Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতার আজ ঘোর দুর্দিন: মুক্তি কীভাবে?

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে আপন নির্ভরযোগ্যতা খুইয়েছেন বছরের পর বছর ধরে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই। টিভির পর্দায় আইনসভায় কাদা-চেয়ার-টেবিল ছোঁড়াছুঁড়ি দেখে মনে বিবমিষা জাগে- প্রতি বছর ঘটা করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এসমস্ত প্রতিনিধিকেই আমরা ক্ষমতায় নিয়ে আসি! নিঃসন্দেহে হতাশাজনক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি হতাশাজনক হচ্ছে, বর্তমান সময়ে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। চব্বিশ ঘণ্টা অনবরত নটরাজলীলা দেখিয়েও কতটা সফল ভারতের বর্তমান সময়কার সংবাদমাধ্যম?

সাংবাদিকতার সর্বনাশা গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা

ভারতের সংবাদমাধ্যমের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অহং। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার বিশেষ কদর এদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরা বিশেষ গুরুত্ব পান না আজও, কারণ তাদের পিছনে কোনো বড় প্রভাবশালী মিডিয়া সংস্থার আশীর্বাদ থাকে না। এমনকি, ছোট সেরকম নাম না জানা সংবাদ সংস্থাও হালে পানি পায় না প্রতিপত্তির অভাবে। ভৌগোলিক অর্থেও ভারতের সাংবাদিক মহলকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে ধরা হয়। রাজধানী নয়াদিল্লিতে গণধর্ষণের পর যেভাবে সংবাদমাধ্যমকে সক্রিয় হতে দেখা যায়, ততটা দেখা যায় না প্রান্তিক কোনো কেন্দ্রে এমন ট্রাজেডি ঘটলে। সরকারের চেয়েও ভারতের অনেক বড় সংবাদমাধ্যমের কাছে বিরোধীদের অতীত আখ্যানই বড়। আবার কোনো সেলেব্রিটি হাঁচি দিলেও যেরকম কভারেজ পান, কোনো গ্রামের সাধারণ এক ডাক্তার দিনে দু’শ রোগী দেখলেও অজ্ঞাতই থেকে যান।

সাংবাদিকতার বিভিন্ন মাধ্যম; Source: Author: Sollok29; Wikimedia Commons

এই যে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, রাজধানীকেন্দ্রিক, সরকারকেন্দ্রিক এবং ভিআইপিকেন্দ্রিক চরিত্র গড়ে উঠেছে ভারতের সংবাদমাধ্যমের, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে তা সুখসংবাদ নয় অবশ্যই। যদি আমাদের সংবাদমাধ্যমের কর্মপদ্ধতি ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, ক্ষমতাসীনের সঙ্গে তাদের গড়ে ওঠে সখ্য, শহুরে বিত্তবানরাই থেকে যায় তাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে, তাহলে গণতন্ত্রের শরীর-স্বাস্থ্যের আসল সমস্যাগুলিকে নিয়ে ভাববে কারা?

মেইনস্ট্রিম ইংরেজি সাংবাদিকতা আজ বাজারের পণ্য

ভারতের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম, যাকে ভালোবেসে আমরা মেইনস্ট্রিম বলে ডাকি, তা দিনে দিনে বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়ে আজকে এক প্রহসনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতাবানকে কুর্নিশ করার এই প্রবণতার জন্য ইংরেজি সংবাদমাধ্যম এখন সাধারণ মানুষের চোখে হাস্যকর ঠেকে। রোজ সন্ধ্যাবেলায় জনৈক সাংবাদিক টিভির পর্দায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকেন; হয়ে ওঠেন সুপার-আদালত; তর্কসভায় যোগ দিতে আসা তার বিরোধী মতামত পোষণ করা প্যানেলিস্টদের করে বসেন প্রবল আক্রমণ। সাংবাদিকতার নাম টিভির পর্দায় এই ঢক্কানিনাদে কেউ খুঁজে পান রবিনহুডের আদর্শ আবার কেউ বা নিছক বিনোদন। খবর এবং বিনোদনের মিশেলে তৈরি হওয়া যে হাঁসজারু পণ্য আজ ভারতের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিত্যদিনের বাজারে আফিমের মতো বেচে সত্যিকারের সাংবাদিকতাকেই শেষ করে দিচ্ছে এক শ্রেণীর সংবাদ ব্যবসায়ী। তারা একই প্রকারের কাজ করছেন আবার একে অপরকে দুষছেন সাংবাদিকতাকে খাটো করার অভিযোগে। কী দুর্দশা!

