Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিরিয়াতে রাসায়নিক হামলাগুলো কারা করছে, কেন করছে?

সিরিয়াতে বিদ্রোহীদের উপর আবারও রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল শনিবার, বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ঘুতার অবরুদ্ধ দুমা শহরের জনগণের উপর হেলিকপ্টার থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এ হামলা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এর জন্য বাশার আল-আসাদের সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে, যদিও সিরিয়া এবং রাশিয়া তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে। রাশিয়া দাবি করেছে, তারা রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগেরই কোনো প্রমাণ পায়নি

পূর্ব ঘুতার দুমা এলাকাটি বিদ্রোহীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং চারিদিক থেকে সিরীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হওয়ায় হামলার সত্যতা, আহত-নিহতের পরিসংখ্যান নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্রোহীদের মোবাইল ফোনে ধারণ করা চিত্রে উঠে আসা লক্ষণ অনুযায়ী এবং উদ্ধারকর্মী ও হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের বর্ণনা অনুযায়ী, এটি বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী এই হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪০ থেকে ৮৫ এবং আহতের সংখ্যা ৫০০ থেকে ১,০০০ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। আহত ও নিহতদের অনেকেই নারী এবং শিশু।

যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহারকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তারপরও সিরিয়ার সাত বছরব্যাপী চলমান গৃহযুদ্ধে বারবার রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ আক্রমণই ঘটেছে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। অল্প কয়েকটি আক্রমণের পেছনে জঙ্গি সংগঠন আইএস এবং নুসরা ফ্রন্টকে দায়ী করা হলেও, অধিকাংশ আক্রমণের পেছনেই অভিযোগের তীর উঠেছে বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৮৫টি রাসায়নিক আক্রমণের ঘটেছে, যার অধিকাংশের পেছনেই সিরীয় সরকার দায়ী

সিরিয়ার মানচিত্রে দুমার অবস্থান; Source: BBC

গত শনিবারের রাসায়নিক হামলাটি ছিল সিরিয়াতে রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি। এর আগের উল্লেখযোগ্য আক্রমণগুলো মধ্যে আছে ২০১৩ সালের মার্চে আলেপ্পোর খান আল-আসালের আক্রমণ, ২০১৩ সালের আগস্টে ঘুতার আক্রমণ এবং ২০১৭ সালের এপ্রিলে ইদলিবের খান শায়খুনের আক্রমণ। জাতিসংঘের তদন্তে এসব অভিযোগের অনেকগুলোতেই সারিনসহ অন্যান্য নার্ভ এজেন্ট এবং রাসায়নিক গ্যাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, অস্ত্রগুলো এসেছে সিরিয়ার সরকারের অস্ত্রের মজুত থেকে। কিন্তু সেগুলো তারাই প্রয়োগ করেছে কিনা, সবক্ষেত্রে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি।

জাতিসংঘ এবং রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থা (OPCW) এর যৌথ তদন্তে এ পর্যন্ত দুটি রাসায়নিক হামলার পেছনে বাশার আল-আসাদের সরকারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৬ সালের আগস্টে তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে ২০১৪ সালের এপ্রিলে ইদলিবের তালমেনিসে ও ২০১৫ সালের মার্চে ইদলিবের সারমিনে ক্লোরিন গ্যাস প্রয়োগের জন্য বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনীকে এবং ২০১৫ সালের মার্চে মারিয়া শহরে সালফার গুঁড়া প্রয়োগের জন্য আইএসকে দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্টে সে বছরের এপ্রিলে ইদলিবের খান শায়খুনে সারিন নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের ঘটনায়ও আসাদ সরকারের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়।

সিরিয়াতে ২০১৩ সাল থেকে হওয়া রাসায়নিক হামলাগুলোর তালিকা; Source: HRW

শনিবারের দুমার রাসায়নিক হামলাটি যে আসাদ সরকারই করেছে, তার অবশ্য এখনও কোনো প্রমাণ নেই। রাশিয়া দাবি করেছে, এটি বিদ্রোহীদের এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমের মিথ্যা অভিযোগ। রাশিয়ার গণমাধ্যমের যুক্তি, যে মুহূর্তে বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী পূর্ব ঘুতায় প্রায় নিশ্চিতভাবে জয় লাভ করতে যাচ্ছে, সে মুহূর্তে তাদের পক্ষে এরকম হামলা করার কোনো যুক্তি নেই। বরং পরাজয় নিশ্চিত বিদ্রোহীদের পক্ষেই রাসায়নিক হামলার মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে অথবা নিজেরাই নিজেদের জনগণের উপর হামলা করে সেই দোষ সরকারের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যুক্তি বেশি, যেন এর মাধ্যমে তারা পশ্চিমা বিশ্বকে সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর হামলা করাতে রাজি করাতে পারে।

