সম্প্রতি দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল ভারতে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ- যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর সফর করলেন মে মাসের শেষ এবং জুনের প্রথমদিকে; অপরদিকে ভারতে ওই একই সময়ে কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে মোট এগারোটি উপনির্বাচনে মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ল। পনেরোটি আসনে বিজেপি এককভাবে জিতেছে মাত্র দুটিতে আর অন্যদিকে, মোদী তার বিদেশনীতিতে জোর দিয়েছেন- আঞ্চলিক এবং বিশ্বের সমস্ত শক্তির সঙ্গেই তার দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে অবিচল থেকে।
আপাতদৃষ্টিতে হয়তো এই দুটি ঘটনার মধ্যে যোগ বিশেষ নেই। কিন্তু গভীরে ঢুকলে দেখা যাবে, যোগ অবশ্যই আছে এবং বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকার সামনের বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই যোগটিকে কাজে লাগাতে বিশেষভাবে তৎপর।
২০১৯ এর আগে মোদী খুব স্বস্তিতে নেই
২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে এবং তার পরে বেশ কিছু বড় ও ছোট রাজ্যে বিজেপির জয়ধ্বজা উড়ালেও, সার্বিকভাবে যে মোদী খুব প্রসন্নচিত্তে রয়েছেন, তা বলা চলে না। সম্প্রতি অনেক চেষ্টা করেও তার দল কর্ণাটকে সরকার গড়তে পারেনি- মাত্র কয়েকটি আসন কম পড়লেও কোনও জোট তৈরি করে ক্ষমতায় আসতে পারেনি; এরপর উপনির্বাচনেও চূড়ান্ত ভরাডুবি ঘটেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ২৭টি লোকসভা উপনির্বাচনে পদ্মবাহিনী পেয়েছে মাত্র পাঁচটি আসন; তার মধ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে জেতা কয়েকটি আসনও হাত থেকে ফস্কেছে। লোকসভায় বিজেপির আসন কমেছে প্রায় ১০টি এবং যদিও তা সরকার ফেলে দেওয়ার মতো যথেষ্ঠ নয়, কিন্তু মোদীর ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’ ছাতিতে কিছুটা হলেও বিপন্ন ভাব যে তাতে আসবে না, সেকথা বলা যায় না। আর পাশাপাশি, কর্মসংস্থান, নোটবন্দি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জনঅসন্তোষ তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে, পরবর্তী বড় নির্বাচনের এক বছর আগে পরিস্থিতি যে খুব আরামদায়ক নয়, তা মোদীর অতিবড় সমর্থকও অস্বীকার করবেন না।
মোদীর হাতে এখন অস্ত্র বিদেশনীতি
এই পরিস্থিতিতে মোদীর অন্যতম বড় অস্ত্র বিদেশনীতি। ঘরোয়া সমস্যার ঔষধি হিসেবে বিদেশনীতি একশো শতাংশ কার্যকরী না হলেও বেশ কিছুটা কাজের যে বটেই, তা দুনিয়ার অনেক রাষ্ট্রনেতা বা সাধারণ রাজনৈতিক নেতাই প্রমাণ করেছেন। বিদেশনীতি এখন যে শুধুমাত্র পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞদের চর্চা করার বিষয়, তা নয়। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের আড্ডা-আলোচনাতেও এখন বিদেশনীতির রমরমা- কারণ গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি এবং অবশ্যই, আজকালকার জনমুখী এবং জনপ্রিয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
আমরা যদি মোদী সরকারের জনমুখী বিদেশনীতির একটি উদাহরণ পেতে চাই, তাহলে প্রথমেই দেখতে হয় ভারতের বর্তমান বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাজের ধরন। সুষমা খুব যে বেশি পাদপ্রদীপের আলোয় থাকেন, তা নয়। বিদেশনীতিতেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর ছায়াতেই থাকেন কিন্তু তা সত্ত্বেও, সুষমাদেবী তার নিজের একটি বিশেষ ধারায় কাজ করেন যা টুইট-কেন্দ্রিক বা আরও বড় অর্থে, জনমুখী। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি কোথাও বিপদে পড়েন- ভারতে বা বাইরে- এবং সুষমার কাছে আবেদন জানান সাহায্যের, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং তার মন্ত্রক বিশেষ উদ্যোগ নেন সেই ব্যক্তি বা সমষ্টির সাহায্যে এগিয়ে আসতে।
বিদেশমন্ত্রকের কাজ শুধু লোকজনকে সমস্যা থেকে রেহাই দেওয়া নয়- এমন সমালোচনাও করতে দেখা যায় বিজেপির বিরোধীদের। কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না যে সুষমা স্বরাজ এবং তার বিদেশমন্ত্রকের এই জনমুখী কার্যকলাপ বিদেশনীতিকে সাধারণ মানুষের আরও কাছের বস্তু করে তুলেছে এবং পাকা রাজনৈতিক কারবারি হিসেবে মোদী নেতৃত্ব এই পরিসরটিকেও যাতে ভোটমুখী করা যায়, সেই চেষ্টাই করছেন।
