বিগত অনেক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। গত শতকের ষাটের দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য খুব অল্প সময় পার করেছে, যে সময়ে সেখানে কোনো সংঘাত ছিল না। এই চরম সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার সাথে বার বার যে দেশের নাম জড়িয়ে গিয়েছে, সেটি হচ্ছে ইরান।
সত্তরের দশকে আমেরিকাসমর্থিত শাসক রেজা শাহ পাহলভীকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ‘ইসলামিক বিপ্লব’ সম্পন্ন করা, কখনও প্রতিবেশী দেশ ইরাকের গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্রের ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়েও শেষপর্যন্ত সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা, কখনও তেহরানস্থ আমেরিকান দূতাবাসের জিম্মি নাটক কিংবা আমেরিকার ভুল হামলায় ইরানের বেসামরিক বিমান ভূপাতিত হওয়া– ইরানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে বার বার। এমনকি সম্প্রতি ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধেও মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশ আলোচনায় আছে– সেটি ইরান। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ব্যবহার করা ড্রোনগুলোর একটি বড় অংশের সরবরাহকারী ইরান বলে দাবি করা হচ্ছে।
বর্তমানে ‘স্বীকৃত’ পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের সংখ্যা আট। এর মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি রাষ্ট্রের (রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা) হাতেই পারমাণবিক বোমা রয়েছে। বাকি তিনটি রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া৷ কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ কোরিয়ার সক্ষমতা রয়েছে পারমাণবিক বোমা তৈরির, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোরীয় উপদ্বীপে সামরিক ভারসাম্য আনয়নে তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের তালিকায় নামও লেখাতে পারে। অপরদিকে, ইসরায়েল বার বার অস্বীকার করলেও তাদের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকার শক্ত প্রমাণ রয়েছে। ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের অস্ত্রসম্ভারে ৭৫-৪০০টি পারমাণবিক বোমা মজুদ রয়েছে। ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছে– এরকম আলোচনা অনেকবার শোনা গেলেও বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে বলা যায়- ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে থাকলেও কোনো বোমা তৈরি করতে পারেনি।
সম্প্রতি বেশ কয়েকবার ইরানের অভ্যন্তরে ভিন্ন ভিন্ন কিছু স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক আইন বিবেচনায় নিলে এই আক্রমণগুলো একটি দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হিসেবে গণ্য হবে। প্রাথমিকভাবে আক্রমণের পেছনে কাদের হাত রয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে ইসরায়েলই এসব হামলার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এই বক্তব্যের পক্ষে সমর্থনও জানিয়েছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েল দাবি করে আসছে- ইরান প্লুটোনিয়ামের মজুদ এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যা পারমাণবিক বোমা তৈরির আদর্শ পরিমাণের কাছাকাছি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় ‘ম্যাক্সিমাম প্রেশার’ নীতির অধীনে পারমাণবিক চুক্তি থেকে আমেরিকা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারির সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ইরান এবার হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে। তবে আসল প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান কেন পারমাণবিক বোমার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছে?
একটু ভিন্ন দৃশ্যে চোখ বোলানো যাক। ইরাকের সাদ্দাম হুসেইনের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে আমেরিকার শত্রুতা যখন চরমে, তখন সাদ্দাম হুসেইনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (Weapon of Mass Destruction) রয়েছে– এই অযুহাতে ইরাকে হামলা চালানো হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে- ইরাকে আসলে তেমন কোনো বোমাই ছিল না। একেবারে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই যুদ্ধ থেকে ইরানের শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু ছিল। ইরাকের হাতে তেমন শক্তিশালী কোনো অস্ত্র ছিল না, যা দিয়ে প্রবল শক্তিধর মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করা যায়৷ এজন্যই এই আক্রমণের ফলাফল নিয়ে যৌথবাহিনীকে কখনোই ভাবতে হয়নি। কিন্তু যদি ইরানের কাছে ‘পাল্টা আক্রমণ’ করার মতো শক্তিশালী অস্ত্র থাকে, তাহলে এত সহজে কেউ আক্রমণ করার কথা ভাববে না। এই শক্তিশালী অস্ত্রই হচ্ছে পারমাণবিক বোমা। ‘নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স’ তত্ত্ব (Nuclear Deterrence Theory) অনুযায়ী, দুটো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, এ ধরনের সংঘাতে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ আর এমনটি হলে দুটো দেশই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর থেকেই ইরানি নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করে আসছিলেন, হয়তো পরবর্তীতে পশ্চিমাদের সমর্থনপ্রাপ্ত সুন্নি রাষ্ট্রগুলো (যেমন: সৌদি আরব) আবারও ইরানের উপর হামলা চালাতে পারে। এজন্য আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে ইরান বিভিন্ন স্থানে ‘প্রক্সি আধা-সামরিক বাহিনী’ তৈরি করে রেখেছ। এই বাহিনীগুলো দিয়েই বেশ কিছু জায়গায় ইরান ‘প্রক্সি ওয়ার’ পরিচালনা করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে লেবাননের হেজবুল্লাহর কথা বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও এই বাহিনীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ইরানের পারমাণবিক বোমা অর্জন দেশটির জন্য বিরাট কৌশলগত সামরিক সুবিধা বয়ে আনতে পারে। পারমাণবিক বোমার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েই অনেকাংশে শত্রুর উদ্ধত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকে বলে থাকেন, ইরান পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে উন্নীত হতে চায় নিজের নিরাপত্তার জন্যই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা কিংবা ইসরাইলের উপর ইরান কখনোই পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর মতো ভুল করবে না। কারণ এই দেশগুলোর পাল্টা হামলা (যেটাকে সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি বলা হয়) করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে। অর্থাৎ যদি ইরান এই দেশগুলোর উপর আক্রমণ করেও, তাহলে পাল্টা পারমাণবিক আক্রমণের শিকার হতে হবে ইরানকে। ইসরায়েল ও আমেরিকার পাল্টা আক্রমণের সামর্থ্য এত বেশি যে, ইরানের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে এমন আক্রমণের মুখে। ইরান আদতে এই রাষ্ট্রগুলোর মতোই ‘সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ অর্জন করতে চায়। এই যোগ্যতা অর্জন করলে এই দেশগুলো সাধারণত ইরানের উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে।
পারমাণবিক বোমার প্রকল্প গ্রহণের পেছনে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও জড়িত। ২০০৫ সালে সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই ইরানের রাজনীতিতে কট্টরপন্থীদের দাপট বাড়তে শুরু করে। দেশটির রাজনীতিতে যারা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত, তারা পশ্চিমাদের সাথে একটি পরমাণু চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল। সেই অনুযায়ী তারা পরিকল্পনাও করছিল। কিন্তু মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর ‘জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী’ হিসেবে পারমাণবিক চুক্তির বিষয়টি বাদ দিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংস্কারপন্থীরা ইরানের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেন। ইরানের ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি শক্তকরণেও পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি ছিল।
ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায়, পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখালে ইরান প্রকৃতপক্ষেই নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতি লাভ করবে। কিন্তু একইসাথে পশ্চিমাদের যুক্তিও ফেলনা নয়। পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই দাবি করে আসছে- ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিসাম্যে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হবে, এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ হয়তো পরমাণু বোমার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ইরান সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আসবে– এটা বলাই বাহুল্য।