ইরাকের টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন নগরী মসুল। ইতিহাস ও প্রাচীন স্থাপত্যসমৃদ্ধ এ নগরী ২০১৬-১৭ সালে আইএসের সাথে ইরাকী সরকারবাহিনীর যুদ্ধের পর এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আইএস সদস্য ও সামরিকবাহিনীসহ নিহত হয়েছে অসংখ্য বেসামরিক মানুষ। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া নগরীতে প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন ইরাকী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। ধ্বংসাবশেষ পরিস্কার করে ও নগরীর মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে সেখানে প্রাণসঞ্চারের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে্ন তারা।
মসুল নগরী পুনরুদ্ধার করার এ প্রকল্পটি শুরু হয় যখন রাঘাদ হাম্মাদি ও একদল তরুণ শিক্ষার্থী মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারটি পুনর্নিমাণের জন্য প্রচারণা শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যুদ্ধের বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেলেও এর বিপুল পরিমাণ বইয়ের সবগুলো পুড়ে যায়নি বা হারিয়ে যায়নি।
ধ্বংসস্তুপ ও ছাইয়ের নিচে চাপা পড়া প্রায় ৩০ হাজার বই অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কার করেন তারা। নগরীর অপরপাশে যখন যুদ্ধ চলছে, তখনও প্রায় ৪০ দিনে এই শিক্ষার্থীর দল একটি একটি করে বই সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। বইগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা যুদ্ধে হামলার মাধ্যমে সৃষ্ট গর্তের ব্যবহার করেন।
২৫ বছর বয়সী নার্সিং এর শিক্ষার্থী হাম্মাদি বলেন, “মহিমান্বিত অতীত ও প্রাচীন ইতিহাসে সমৃদ্ধ পুরনো এই শহরটি তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে যার মাঝে রয়েছে নবী ইউনুস (আ) এর সমাধি, ইরাকের চেয়েও প্রাচীন আল হাদবা মিনার। এই ঐতিহ্যের একাংশ বাঁচাতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগছে।”
আল-হাদবার হেলানো মিনার, দ্বাদশ শতকের আল-নূরি মসজিদ- যেখানে ২০১৪ সালে আবু বকর আল বাগদাদী খিলাফত ঘোষণা করেছিল ও নবী ইউনূস (আ) এর সমাধি- সবগুলোই শহরটি দখলের জন্য সামরিকবাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। হাম্মাদি জানান, উদ্ধারকৃত বইগুলোর মাঝে মসুলের পণ্ডিতদের হাতে লেখা কিছু বইও রয়েছে। এগুলোতে তারা মোসলাওয়ী ভাষায়ও লিখা সংস্করণ করেছেন। এই ভাষাটি সে অঞ্চলে অতীতে ইসলামী পাণ্ডিত্য কেন্দ্র ও অনেক মসজিদ, গির্জা, প্রাচীন শহরের স্থাপত্যের গর্ব হিসেবে পরিচিত।
এছাড়া শহরটির অন্যান্য স্থানে স্বেচ্ছাসেবকগণ ধ্বংসস্তূপের ইট-পাথর ও আবর্জনা পরিস্কার করে রাস্তা খুলে দেন, পানির জন্য কূপ খনন করেন এবং ত্রান বিতরণ করেন। হাম্মাদি বলেন, “মসুলের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো এবং এটি সম্ভব হয়েছে মসুলের ভেতরের তরুণদের মাঝে ঘটা বিপ্লবের কারণে।”
বই উদ্ধারকারী দলে ছেলেমেয়ে উভয়ই অংশগ্রহণ করেছেন যা আইএসের শাসনের আগেও মসুলে প্রচলিত ছিল। নিজের পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সাধারণত ছেলেমেয়েরা একত্রে কাজে অংশগ্রহণ করত না। তিনি আরও বলেন, “একটি অবিশ্বাস্য বাধা ভেঙে গেছে। বিশ্ববাসীর জন্য এটি নগণ্য হলেও মসুলের জন্য বিশাল ব্যাপার।”
