২০১৫ সালে যখন ইরানের সাথে পৃথিবীর শক্তিশালী ছয়টি দেশের পরমাণু চুক্তি হয়, তখন ইরানি নাগরিকরা আনন্দে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে যেসব নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিকে নখদন্তহীন বাঘে পরিণত করেছিল, সেগুলো তুলে দেয়ার পরের বছরই বিশাল পরিবর্তন আসে। আগের বছরগুলোতে যেখানে ইরানের জিডিপি ধুঁকছিল, সেখানে ২০১৬ সালে ইরানি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৩.৪০ শতাংশ। বিদেশি কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার জন্য ইরানে হাজির হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞায় চরমভাবে ভুগতে থাকা ইরানের জন্য প্রবৃদ্ধির এই আকস্মিক ইতিবাচক পরিবর্তন ছিল বহুল আকাঙ্ক্ষিত। ইরানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়েছিল এই চুক্তি।
ইরান গোপনে পরমাণু বোমার ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে– ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর এরকম অস্বস্তিকর অনুমান দূর করতেও এই চুক্তির বিরাট ভূমিকা ছিল। ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের বিষয়ে সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল ২০১৫ সালের সেই চুক্তিতে। আমেরিকার তৎকালীন ওবামা প্রশাসনের মতে, ইরানের হাতে ২০১৫ সালে চুক্তির আগে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম ছিল, তা দিয়ে অনায়াসে দশটি পরমাণু বোমা বানানো যেত। কিন্তু এই চুক্তি ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশ হওয়ার উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক ছিল এই চুক্তি।
ওবামার পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের সময় একাধিকবার ইরানের পরমাণু চুক্তির সমালোচনা করেছেন। গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার বলতে চেষ্টা করেছেন ইরান পারমাণবিক চুক্তি মার্কিনীদের জন্য সুফল বয়ে আনেনি, কখনও আনবেও না। ইরানের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি ওয়ারের কথা বলে যে জাতীয়তাবাদী প্রচারণা চালিয়েছিলেন ট্রাম্প, তার সাথে চুক্তির সম্পর্ক ছিল না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই ইরানের বিষয়ে হার্ডলাইনে চলে যান। ক্যাম্পেইনের সময় ইরানের ক্ষেত্রে যে নীতির কথা বলেছিলেন, তা থেকে সরে আসেননি। ২০১৮ সালের ৮ মে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। ট্রাম্পের সমর্থকেরা বরাবরই বলতে চেষ্টা করেছে, ইরান চুক্তির অংশীদার দেশগুলোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের হস্তক্ষেপের বিষয় সামনে এনে আমেরিকার চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়াকে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ চুক্তিতে অংশীদার আমেরিকা বাদ দিয়ে অন্যান্য দেশগুলো যেমন ফ্রান্স, রাশিয়া কিংবা জার্মানির কখনও এই উদ্দেশ্য নিয়ে চুক্তি করেনি যে, চুক্তির মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব কমাবে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের উপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের তেলশিল্পকে লক্ষ্য করে যে নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়, তাতে ইরানের অর্থনীতি একেবারে নাজেহাল অবস্থা হয়ে যায়। বলে রাখা ভালো, ইরানের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে খনিজ তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য। ইরানের অর্থনীতির বারোটা বাজাতে তাই তেলশিল্পকেই লক্ষ্য বানানো হয়।
২০১৮ সালে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা পুনরারোপ করার আগে ইরান প্রতিদিন পঁচিশ লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষ ব্যারেল তেল রপ্তানি করতো। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তেল রপ্তানির পরিমাণ নেমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতিদিন তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ ব্যারেলে, যার বেশিরভাগই চীনে রপ্তানি করা হয়। ইরানের যেসব কোম্পানি ব্যবসা করতো, সেগুলোকেও নিষিদ্ধ করা হয়। সম্প্রতি খনিশিল্প, ইরানের ব্যাংক সেক্টরসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার উপরেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইরানের সাথে তেল আমদানির মাধ্যমে যেসব যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও বয়কট করার হুমকি দেয়া হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