ভার্নাকুলার সাংবাদিকরা রয়ে গিয়েছেন আড়ালে এবং অসুরক্ষিত

আর অন্যদিকে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় না থেকেও যারা সাংবাদিকতার কাজটি করে চলেছেন নিষ্ঠাভরে, তাদের কথা আমরা তো জানতে পারছিই না, উল্টে তাদের সততা এবং সাহসের সঙ্গে কাজ করার জন্যে যে খেসারত দিতে হচ্ছে, তার থেকে ন্যূনতম সুরক্ষাটিও দিতে পারছি না। ভারতে আজ যদি কেউ সত্যিকারের সৎ এবং পরিশ্রমী সাংবাদিকতা করে থাকে, তবে তা এদেশের আঞ্চলিক বা ভার্নাকুলার সাংবাদিকরা।

ভারতের সমসাময়িক টেলিভিশন সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান মুখ অর্ণব গোস্বামী; Source: Author: Anhinav619; Wikimedia Commons

ভারতের অখ্যাত অঞ্চলে মাফিয়া, জাতপাতের সমস্যা, পরিকাঠামো বা পরিষেবা সংক্রান্ত দুর্নীতি, নারীবিদ্বেষ, রাজনৈতিক গুণ্ডাগিরি ইত্যাদির উপর দিনের পর দিন ঝুঁকি নিয়ে যারা সাংবাদিকতা করে চলেছেন এবং মাঝেসাঝে প্রাণও দিচ্ছেন, তাদের এই পেশাটির প্রতি সৎ এবং সাহসী অবদান কতজন মনে রাখেন? মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মাথায় বসে থাকা সাংবাদিক তথা ব্যবসায়িক বুদ্ধিজীবীরাও ভারতের গ্রাম-শহরাঞ্চলের সেই সমস্ত পরিশ্রমী অথচ অসুরক্ষিত সাংবাদিকদের জন্য নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কতটা কাজে লাগানোর তাগিদ অনুভব করেন? পেশা তো একই। তাহলেও সেখানে এই এলিট-সাবঅর্ডিনেট বৈষম্য কেন?

সমস্যা অনেক, কিন্তু তাদের সমাধান করার মতো মানসিকতার অভাব

আসলে সমস্যা আছে অনেক- সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক; এবং সবে মিলে একটি বৃহত্তর নৈতিক। ভারতের লাগামছাড়া বাজার ভোগবাদ আজ আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো গিলে খাচ্ছে সাংবাদিকতাকেও। ব্র্যান্ডের সঙ্গে নিজেদের জুড়ব, কিন্তু কাজের বেলায় শর্টকাটে কাজ সারব- এই প্রবণতা একদিকে যেমন নতুন প্রজন্মকে প্রথম থেকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে, অন্যদিকে বেশি ঝুঁকির রাস্তায় না গিয়ে চেয়ার এবং বেতন সুরক্ষিত রাখতে সমঝোতার পথে চলতে গিয়ে পেশাটির বিশ্বস্ততাকেই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন অনেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার পথটি দিন দিন আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠছে, আর তার সাথে সাথে শেষ হচ্ছে সৎ এবং পরিশ্রমী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Author: Balatokyo; Wikimedia Commons

রাজনৈতিক অর্থে এক বিষাক্ত বাতাবরণও শেষ করছে ভারতের সাংবাদিকতাকে। আজ এদেশে অনেক মেইনস্ট্রিম সাংবাদিক ‘বুক চিতিয়ে’ নিজেদের সাহসিকতা প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা করেন, তাদের শাসকদলের আয়না হতে বিশেষ দেখা যায় না। তারা বড় বেশি মতাদর্শের বুলি আওড়াতে থাকেন। অরাজনৈতিক আমরা কেউই নই, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা করতে গিয়ে মতাদর্শগত রংটাই বড় হয়ে দেখা দিলে, তা বিপদের কথা। এতে শুধু সাংবাদিক নন, পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতার সুনামও বিনষ্ট হয়।

বর্তমান সময়ে শাসকদলের সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের এক শ্রেণীর সাংবাদিক উগ্র জাতীয়তাবাদের ভজনও করছে নিজেদের এক অনুগত দর্শক শ্রেণী গড়ে তুলতে। এও সাংবাদিকতার এক পরম লজ্জা। গণতান্ত্রিক সমাজ জীবনের উপরে অভিশাপ হয়ে নেমে আসতে পারে, এমন যেকোনো কিছুরই বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রুখে দাঁড়ানোর কথা সংবাদমাধ্যমের। কিন্তু বাস্তবে ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের কাজকর্মে তার আভাস মিলছে না এবং তা যথেষ্ঠ উদ্বেগের বিষয়। তক্কাতক্কি এমনকি ব্যক্তিগত কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও হচ্ছে প্রচুর, কিন্তু হাতে হাত মিলিয়ে এক নতুন ভোরের সূচনা করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না কোনো পর্যায়েই।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে সাংবাদিকতা হারাচ্ছে তার নৈতিক চরিত্র