বিদেশনীতি এমন একটি বিষয়, যেখানে বিরোধীদের প্রভাব সেভাবে থাকে না (যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে তার রাজ্যের সীমানা থাকাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে ভারতের বাংলাদেশ নীতিকে যথেষ্ঠ প্রভাবিত করছেন, অতীতে যেমন তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা বা করুণানিধি প্রভাবিত করেছেন নয়াদিল্লির শ্রীলঙ্কা নীতিকে)। আর সরকারি দল সেখানে অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাটে নিজেদের জনমুখী কৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারে। তার সাম্প্রতিক বিদেশ সফরগুলোতে মোদী সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন অনবরত, নিজের রাষ্ট্রনেতার পরিচয়টি আরও জোরালো করার জন্য, যাতে পরের নির্বাচনের আগে তিনি দেশবাসীকে এই বার্তা দিতে পারেন যে, তাদের সুরক্ষা, শান্তি এবং বিশ্বের দরবারে ভারতের জাতিগত গর্ব সম্ভব কেবল তারই শাসনাধীনে। অন্য কেউ সেই জায়গা পূরণ করতে পারবে না।
চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মোদীর বৈঠক: নজর ঘরোয়া রাজনীতিতে
গত এপ্রিলে মোদীর চীনের উহানে গিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর সঙ্গে একটি ‘অনানুষ্ঠানিক’ আলাপচারিতার ব্যাপারটির মধ্যে মোদী সরকারের এই জনমুখী বিদেশনীতির প্রচেষ্টাটি আরেকবার প্রস্ফুটিত হয়। যেকোনো রাষ্ট্রনেতাই চান নিজেকে শান্তিকামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে বিশ্বের ইতিহাসে তার ‘লিগ্যাসি’ কায়েম থাকে আর এই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মোদীও যে তাই করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এখন শান্তিকামী রূপ প্রতিষ্ঠা করতে মোদীকে লক্ষ্য করতে হবে ভারতের দুই প্রধান বৈরী দেশ পাকিস্তান এবং চীনকে।
পাকিস্তান সমস্যা যে সহজ নয় এবং সে-দেশের ‘বহুবিধ’ ক্ষমতাকেন্দ্রকে সামলানো যে যথেষ্ঠ ঝক্কির, তার পরিচয় মোদী পেয়েছেন বারংবার। যদিও তার অন্ধভক্তরা বিশ্বাস করেন যে মোদী পাকিস্তানকে কড়া হাতে সামলেছেন, কিন্তু বাস্তবের কাহিনী ভিন্ন। নরম-গরমে যেভাবেই হোক, পাকিস্তানকে বাগে আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন মোদী; তার কথার ফুলঝুরি ছুটলেও বাস্তবের রুক্ষ জমিতে তার বিশেষ ছায়া পড়েনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের অন্যতম বড় উপায় হচ্ছে তার সঙ্গে যুদ্ধ করা, যেমন তার পূর্বসূরি অটলবিহারি বাজপেয়ী করেছিলেন ১৯৯৯ সালে, কার্গিলে, যার দরুন জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় ভর করে তিনি ফের ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু সেবার পাকিস্তানই ভারতের হাতে যুদ্ধের ছুতো গুঁজে দিয়েছিল। এই মুহূর্তে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়াটা ঘোর ঝুঁকির কাজ আর তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
অতএব, রইল চীন। চীন পাকিস্তানের থেকে অপেক্ষাকৃত সহজতর প্রতিদ্বন্দ্বী কারণ, ভারতের মতো চীনেরও অর্থনৈতিকভাবে হারানোর অনেক কিছু আছে। যুদ্ধ লাগলে আর তাই বেইজিংও আচমকা সে পথ নেবে না, হাজারো চোখরাঙানি দিলেও। গতবছর ডোকলামে ভারত আর চীনের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের একটি বড় সম্ভাবনা দেখা দিলেও, তা শেষপর্যন্ত আর চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেনি। আর একবছর আগের সেই প্রায়-সংঘর্ষের পরিস্থিতি এবছর মোদীকে একটি সুযোগ করে দেয় চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ফের চাঙ্গা করতে। পাশাপাশি, রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্ত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন যে সংরক্ষণবাদের নীতি নিয়ে চলেছে, তাতেও ভারত এবং চীন- এই দুই অর্থনীতির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ারও যথেষ্ঠ অবকাশ রয়েছে।
মোদী দেখলেন, এটাই সুযোগ। এক ধাক্কায় সামরিক এবং অর্থনৈতিক, দুটি ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে মিটমাট এবং মিতালি জোরদার করে নিলে দেশের মানুষকে বেশ বড়সড় বার্তা দেওয়া যাবে যে, মোদী সত্যি তার দেশের সুরক্ষা এবং উন্নয়ন নিয়ে কোনো সমঝোতা করতে জানেন না।
ঘরে হার কিন্তু সিঙ্গাপুরে দেখা গেল রাষ্ট্রনেতা মোদীকে
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে শাংগ্রিলা অধিবেশনেও মোদী যেভাবে চীন-সহ বিশ্বের বিভিন্ন বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিশেষত্বের উপর জোর দিয়ে একটি মধ্যপন্থার অবলম্বন নিয়েছেন, নির্বাচনের আগে এটিকে তার শ্রেষ্ঠ বিদেশনৈতিক অবস্থান বললে অত্যুক্তি হয় না। পাকা রাজনীতিবিদের মতোই মোদী এই কূটনৈতিক অবস্থানটি নিয়ে বিদেশে এবং ঘরে, দু’জায়গাতেই নাম কিনেছেন- উপনির্বাচনে তার দল বিশ্রী পরাজয়ের মুখ দেখা সত্ত্বেও। বিরোধীদেরও এব্যাপারে বিশেষ কিছু বলার নেই কারণ, বিদেশনীতির সঙ্গে আসে জাতীয় স্বার্থ আর তা নিয়ে কোনো সমালোচনা মানে এখানে যেন দেশদ্রোহিতার শামিল!
অতএব, বল আপাতত মোদীর কোর্টেই আছে।
Featured Image Source: Connected To India