বাশার আল-আসাদ; Source: Ammar Abd Rabbo/ABACAUSA.COM

একথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা দাবি। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ড সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েই দাবি করেছিল, ইরাকের কাছে গণ-বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং সাদ্দাম হোসেনের সাথে আল-কায়েদার সম্পর্ক আছে। সাদ্দাম-বিরোধী কিছু নির্বাসিত ইরাকি নেতাও তাদের সাথে সুর মিলিয়েছিল। ঐ মিথ্যা অজুহাতেই ইরাক দখল করে নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন যৌথবাহিনী। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, ঐ দাবি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এবারের ঘটনাও যে সেরকম কিছু না, তা নিরপেক্ষ তদন্তের আগে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব না। কিন্তু তদন্তের ফলাফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটনাগুলোর জন্য আসাদ সরকার দায়ী হওয়ার সম্ভাবনাই তুলনামূলকভাবে বেশি বলে মনে হয়। কারণ, এর আগে সিরিয়াতে যে কয়টি রাসায়নিক হামলার ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলো আসাদ সরকারের এবং আইএসের কাজ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। বিদ্রোহীদের বা অন্য কোনো শক্তির বিরুদ্ধে কোনো ঘটনা এখনও প্রমাণিত হয়নি। পূর্ব ঘুতায় যেহেতু আইএসের অস্তিত্ব নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই এবারের ঘটনাটিতেও সন্দেহের তীর আসাদ সরকারের দিকেই বেশি যাচ্ছে। তাছাড়া পরাজিত-প্রায় বিদ্রোহীদের হাতে রাসায়নিক অস্ত্র থাকলে তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে সেগুলো আসাদ বাহিনীর উপরেও প্রয়োগ করত।

আবার বাশার আল-আসাদের পক্ষে এ ধরনের হামলা করার যে একেবারেই যুক্তি নেই, তাও নয়। রাসায়নিক হামলা ছাড়াই গত দুই মাসে অবরুদ্ধ পূর্ব ঘুতায় আসাদের এবং রাশিয়ার বিমান হামলায় নিহত হয়েছে নারী-শিশুসহ অন্তত ১,৬০০ বেসামরিক নাগরিক। সর্বশেষ গত কয়েক সপ্তাহে অধিকাংশ বিদ্রোহী দল রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সমঝোতা করে পূর্ব ঘুতা থেকে বেরিয়ে গেলেও জাইশ আল-ইসলাম নামে একটা বিদ্রোহী গ্রুপ রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই আক্রমণের পরেই তারা হাল ছেড়ে দেয়। তাদের ৮,০০০ যোদ্ধা এবং ৪০,০০০ আত্মীয়-স্বজন দুমা এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সম্মত হয়। এই হামলা না হলেও শেষপর্যন্ত হয়তো আসাদের বাহিনীই দুমার নিয়ন্ত্রণ নিত, কিন্তু তাতে উভয় পক্ষের যোদ্ধাদেরই ব্যাপক প্রাণহানি ঘটত। হয়তো রাসায়নিক হামলার ফলেই দুমার পতন ত্বরান্বিত হয়েছে।

গ্যাসে আক্রান্ত এক শিশুকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে; Source: Getty Images

তাছাড়া রাসায়নিক হামলার পরে বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড সমালোচনা হলেও বাস্তবে কখনোই আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাসায়নিক হামলাকে ‘রেড লাইন’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তা অতিক্রম করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে রাসায়নিক হামলা হওয়ার পরও তিনি কিছুই করেননি। কেবলমাত্র গত বছর খান শাইখুনে সারিন গ্যাস প্রয়োগের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে ৫৯টি টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও হামলার আগেই আমেরিকা সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়াকে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা আক্রমণ করতে যাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ভরসা মূলত সেখানেই। তিনি জানেন, যতদিন রাশিয়া সক্রিয়ভাবে সিরিয়ার যুদ্ধে জড়িত আছে, ততদিন তিনি রাসায়নিক হামলা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তার বিরুদ্ধে খুব বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পাবে না। আর এ ভরসাতেই হয়তো তিনি তার সেনাবাহিনীর কম প্রাণহানির বিনিময়ে বিভিন্ন এলাকার দখল নেওয়ার জন্য সে এলাকার উপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগকে লাভজনক মনে করেন।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুধুমাত্র সিরিয়ার সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যকার যুদ্ধ নেই। এটি আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এ যুদ্ধের হয়তো সহজ কোনো সমাধান নেই। কিন্তু কোনো শক্তিই যেন বেসামরিক জনগণের উপর বিমান হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বা রাসায়নিক হামলা চালাতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। জাতিসংঘের উচিত শুধু সিরিয়া, ইয়েমেন, মায়ানমারসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের যুদ্ধাপরাধের ঘটনাগুলোর তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

Featured Image Source: Mohammed Badra/ EPA

Related Articles