সাতোশি নাকামতো নামে কেউ একজন বিটকয়েন ব্যবস্থার সৃষ্টি করেন। ২০০৮ সালে বিটকয়েন নিয়ে তিনি প্রথম একটি ওয়েবসাইটে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু কে এই নাকামতো তা কেউ জানে না। গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, তিনি জাপানের অধিবাসী এবং ১৯৭৫ সালে তার জন্ম। কিন্তু কেউ তাকে চোখে দেখেনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে মিডিয়া সাতোশি নাকামতো হিসেবে ধরে নিয়েছে। ২০১৪ সালে একজন নাকামতোকে তারা পায় যিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং জাপানী-আমেরিকান। আবার কম্পিউটার বিজ্ঞানী হাল ফিন্নি নামের একজন ব্যক্তিকেও অনেকে সন্দেহ করে যে, তিনি প্রথম বিটকয়েন দিয়ে লেনদেন করেন।
আবার অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ক্রেইগ রাইটকে অনেকে নাকামতো মনে করছেন। অন্যদের থেকে এ ব্যক্তির পার্থক্য হচ্ছে তিনি নিজেই নিজেকে সাতোশি নাকামতো বলে দাবি করেছেন। বিবিসি, দ্য ইকোনমিসট, জি-কিউ এর সাক্ষাৎকারে তিনি এটি দাবী করেন। অনেক স্থানে বিটকয়েন কীভাবে কাজ করে তার কিছু অংশ চাক্ষুস প্রমাণ করারও চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু পরে নিজের একটি ব্লগে রাইট দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তার পক্ষে আর নিজের পরিচয় এভাবে বলে বেড়ানোর ইচ্ছা নেই। তবে এর কিছুদিন পরে নেটফ্লিক্সের একটি প্রামাণ্যচিত্রে বিটকয়েন দিয়ে ব্যাংকিং নামক একটি অনুষ্ঠানে আবারও নিজেকে সাতোশি নাকামতো বলে দাবি করে ক্রেইগ রাইট।
আর এবার এই তালিকায় যোগ হল আরেক নাম ইলন মাস্ক। যদিও ইলন মাস্ক নিজে বলছেন যে তিনি নিজে এর আবিষ্কারক নন। তাকে তার এক বন্ধু অনেক আগে কয়েকটি বিটকয়েন কারেন্সি উপহার হিসেবে দিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো এখন কোথায় সেটা তিনি নিজেও তা জানেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন ইলন মাস্ককে মনে করা হচ্ছে বিটকয়েনের আবিষ্কর্তা?
hackernoon.com এ সাহিল গুপ্তা নামে এক ব্যক্তি, যিনি আগে SpaceX এর ইন্টার্ন ছিলেন, তিনি এ বিষয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি ব্লগ লিখেন। সে ব্লগে তিনি ইলন মাস্ককে সাতোশি নাকামতো বলে দাবি করেন। তার দাবীতে উল্লেখিত কারণগুলো ছিল এরকম।
১) ২০০৮ সালে যে বিটকয়েন পেপার লেখা হয় তা লেখার জন্য অর্থনীতি এবং ক্রিপ্টোগ্রাফিতে অনেক দক্ষতার প্রয়োজন। মাস্কেরও সেই দক্ষতা আছে। তিনি অর্থনীতি জানেন এবং তিনি সফটওয়ারও ডেভেলপ করতে জানেন। কারণ Zip2 এবং X.com বা Paypal এর জন্য তাকে নিশ্চয় সফটওয়ার ডেভেলপ করা জানতে হয়েছিল।
২) বিটকয়েনের সোর্সকোড লেখা হয়েছিলো এমন একজনের দ্বারা যে কিনা C++ জানে।
৩) এছাড়া ইলন মাস্ক হচ্ছেন একজন পলিম্যাথ, অর্থাৎ বহু বিষয়ে পারদর্শী। তিনি নিজে নিজে যেকোনো কিছু শিখে নেন। বই পড়ে পড়ে শিখে নিয়ে সেগুলো বাস্তবজগতে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন এবং এটুকু করার সাহস রাখেন। এভাবেই তিনি রকেট বানাচ্ছেন, হাইপারলুপ বানাচ্ছেন এবং হয়তো বিটকয়েনেরও আবিষ্কার করতে পারেন।
৪) এছাড়া ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা না থাকার কারণেই হয়তো তিনি এই বিটকয়েন সৃষ্টি করে ফেলেন যেখানে ব্যাংকের কোনো দরকার হবে না।
এছাড়া সে ব্লগে আরও বলা হয় যে, মাস্ক যদি সাতোশি নাকামতো না-ও হন, হয়তো সত্যিকার নাকামতো একসাথে মিলে কাজ করছেন ইলন মাস্ক, নিক জাবো এবং হাল ফিন্নির সাথে। আবার এমনও হতে পারে যে মাস্ক অন্য সবার গবেষণাপত্র পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং নিজে একাই বিটকয়েন তৈরি করে ফেলেছেন।
