গত ৩ জুন, রবিবার গুয়েতেমালার ফুয়েগো আগ্নেয়গিরিতে ঘটে গেছে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত। প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকা এ অগ্ন্যুৎপাতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৯৯ জন। নিখোঁজ রয়েছে আরও প্রায় ১৯২ জন। কাজেই মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখনও উদ্ধারকার্য অব্যাহত রয়েছে। আগ্নেয়গিরির ঢালে অবস্থিত গ্রামগুলো ছাই, কাদা ও পাথরে ঢাকা পড়েছে। বিগত প্রায় এক শতাব্দীর মাঝে এটিই গুয়েতেমালার ভয়াবহতম অগ্ন্যুৎপাত। এর ভয়াবহতা ও ব্যাপক প্রাণহানির কারণে দেশটিতে তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট।
অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা
ফুয়েগো আগ্নেয়গিরিটি রাজধানী গুয়েতেমালা সিটি থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। রবিবার এটি সচল হয়ে উঠলে আকাশে ছাই, গ্যাস ও পাথর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। গরম লাভা বা গ্যাসের প্রবাহ আশেপাশের গ্রামে আঘাত হানলে বাড়ির ভেতরেই লোকজন মারা যেতে থাকে।
দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রধান সার্জিও কাবানাস জানান, এল রোডেও শহরটি চাপা পড়ে গেছে। আলোটেনাংগো ও স্যান মিগুয়েল লস লটেল শহর সহ আরও কিছু শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ধারকারীরা এখনও কিছু কিছু গ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া এলাকাগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রায় তিন হাজার জনগণের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় তৈরি করা হয়েছে।
স্বজনদের হারিয়ে অনেকেই শোকে বিহ্বল, আবার অনেকেই এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন হারানো স্বজনদের। স্ত্রী ও এক বয়সী কন্যাকে নিয়ে এল রোডেও শহর ছেড়ে পালিয়ে আসা এফরেইন গঞ্জালেজ জানান, দশ ও চার বছর বয়সী আরও দুই সন্তানকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তারা তাদের বাড়িতে আটকা পড়েছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা রিকার্ডো রেয়েস জানান, তাকেও তার বাসা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা সবকিছু ফেলে শুধু পরিবারের সদস্যরা মিলিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছি। বিপদ কেটে গেলে এখন বাড়ির অবস্থা দেখতে ফিরে এসেছি- সবকিছুই বিপর্যস্ত।”
চারটি অঞ্চল জুড়ে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির প্রধান বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা পুনরায় সচল করা হয়েছে। বাতাসে প্রচুর ছাইয়ের উপস্থিতির কারণে সাধারণ জগণকে মাস্ক পরতে উপদেশ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
অগ্ন্যুৎপাতের ভয়াবহতা
ফুয়েগো ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলোর একটি। ১৯৭৪ সালে এক অগ্ন্যুৎপাতে আশেপাশের অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হলেও কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। এ বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসের আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের সময় প্রায় ১.৭ কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত ছাই দেখা যায়। তবে রবিবারের অগ্ন্যুৎপাতটি আরও বড় মাত্রার।
১৯০২ সালের পর থেকে এটিই গুয়েতেমালার সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত। এর আগে ১৯০২ সালে শান্তা মারিয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। গুয়েতেমালার জাতীয় ভলকানোলোজি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ইনসিভুমেহ থেকে লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে, কেননা আগ্নেয়গিরিটি আবার সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাবশেষের সাথে পানি মিশ্রিত হয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করলে তা আশেপাশের গ্রাম ও বসতিগুলোর ক্ষতিসাধন করতে পারে বলেও সচেতন থাকতে বলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহ
আগ্নেয়গিরির নানা পদার্থ, যেমন-পাথর, ছাই ইত্যাদির সাথে গরম গ্যাসের মিশ্রণে তৈরি হওয়া প্রবাহকেই পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহ বলা হয়। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণজনিত অগ্ন্যুৎপাতের কারণে স্বাভাবিকভাবেই এটি ঘটে থাকে। এটি আশেপাশের অঞ্চলে বসবাসরতদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ফুয়েগোর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে।
এ কারণেই প্রত্যক্ষদর্শীদের করা ভিডিও থেকে জানা যায় এগুলো কেন এত বিপজ্জনক। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি সেতুতে দাঁড়িয়ে ফুয়েগো থেকে ধেয়ে আসা ছাই ও গ্যাসের ভিডিও করছেন কয়েকজন মানুষ। দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ হঠাৎই বুঝতে পারে এটি কত দ্রুত তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ধেয়ে আসার গতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে একটি বাণিজ্যিক আকাশযানের মতোই সাধারণত ঘণ্টায় ৭০০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসে এই প্রবাহ।
এছাড়া প্রবাহে বিদ্যমান পাথর ও বায়ুর তাপমাত্রা প্রচণ্ড তীব্র থাকে, প্রায় ২০০-৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। ৭৯ শতাব্দীতে ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে খুব শক্তিশালী পাইরোক্লাস্টিক প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে পম্পেই ও হারকুলেনিয়াম নামে রোমান সভ্যতার দুটি শহর ধ্বংস হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে ছাইচাপা পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে কেমন ছিল এই অগ্ন্যুৎপাত?
