বিল ফোর্ডের দাবি,
বাইটডান্স কোনো চীনা ইন্টারনেট কোম্পানি নয়, বরং এটি হলো একটি বৈশ্বিক ইন্টারনেট কোম্পানি যার রয়েছে চীনা ঐতিহ্যের শেকড়।
কিন্তু ফার্মটির হেডকোয়ার্টার বেইজিংয়ে। ফলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে, অন্য সব বৃহৎ চীনা কোম্পানির মতো, বাইটডান্সেও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বিদ্যমান, এমনটিই আশঙ্কা অনেকের।
২০১৮ সালে বাইটডান্স বাধ্য হয় তাদের জোক-শেয়ারিং অ্যাপ নেইহান দুয়ানজি বন্ধ করে দিতে। অথচ একসময় তাদের ২০০ মিলিয়ন ইউজার ছিল। তারপরও এর অকাল বিদায়ের কারণ, চীনা নীতিনির্ধারকরা মনে করছিল এই অ্যাপের ‘কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট’ ব্যবহারকারীদের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
বাইটডান্সের প্রতিষ্ঠাতা ঝাংও সে অভিযোগ মাথা পেতে নিয়ে বলেছিলেন,
এই প্রোডাক্টটি ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছিল। এখানে এমন সব কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছিল, যেগুলো সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। সব দায় আসলে আমারই। আমি সব সাজা মেনে নেব, যেহেতু এটি জনগণের মতামতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন তাই প্রশ্ন হলো, টিকটকের ব্যাপারে চীনা সরকারের পরিকল্পনা কী? এই অ্যাপ থেকে তারা কী চায়? পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটো জিনিস। প্রথমত, বিলিয়নের অধিক ইউজারের ডেটা। এখন পর্যন্ত অবশ্য এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যে টিকটক ইউজারদের থেকে সেসব ডেটা সংগ্রহ করছে যেগুলো তাদের সংগ্রহ করা উচিত নয়। গত বছর টরন্টোর সিটিজেন ল্যাব পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানিয়েছে, টিকটক বা দৌইন বিনা অনুমতিত কোনো কনট্যাক্ট, ফটো, অডিও, ভিডিও বা লোকেশন ডেটা জোগাড় করছে, এ ধরনের আভাস পাওয়া যায়নি। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, দৌইনের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো চীনের বাইরে শঠতাপূর্ণ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যেমন ‘ডাইনামিক কোড-লোডিং’ (অর্থাৎ, রানিংয়ের সময়ে অতিরিক্ত কোড লোডিং হওয়া)। কিন্তু টিকটক এমন কিছু করে না।
তবে, অধিকাংশ সোশ্যাল অ্যাপের মতো, টিকটকও কাস্টোমারদের ফোন, ব্যবহারের ধরন, লোকেশন ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে, এবং থার্ড-পার্টি ট্র্যাকিং সার্ভিস ব্যবহার করে। চীনা আইন অনুযায়ী, সরকার চীনা ফার্মগুলো থেকে কম-বেশি যেকোনো ধরনের ডেটা দাবি করতে পারে, এমনকি যেসব ডেটার উৎস তাদের দেশের বাইরে। কিন্তু টিকটকের দাবি, চীনা সরকার কখনো ইউজারদের ডেটা চায়নি, আর তাদেরকে সেগুলো কখনো দেওয়াও হয়নি (যদিও কোনো কোনো সিনিয়র স্টাফ ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন যে এমন কিছু ঘটে থাকলেও সে ব্যাপারে তারা অবগত নন)।
গ্রিন্ডারের মতো অ্যাপ, যেখানে ব্যবহারকারীদের যৌনতা ও এইচআইভি সংক্রান্ত তথ্য থাকে, সেগুলোর চেয়ে টিকটকের ব্ল্যাকমেইলের আশঙ্কা কম। তারপরও কিছু আশঙ্কা রয়েই যায়, কেননা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জেমস লুইস জানাচ্ছেন, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো নিয়মিতই সোশ্যাল মিডিয়ার বায়োগ্রাফিক ডেটাবেজ মাইন করে থাকে। চীনের ডমেন্টিক সার্ভেইলেন্স প্রোগ্রাম মানুষের ফেসিয়াল ও ভোকাল প্রিন্ট রেকর্ড করে থাকে। ওয়েব থেকে সেগুলো সংগ্রহের বদলে যদি টিকটক থেকেই তা করা যায়, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ম্যাচ করা যায়, তাহলে তাদের জন্য কাজটি সহজতর হয়ে উঠবে। আর টিকটক যেভাবে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনা করছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে তাদের কাছে কেবল ব্যবহারকারীরা কেমন দেখতে ও তাদের কণ্ঠস্বর কেমন সেই তথ্যই থাকবে না, বরং কোন ব্যক্তিবিশেষ কোথায় থাকে এবং কী কেনাকাটা করে, সেসব তথ্যও চলে আসবে।