আবার এই ব্লগার আরেক দিকে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেন। এটা ছিল ইলন মাস্কের টুইট নিয়ে। ৬ মার্চ ২০১৪ সালে সাতোশি ফোরামে একটি পোস্ট আসে যে “I am not Dorian Nakamoto”। এখানে বলা হচ্ছে যে মিডিয়া আগে যে নাকামতোকে ধরেছিল সে আসল সাতোশি নাকামতো নয়।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে মাস্ক টুইট করেন যে “@X4NWO Well, now that Satoshi Nakamoto has been discovered, I guess it is case closed … :)” অর্থাৎ মাস্ক বলেছেন যে “অবশেষে সাতোশি নাকামতো কে সেটা আবিষ্কার করা গেলো। আমার মনে হয় এখন এই তর্ক বন্ধ হবে”-এখান থেকেও সাহিল গুপ্তা মাস্কের সাথে বিটকয়েন আবিষ্কারের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। লেখার শেষে সাহিল লিখেছেন– “Elon– if you are Satoshi, thank you. If not, well, thanks for the Tesla Roadster”। অর্থাৎ, ইলন- যদি তুমি সাতোশি হও তাহলে তোমাকে ধন্যবাদ আর যদি তুমি তা না হও তবুও তোমাকে ধন্যবাদ টেসলার জন্য।
সাহিলের এরকম আচমকা দাবী করে বসার পরে ইন্টারনেটে শোরগোল পড়ে যায়। এরকম দাবি করার ঠিক পরপরই মাস্ক টুইট করে- “Not true. A friend sent me part of a BTC a few years, but I don’t know where it is”. — Elon Musk (@elonmusk) November 28, 2017
বিটকয়েনের আবিষ্কর্তা কে এটা জানা এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, এই ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখনই এটার আকাশছোঁয়া দাম। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা গেছে যে নাকামতোর কাছে ৯ লক্ষ ৮০ হাজারের মতো বিটকয়েন আছে। এখন প্রতিটি বিটকয়েনের বাজার মূল্য প্রায় ৯ হাজার ৯০৬ ডলার। তাহলে হিসেব মতো নাকামতো এখন ৯.৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এছাড়া বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ পরিণতি কেমন হবে, ব্যাংকের সাথে যে এর এক প্রকারের দ্বন্দ্ব আছে- এসব বিভিন্ন কারণে বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতাকে জানা প্রয়োজন।
তবে সাহিল গুপ্তা তার পোস্টে আরো তর্ক করেছে যে বিটকয়েনকে পথ দেখাতে এবং পরিচালিত করতে মাস্ককে এর হাল ধরা দরকার। মাস্কের বিটকয়েনের আবিষ্কারক হবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই তাকেই এটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে পথপ্রদর্শক হিসেবে চালনা করা উচিত। বিশেষ করে বিটকয়েন যে নেটওয়ার্কে কাজ করে সেখানে আরও সুব্যবস্থাপনার কাজ সে শুরু করতে পারে এবং ব্লকচেইন এর আকারের দিকেও নজর দিতে পারে।
ইলন মাস্ক হচ্ছেন একজন বিলিয়নিয়ার এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ও চিন্তাধারণার বিষয়ে আগ্রহী একজন মানুষ। বিশেষ করে এর সাথে যদি অর্থশাস্ত্রের যোগ থাকে তাহলে তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু তিনি বিটকয়েন বিষয়ে বেশী আগ্রহ নন। মাত্র 0.25 BTC তার আছে বলে দাবী করেন তিনি। মাস্কের মতো অনেকেই কিন্তু বিটকয়েন নিয়ে আগ্রহী নন। কারণ এই ভার্চুয়াল কারেন্সির দাম বৃদ্ধির লাগাম টানার কোনো সুযোগ নেই, এর নিয়ম-নীতির ঠিক নেই, মূল্যনির্ধারণ করার কোনো নিয়ম নেই এবং সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হচ্ছে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়া এটাও বোঝা যাচ্ছে না যে লেনদেনের জন্য এই ধরণের কারেন্সির উপর নির্ভর করার মতো পরিপক্বতা আমাদের মধ্যে আছে কিনা এবং আমরা ক্রয়-বিক্রয়ের এমন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত কিনা।
ফিচার ইমেজ- youtube.com