ইরানের পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে সম্পৃক্ত। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বৈদেশিক বাণিজ্যে ধ্বস নামানোর পাশাপাশি বেকারত্বের হারও বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে একদিকে ইরানি মুদ্রা রিয়ালের দাম ডলারের বিপরীতে বিশাল পতনের সম্মুখীন হয়েছে, অপরদিকে করোনাভাইরাসের কারণে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সংকট আরও গভীর হয়েছে। ইরানের প্রধানমন্ত্রী হাসান রুহানি এক ভাষণে বলেছেন, আমেরিকার সাথে ‘বাণিজ্যযুদ্ধে’ জড়িয়ে ইরান তেল আমদানির মাধ্যমে ১০০ বিলিয়ন ডলার ও বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে ১০০ বিলিয়ন ডলার, মোট ২০০ বিলিয়ন ডলার হাতছাড়া করেছে।
ইরানের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুযায়ী ৪১.৩ %। প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। ডলারের বিপরীতে ইরানি রিয়ালের মূল্য পড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ইরানের বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকারকে আরও বেশি করে ট্যাক্স আরোপ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে যে ভর্তুকি দেয়া হতো, সেগুলো তুলে নেয়া হচ্ছে।
ইরানের অর্থনীতির এই ভগ্নদশায় অতিষ্ঠ হয়ে গত বছরের শুরুতে ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে জনগণের সব আন্দোলন দমন করা হয়েছে। শত শত মানুষ আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমে আসার পর ইরানের বর্তমান সরকারের রোষানলে পরে প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনের সাথে জড়িত অসংখ্য ব্যক্তিকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। জনগণের স্বতস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসাকে ইরানি রাজনৈতিক নেতারা ‘বাইরের দেশের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন।
ট্রাম্পের প্রশাসন যখন ‘ম্যাক্সিমাম প্রেশার’ নীতির আওতায় একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে গিয়েছে, তখন তাদের মনে হয়েছিল হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই ইরানে অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। ইরানের অর্থনীতি চরমভাবে আঘাত পেলেও ইরানের নীতিনির্ধারকরা স্থির থেকেছেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করেছেন। নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈদেশিক আমদানও হ্রাস পেয়ে ইরানের দেশীয় শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটেছে। নিষেধাজ্ঞার পেছনে আমেরিকার লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের আধিপত্য বিস্তার কিংবা ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবাননে প্রক্সিওয়ারের বিষয়ে ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করা। বাস্তবে আমেরিকার লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।
ইরানের অর্থনীতি পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। তাই ২০১৮ সালের পর থেকে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে মার্কিনীদের পক্ষ থেকে, তা ইরানের জন্য নতুন কিছু নয়। গত শতাব্দীর সত্তর কিংবা আশির দশকেও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। বলতে গেলে নিষেধাজ্ঞার সাথে একপ্রকার খাপ খাইয়ে নিয়েছে ইরানিরা।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি, তা কাটিয়ে উঠতে বিশাল সংস্কার প্রয়োজন। তেলশিল্পের উপর একক নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা এর মধ্যে একটি। তেলের বাজার নিশ্চিত করাটাও ইরানের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি চীনের সাথে ইরানের ২৫ বছর মেয়াদী অনেকগুলো চুক্তি হয়েছে। আমেরিকার শত্রু চীন অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হওয়ায় ইরানের বিশাল লাভ হয়েছে এতে। চীন ইরানের জ্বালানি, পরিবহন ও সাইবার নিরাপত্তা খাতে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের দূরবস্থার কারণে ইরানের অভ্যন্তরে নিজেদের চাহিদা মেটানোর মতো শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বৈদেশিক বাণিজ্যের নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা যাবে তেহরানের পক্ষে। ইরানের নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা করতে পারলে ইরানের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও যেকোনো সংঘাত এড়িয়ে চলতে তেহরানকে সতর্ক থাকতে হবে।