২০২০ সালে ভারত টিকটকসহ আরো কয়েক ডজন চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ছিল দু’দেশের মধ্যকার সীমান্তে অস্থিরতা, তবু ভারত দাবি করেছিল যে এসব অ্যাপ ভারতীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করে গোপনে পাচার করছে। এর দুই মাস বাদে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ জারি করেন যে হয় ৪৫ দিনের মধ্যে টিকটককে কোনো আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে হবে, নতুবা নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হবে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, টিকটক বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছে, যার ফলে চীনের পক্ষে ফেডারাল কর্মী ও কন্ট্রাক্টরদের লোকেশন ট্র্যাক করে, ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্তের নথি তৈরি করে, তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করা কিংবা কর্পোরেট গুপ্তচরবৃত্তির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। (বাইটডান্স সফলতার সঙ্গে আদালতে এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ জানায়, এবং ট্রাম্পের উত্তরসূরী জো বাইডেন এটি প্রত্যাহার করেন।)
টিকটক বিদেশী ব্যবহারকারীদের ডেটা চীনের বাইরে রেখে এ ধরনের আশঙ্কা দূরীকরণের চেষ্টা করেছে। তবে এটি খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়।বাজফিড গত জুন মাসেও একটি প্রতিবেদন করেছে যে, চীন-ভিত্তিক স্টাফরা নাকি জানুয়ারি মাসেও আমেরিকান ইউজারদের ডেটায় প্রবেশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে টিকটকের ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটি ডিপার্টমেন্টের একজন সদস্য বলেন, “সবকিছুই চীন থেকে দেখা যায়।”
তাই ১৭ জুন টিকটক ঘোষণা দেয় যে আমেরিকান ইউজারদের ট্রাফিক এখন থেকে রুট করা হবে ওরাকল নামের একটি আমেরিকান ফার্মের সার্ভারের মাধ্যমে। তবে এই আমেরিকান ফার্মটিও অনেকটা জুমের মতোই, যাদের সঙ্গেও চীনের যোগসাজশ থাকার সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে টিকটকের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, আমেরিকায় অবস্থানরত একটি সিকিউরিটি টিমের প্রটোকল অনুযায়ীই কেবল চীনা স্টাফরা আমেরিকান ব্যবহারকারীদের ডেটা অ্যাক্সেস করতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমেরিকান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টিকটকের আলাপ-আলোচনা চলছে। এই পরিকল্পনা যদি অনুমোদন পায়, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এর প্রয়োগ দেখা যেতে পারে।
শি টিভি
নিরাপত্তা বিষয়ে আরেকটি ভয়ের জায়গা আছে, যেটি কিনা আগেরটির চেয়েও বড়। টিকটক ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে কী জানতে পারল, তার থেকেও বড় আশঙ্কার ব্যাপার এটিই যে, ব্যবহারকারীরা টিকটক থেকে কী ধরনের তথ্য জানতে পারছে।
টিকটকের পথচলা শুরু হয়েছিল নিছকই একটি বিনোদনমূলক সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে। কিন্তু এর পরিসর ও কার্যক্রম বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে জনমনে এর প্রভাবও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ টিকটক ব্যবহারকারীই একে একটি সংবাদ-সূত্র হিসেবেও বিবেচনা করে বলে জানাচ্ছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রয়টার্স ইনস্টিটিউট। বিশেষত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের মতো যেসব দেশে মূলধারার গণমাধ্যম তেমন একটা শক্তিশালী নয়, সেসব দেশের অর্ধেক ব্যবহারকারীই টিকটককে ব্যবহার করে সংবাদের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে। তরুণ প্রজন্মই টিকটক থেকে তুলনামূলক বেশি সংবাদ সংগ্রহ করে থাকে। এদিকে অনেক মূলধারার গণমাধ্যমও বর্তমানে নিজেদের কনটেন্টের প্রচারণার জন্য টিকটককে ব্যবহার করা শুরু করেছে।
নিউজ সোর্স হিসেবে টিকটকের আবির্ভূত হওয়াকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। আমেরিকান সিনেটর টেড ক্রুজ যেমন বলেছেন,
“টিকটক হলো এমন একটি ট্রোজান হর্স যেটিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কাজে লাগাতে পারে আমেরিকানরা কী দেখবে, শুনবে, এবং শেষমেশ কী ভাববে, তা প্রভাবিত করার জন্য।”