জর্জ লুই আলতুভ নামে গুয়েতেমালার পর্বত উদ্ধার ব্রিগেডের একজন সদস্য জানান, অগ্ন্যুৎপাত শুরু হওয়ার পূর্বে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে তাদের প্রায় ৪০ জন সদস্যের একটি দল সেখানে যায়। নিখোঁজ ব্যক্তির দেহ চিহ্নিত করে ফিরিয়ে আনার সময় তারা খেয়াল করেন, হঠাৎই আগ্নেয়গিরিটির সক্রিয়তা বেড়ে গিয়েছে। এসময় তারা প্রায় ৩৭ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছিলেন। তারা তখন উদ্ধারকার্য শেষ না করেই নেমে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথমে তারা ভেবেছিলেন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পরে খেয়াল করেন, আসলে বৃষ্টি না, প্রবলবেগে পাথর পড়ছিল। পাথর বর্ষণের সময় ধীরে ধীরে বড় আকারের পাথর বাড়ছিল। সেগুলোর কোনো কোনোটির ব্যাস প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটারের মতো ছিল। নিচে নামতে শুরু করার পরে কালো ছাইয়ের মেঘে চারিদিকে ঢেকে যায়। দিনের আলো থেকে একেবারে রাতের মতো অন্ধকার নেমে আসে।
কমান্ড পোস্টে যোগাযোগ করলে তারা খুব দ্রুত সেখান থেকে নেমে আসতে বলে। সাথে টর্চ, হেলমেট ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি থাকায় এবং পথ ভালো করে চেনা থাকায় তারা নিরাপদে কমান্ড পোস্টে পৌঁছতে সক্ষম হন। তবে পরবর্তীতে বাইরে এসে সবকিছু ছাইয়ে ঢাকা ও সেতুগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে তারা এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেন। তবে তারা যখন উদ্ধারকার্যে গিয়েছিলেন, তখন কোনো সতর্কবার্তা ছিল না। তাই তারা বেশ অবাক হয়েছিলেন।
ফ্রান্সিস্কো কিশ নামে অপর এক ভুক্তভোগী জানান, নিজ পরিবার নিয়ে এল রোডেও শহর থেকে পালিয়ে আসার পরে নিজের ছেলে ও ছেলের স্ত্রীর সন্ধানে ফিরে যান তিনি। অনেক কষ্টে একটি দেওয়ালের মধ্য দিয়ে ছেলের বাড়িতে প্রবেশ করে তিনি মৃতদেহ দেখতে পান। মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য তিনি রক্তের নমুনা দিয়েছেন, যদিও তিনি জানেন না ছেলের কপালে কী ঘটেছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, তার ছেলের স্ত্রীও নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার ছেলের বয়স মাত্র ২২ বছর। ছেলের স্ত্রীর বয়সও একই ছিল, সে সন্তানসম্ভবা ছিল।”
স্প্যানিশ ভাষায় ফুয়েগো মানে আগুন। সত্যিই যেন আগুনের মতো ভয়াবহতা নেমে এসেছিল গুয়েতেমালায়। ব্যাপক প্রাণহানির সাথে ঘটেছে অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি। বৃষ্টির কারণে উদ্ধারকার্য বিঘ্নিত হলেও শীঘ্রই উদ্ধারকার্য সম্পন্ন হবে। তবে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি দেশটির কর্তৃপক্ষ। এদিকে গুয়েতেমালার বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা কনরেড আগাম সতর্ক বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কনরেডের প্রধানের পদত্যাগ দাবি করেছেন এবং জানিয়েছেন, গুয়েতেমালার সরকারের এ ব্যাপারটির অনুসন্ধান করা উচিত। এদিকে কনরেড জানিয়েছে, আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞরা এমন কোনো যথাযথ বার্তা দেননি যার কারণে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। তবে সত্য যেটাই হোক, সময়মতো সতর্ক বার্তা দিলে হয়তো অনেকগুলো প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো।
Featured Image Source: The Whistler