ইরাক সরকার শহরটির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের কথা ঘোষণা করার বেশ কিছু মাস পর থেকে বেশ কিছু অঞ্চলে মানুষ ফিরে আসে। কিন্তু সবচেয়ে প্রাচীন স্থানটি, যেখানে ভয়াবহতম যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, সেটি এখনও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে রয়েছে।
দিয়া আল তাহের নামের একজন অধিবাসী জানিয়েছেন, দারিদ্র্যের পরেও যেসব স্থানে ধ্বংসস্তুপ পরিস্কার করা হয়েছে, সেসব স্থানে অধিকাংশ অধিবাসী ফিরে এসেছেন। তবে এমনও কিছু স্থান রয়েছে, যা পুরোপুরি জনমানবহীন। এসব স্থানে ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়া মৃতদেহ পচে গলে রয়েছে।
৩০ বছর বয়সী তাহের জানান, “দারিদ্র্য আইএসের চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। শহরটি যদি এরকমই থেকে যায় এবং দরিদ্ররা কিছু খেতে না পায়, তাহলে তারা যেকোনো কিছু করতে পারে।”
তাহের পুনর্বাসনের কাজে সহায়তা করছেন। তিনি জানান, তার লক্ষ্য প্রায় এক হাজার বাড়ি পুনর্বাসন করা এবং এ পর্যন্ত তিনি ৭৫টি বাড়ি পুনর্বাসন করেছেন, যেগুলো সম্পূর্ণ স্থানীয়দের সাহায্যের মাধ্যমে করা। স্থানীয়রা প্রায়ই তাকে থামিয়ে সাহায্য চেয়ে থাকেন। একটি বাড়ি দেখয়ে তিনি জানান, সে বাড়ির সবাই নিহত হয়েছে। তাই তাদের সকল মালপত্র বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে যার অর্থ সাহায্যের কাজে ব্যবহৃত হবে।
২৫ বছর বয়সী মারওয়া জুবুরি জানান, তার পরিবারের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পরেই তিনি প্রথম দিকের স্বচ্ছাসেবকদের মাঝের একজন। তিনি বলেন, “এটি প্রায় অলৌকিক ঘটনা যে আমরা পালাতে পেরেছিলাম। এরপর থেকে আমি আর বাসায় থাকতে নারাজ ছিলাম। আমি চুপ থাকতে রাজি ছিলাম না এবং এরপর থেকে চুপ থাকিনি।’’
তবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নারী ও তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার কারণে তাকে কথা শুনতে হয়েছে। তিনি শিশুদের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরিবারের চিকিৎসা সেবা ও সরঞ্জামাদি পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেন। তার দল একটি পার্ক খোলার ব্যবস্থা করে দেয়। শহরটিতে তিন বছর ধরে শাসন করা বাহিনীর সামরিক অনুশীলনের কাজে পার্কটি ব্যবহৃত হতো।
জুবুরি এখনও তাদের পালিয়ে যাওয়ার সময়ের কথা মনে করে আতঙ্কিত বোধ করেন। তার মতে, মসুল যদি পুনর্নির্মাণ করা হয়, এরপরও এর অধিবাসীদেরকে মানসিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, “এক হাজার বছর লাগলেও শহরটি অবশেষে পুনর্নির্মিত হবে। তবে যদি মানসিকতাই ভেঙে পড়ে, তাহলে এটি পুনরুত্থানের কোনোরকম আশা ছাড়াই হারিয়ে যাবে।”
যুদ্ধের ভয়াবহতা যেকোনো জাতির জন্যই ব্যাপক ক্ষতি বয়ে আনে। মসুল নগরীর শুধু স্থাপত্যের ক্ষয়ক্ষতি নয়, মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতেও নগরবাসীর বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন। এ দুঃসময়ে ইরাকের তরুণ স্বাচ্ছাসেবক দলের পুনর্বাসনের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
Featured Image Source: REUTERS/Khalid Al-Mousily