চীনা সরকারের দুর্নাম রয়েছে নিজ দেশে সোশ্যাল মিডিয়াকে ম্যানিপুলেট করার জন্য। গত ৩ জুন, তিয়ানআনমেন স্কয়ারে গণহত্যার আগের দিন, লিপস্টিক কিং হিসেবে খ্যাত লি জিয়াকি নামের একজন স্ট্রিমিং সেলসম্যানকে সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ওয়েইবো থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার দোষ ছিল, তিনি একটি কেক প্রদর্শন করেছেন যেটি দেখতে ট্যাংকের মতো। টিকটকের একজন প্রাক্তন কর্মী জানিয়েছেন (যদিও কোম্পানিটি তা অস্বীকার করেছে), বেইজিংয়ে বাইটডান্সের অফিসে নাকি সরকারি সেন্সর কাজ করে। টিকটকের যমজ ভাই দৌইনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নাম লিখে সার্চ করলে নির্লজ্জ প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই আসে না।
অথচ ওই একই নাম লিখে টিকটকে সার্চ দিলে অপেক্ষাকৃত ‘নরমাল’ ফলাফল দেখা যায়। তারপরও টিকটকের মডারেশনের ধরন অনেকক্ষেত্রেই চীনা বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১৯ সালে দ্য গার্ডিয়ান টিকটকের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা উন্মোচন করে, যেখানে দেখা যায় তিয়ানআনমেন, তিব্বত, তাইওয়ানসহ অন্যান্য দেশের ‘বিতর্কিত বিষয়’ যেমন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রেফারেন্স নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তীতে নীতিমালার এসব কড়াকড়ি অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। টিকটকের দাবি, গত দুই বছর ধরেই তাদের কনটেন্ট মডারেশনের কাজ চালানো হচ্ছে চীনের বাইরে থেকে। কিন্তু টিকটকের সাফল্যের গোপন সূত্র যে রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম, সেটির আপডেট এখনও দেওয়া হয় চীনের বাইটডান্স থেকেই।
এশিয়ান কর্পোরেট গভর্ন্যান্স অ্যাসোসিয়েশন নামক ওয়াচডগের নানা লি অবশ্য সন্দিহান যে আসলেই চীনা সরকার টিকটকের কাভারেজের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় কি না।
চীনের বাইরে টিকটকের যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তাতে আমার মনে হয় না তারা এ ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবে। এর সঙ্গে বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী সকল চীনা কোম্পানির ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। কেনই বা সেটিকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করবে?
তারপরও, আমেরিকান টিনেজারদের বিনোদনের (এবং বর্তমানে সংবাদেরও) প্রিয় উৎস যে টিকটক, দিনশেষে সেটি আদতে পরিচালিত হয় চীন থেকেই। রয়টার্স ইনস্টিটিউটের রাসমুস নিয়েলসেন মনে করিয়ে দিয়েছেন, অধিকাংশ দেশেই বিদেশি ওল্ড-মিডিয়ার (অর্থাৎ সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদির) মালিকানার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অথচ বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্ষেত্রে সেরকম কোনো কড়াকড়ি নেই। ফেডারেল কমিউনিকেশন্স কমিশনে (এফসিসি) ট্রাম্প কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন সদস্য ব্রেন্ডান কার গত জুন মাসেই অ্যাপল ও গুগলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাদের অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটককে বাদ দিতে। কিন্তু এফসিসির ক্ষমতা নেই অ্যাপল বা গুগলকে এ কাজে বাধ্য করতে।
এদিকে তদারককারীদের পক্ষে সংবাদপত্র বা টেলিভিশন স্টেশনগুলোর আউটপুটের উপর নজর রাখা সহজ হলেও, ব্যক্তিগত সোশ্যাল ফিডে কে কী করছে সেদিকে খেয়াল রাখা মোটেই সহজ কাজ নয়। ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা স্পুটনিক ও রাশিয়া টুডেকে গত মার্চ মাসে অনেক পশ্চিমা দেশই নিষিদ্ধ করেছে, কেননা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতে তারা ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধের ব্যাপারে ‘পদ্ধতিগত তথ্য ম্যানিপুলেশন ও ভুল তথ্য প্রচার’ করছে। কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্যার্থে টিকটকও এমন কিছু করছে কি না (যেমনটি ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে দাবি করা হয়েছিল), তা জানা বেশ কঠিন ব্যাপার। টিকটক অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ওরাকলের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসেবে তারা কোনো থার্ড-পার্টিকে তাদের অ্যালগরিদম খতিয়ে দেখতে দেবে।
এতে কি নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হবে? সময়ই তা বলে দেবে। তবে নিশ্চিতভাবেই, টিকটক চাইছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে, ব্যবসাকেও পোক্ত করতে। তাদের জনপ্রিয়তা এই মুহূর্তে যতই তুঙ্গস্পর্শী হোক না কেন, দেশের বাইরে অনিশ্চয়তা এবং নিজ দেশে টেক-ফার্মগুলোর উপর কড়াকড়ি সন্দেহাতীতভাবে তাদের প্যারেন্ট কোম্পানিকে ক্ষতির মুখে দাঁড় করাচ্ছে।