অর্থনৈতিক কারণেও সংবাদমাধ্যম হারাচ্ছে নিজেদের নিরপেক্ষতা। আজকে বিশ্বজনীন নানা কারণেই মিডিয়া ব্যবসা হয়ে উঠেছে যথেষ্ঠ ব্যয়বহুল এবং অনিশ্চিত। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেখানে বড়সড় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিশ্বায়ন, ইন্টারনেট ইত্যাদি নানা কারণের দরুন; সেখানে খড়কুটো আঁকড়ে থাকার মতো বিজ্ঞাপনের বাজার ধরতে মরিয়া সংবাদমাধ্যম সংস্থাগুলি। আর এই প্রবল অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে গিয়ে বিস্মৃত হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠই। ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে সস্তা এবং অভিনবত্বের সাংবাদিকতা।

ভারতের অন্যতম প্রখ্যাত সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই; Source: Gazal world; Wikimedia Commons

পাঠককে চমকে দেওয়ার সাংবাদিকতা বা হলুদ সাংবাদিকতা; অনলাইন সাংবাদিকতায় বিজ্ঞাপনী আয় বাড়াতে তাকে বেঠিক বা বিভ্রান্তিকর খবর পরিবেশন করে তাকে জোর করে খবর পড়ানো- এই সমস্ত প্রবণতা সংবাদমাধ্যমকে আজ এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

যে শুভবুদ্ধির প্রয়োজন আজ এই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে সাংবাদিকতাকে উদ্ধার করার, তার খোঁজও বিশেষ মিলছে না। যারা এ বিষয়ে ভাবিত, তারা নিজেরাই এক বিপন্ন সংখ্যালঘু শ্রেণী। কোন পথে মুক্তি তাহলে এই ঘুণধরা অবস্থা থেকে?

আশার আলো আন্তর্জাতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনলাইন সাংবাদিকতায়

একটি আশার কথা হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা। আজকাল ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এই নতুন ধারার সাংবাদিকতাটি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এটি যে সবসময় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা তা নয়; অনেক ইন্টারনেট পোর্টাল কোনো একটি বিশেষ বিষয়ের উপর সমচিন্তাসম্পন্ন সাংবাদিক বা লেখকদের নিয়ে এক ধরনের মুভমেন্ট করছে আজকাল। বিশেষ করে পশ্চিমে এই প্রবণতাটি এখন বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। ইন্টারনেটের দৌলতে চিন্তার এখন কোনো বেড়াজাল নেই। আন্তর্জাতিক স্তরে সমমনোভাবাপন্ন মানুষ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না এখন, আর এখানেই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বয়সী সাংবাদিক।

সাংবাদিকতার এই গণতন্ত্রীকরণ এক বড় আশার সঞ্চার করে আমাদের সকলেরই মনে। আন্তর্জাতিকতা মানে সেখানে দুষ্ট রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সীমিত; ইন্টারনেটের মাধ্যমে হওয়ার ফলে তার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনেক কম এবং তার ফলে হলুদ সাংবাদিকতার প্রাধান্য প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এই ধরনের সাংবাদিকতাই আপাতত শ্রেষ্ঠ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই সাংবাদিকতায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই একটি স্টোরি, প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনা এবং মতামত গুরুত্বপূর্ণ- যার অর্থ এখানে বিকেন্দ্রীকরণই বড় কথা; একঘেঁয়ে এবং অন্তঃসারশূন্য সেলিব্রিটি নিউজ যেখানে অবান্তর।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের উন্নয়নশীল দুনিয়ায় এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তিচিন্তাকেন্দ্রিক, বিষয়কেন্দ্রিক কিন্তু সার্বিকভাবে বিকেন্দ্রীভূত সাংবাদিকতার গুরুত্ব মানুষ কবে বুঝবে? যে সাংবাদিকতার ওপরে আমাদের সমাজ-রাজনীতির শৃঙ্খলা ছিন্ন করার দায়িত্ব, তার নিজের শৃঙ্খলা চূর্ণ করার মহাভারটি কে নেবে? এবং কবে?

ফিচার ইমেজ: Indian Youth

Related Articles