ক্রমশ অনলাইন কনটেন্টের উপর চীনের পুলিশিং জোরদার হচ্ছে, হুমকির মুখে ফেলছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লাইভ স্ট্রিমিং, ই-কমার্স ও বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিকে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানাচ্ছে, টাইগার গ্লোবাল নামের একটি আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এ বছর বাইটডান্সের দর এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামিয়ে এনেছে। গত বছর একটি প্রাথমিক পাবলিক অফারিংয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনাও থিতিয়ে পড়েছে।
গত বছর যখন চীনে টেক ম্যাগনেটদের বিরুদ্ধে প্রচারণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, সেই ডামাডোলের মাঝেই বাইটডান্সের প্রতিষ্টাতা ঝাং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। (তবে তিনি এখনো কোম্পানির একটি বড় অংশের মালিক, এবং সিংহভাগ ভোটাধিকারের ক্ষমতাও তার হাতেই রয়েছে।)
জাপানি কোম্পানিগুলো ১৯৮০’র দশকে পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, টিকটকে কর্মরত অনেকে তাদের বর্তমান ‘সন্দেহের শিকার’ হওয়ার দুর্দশাকে সেটির সঙ্গেই তুলনা করছেন। কিন্তু আসলে টিকটকের অবস্থা আরো বেশি জটিল। গেল বছর জো বাইডেন নিজেও একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে কিছু ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করেছেন যার মাধ্যমে সরকার বিদেশী কোম্পানির মালিকানাধীন অ্যাপসমূহের উত্তোলিত ঝুঁকির আশঙ্কা মূল্যায়ন করবে। বলাই বাহুল্য, চীনা মালিকানাধীন অ্যাপগুলোর ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকার বর্তমানে তথ্যের অপব্যবহার ঠেকাতে বিদেশী সফটওয়্যারের জন্য নতুন নিয়ম-নীতিমালাও তৈরি করছে।
কমিটি অন ফরেইন ইনভেস্টমেন্ট ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস (সিএফআইইউএস), যারা এর আগে একটি চীনা কোম্পানি কর্তৃক গ্রিন্ডারের ক্রয় আটকে দিয়েছে, এই মুহূর্তে টিকটকের পরিস্থিতিও যাচাই করে দেখছে। গত ২৪ জুন ছয়জন রিপাবলিকান তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে যেন তারা দ্রুত তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। প্যানেলটি পাঁচ-বছর-বয়সী মিউজিকাল.লি চুক্তি বাতিল করতে পারে, কিংবা এমনকি ফিরে যেতে পারে ট্রাম্পের পুরনো পরিকল্পনায়ও, যার মাধ্যমে বাইটডান্সকে বাধ্য করা হবে টিকটকের আমেরিকান ব্যবসায়িক অংশ বিক্রি করে দিতে। টিকটকের যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তাতে করে সিএফআইইউএস হয়তো ওরাকলের সঙ্গে কিছু কম্বিনেশন সেট-আপ গ্রহণ করাকেই অপেক্ষাকৃত সহজ মনে করবে, সেই সঙ্গে চাইবে টিকটক যেন বাহ্যিক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তাদের অ্যালগরিদমকে উন্মুক্ত করে দেয়।
কিন্তু চীন এসব চুক্তিতে সম্মত হবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। ২০২০ সালে যখন ট্রাম্প আদেশ দিয়েছিলেন টিকটকের আমেরিকান ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়ার, তখন চীন একটি আইন পাশ করে যেখানে টিকটকের রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদমকে ‘সেন্সিটিভ টেকনোলজি’র শ্রেণিভুক্ত করা হয়, যার ফলে সেটি বাইরের কোনো দেশের কাছে বিক্রি করা যাবে না। কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশন্স নামের আরেকটি থিংকট্যাংকের অ্যাডাম সিগাল মনে করেন, ওই একই আইনের ফায়দা তুলে চীন বাইরের কারো কাছে বাইটডান্সের অ্যালগরিদম পরীক্ষানিরীক্ষার প্রক্রিয়াতেও বাগড়া দেবে।
সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, অন্য কোনো দেশের কাছে টিকটককে তুলে দেওয়ার চেয়ে চীন অ্যাপটির কার্যক্রম সেই দেশ থেকে গুটিয়ে নেওয়াকেই শ্রেয় বলে মনে করবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তখন দুটো পথ খোলা থাকবে। হয় তারা তাদের নাগরিকদের বঞ্চিত করবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ থেকে, নয়তো ঝুঁকির আশঙ্কাগুলোকে এড়িয়ে যাবে। সিগাল যেমনটি বলছেন,
“একপর্যায়ে কোনো একজনকে তো চোখের পাতা ফেলতেই হবে!”
(দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)