“Gin a body meet a
body Comin thro’ the glen,
Gin a body kiss a body,
Need the warl’ ken?Gin a body meet a body
Comin thro’ the grain;
Gin a body kiss a body,
The thing’s a body’s ain.”– Robert Burns
বিংশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর তালিকা করলে জে. ডি. স্যালিঞ্জারের ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ বইটি অবশ্যই আসবে এবং বেশ উপরেই হবে এর অবস্থান। স্কুলপালানো ১৬ বছরের এক বালকের নিউইয়র্ক শহরের অলি-গলি আর রাজপথে দু’দিনের অভিযান এবং সেই অভিজ্ঞতা যে এক অনন্য ধারার পথিকৃৎ হবে, তা হয়ত স্যালিঞ্জার নিজেও লেখার সময় ধারণা করেননি। এই বইটি পড়ে প্রধান চরিত্র, হোল্ডেন কফিল্ডের মাঝে নিজের ছায়া দেখেনি, নিউইয়র্কের রাস্তায় নিজেকে কল্পনা করেনি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, প্রতি ১৮ জন কিশোরের মধ্যে একজন বইটি পড়েছে, হয়েছে হোল্ডেন কফিল্ডের অভিযাত্রার সঙ্গী।
অনেকে মনে করে এই মনুষ্যদ্বেষী, বিদ্রোহী মনোভাব পোষণকারী, নাক উঁচু হোল্ডেন কফিল্ড আসলে জে. ডি. স্যালিঞ্জারের প্রতিচ্ছবি। তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই হোল্ডেনের চরিত্রটি এঁকেছেন। স্যালিঞ্জারও হোল্ডেন এর মতই হলিউডের উপর বিতৃষ্ণা জ্ঞাপন করেছিলেন সারা জীবন। অবশ্য স্যালিঞ্জার সবসময় এমন ছিলেন না। তার এক ছোটগল্প ‘Uncle Wiggily in Connecticut’ এর আদলে নির্মিত হয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম রোম্যান্টিক চলচ্চিত্র ‘মাই ফুলিশ হার্ট’। কিন্তু তিনি তাঁর গল্পের অনুলিপি মেনে নিতে পারেননি।
তখন থেকেই তাঁর রূপালি পর্দার প্রতি ক্ষোভের জন্ম, যা দিনকে দিন বেড়েই গিয়েছে। এককালে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা লালন করলেও হোল্ডেন চরিত্রের সাথে সাথে তিনিও সিনেমাকে ঘিরে তাঁর অসন্তোষ বারংবার প্রকাশ করে গিয়েছেন। এরপর যতবারই ক্যাচার ইন দ্য রাইয়ের গল্পকে বইয়ের পাতা থেকে পর্দায় আনার সম্ভাবনা তাঁর সামনে এসেছে, তিনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি একবার বলেছিলেনও যে, হোল্ডেন কেউ হতে পারলে সেটা কেবল তিনিই পারতেন, কিন্তু একইসাথে সেটা অসম্ভবও হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সে বয়স তিনি অনেক আগেই পার করে এসেছেন।
তাই আইকনিক এই চরিত্রের আজ অবধি রূপালি পর্দায় পদধূলি আমরা দেখতে পাইনি। এবং ভবিষ্যতে দেখতে পাব, এ সম্ভাবনাও বেশ ক্ষীণ। হোল্ডেন চরিত্রটিকে রূপালি পর্দায় চরিত্রায়ন করতে চাওয়া অভিনেতার সংখ্যা কম নয়। জ্যাক নিকলসন থেকে ইথান হক, অনেক জনপ্রিয় অভিনেতাই জনসমক্ষে তাঁদের হোল্ডেন কফিল্ডের চরিত্রে অভিনয় করার অভিপ্রায়ের কথা জানিয়েছেন! জন কুস্যাক তো বলেই বসেছিলেন তাঁর ২১তম জন্মদিনে যে, তাঁর সবচেয়ে বড় আক্ষেপ তিনি আর হোল্ডেন হতে পারলেন না। নিরাশ হতে হয়েছে স্পিলবার্গ, বিলি ওয়াইল্ডারের মতো নির্মাতাদেরও এই বইয়ের কপিরাইট না পেয়ে।
স্যালিঞ্জার এই বইয়ের ছবি নির্মাণ রোধ করতে রীতিমতো ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে গিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর আগে। বইটির স্বত্ব হলিউড পাড়ার উদগ্রীব প্রযোজকদের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তাই আমরা পর্দায় স্যালিঞ্জারের উপর নির্মিত বায়োপিক (Rebel in the Rye, 2017) বা ডকুমেন্টারি (Salinger, 2013) আর ক্যাচার ইন দ্য রাই নিয়ে ছবি বানানোর উপর ছবি (Coming Through The Rye, 2015) দেখলেও, পর্দায় হোল্ডেন কফিল্ড আর তার লাল টুপি দেখতে পাইনি আমরা এখনো। এ ছবিগুলোই প্রমাণ করে যে জে. ডি. স্যালিঞ্জার এবং তাঁর কালজয়ী বইটি ঘিরে আজও কতটা আগ্রহ মানুষের।
অবশ্য এতে ক্ষতি তেমন হয়নি। পৃথিবীর তাবৎ কিশোর-কিশোরী নিজেদের মাঝেই খুঁজে নিয়েছে হোল্ডেন কফিল্ডের ছায়া। সমাজের চোখে কিছুটা বেয়াড়া, একরোখা, কিছুটা বেখাপ্পা এবং মানিয়ে চলতে না পারা ছেলেমেয়েগুলো যেন একজন সাথী পেয়েছে, যে কিনা অবিকল তাদেরই মতো। হোল্ডেন যেন এ সকল ছেলে-মেয়ের প্রতিকৃতি। হোল্ডেনকে যেমন পলকে আপন ভাবা যায়, তেমনি স্যালিঞ্জারকে মনে হয় অন্তর্যামী। বইটি পড়ে বেশিরভাগেরই মনে জাগে যেন স্যালিঞ্জার পাঠকের নিজের কাহিনী পাতায় বন্দি করেছে, তাকে দিয়েছে এক দৃপ্ত কন্ঠ। বেশিরভাগই বইটি পড়ার পর এই অনুভূতিতে সন্তুষ্টি খোঁজে যে, অবশেষে কেউ একজন বুঝতে পারছে বিষয়গুলো, একদম একইভাবে দেখছে জগতটাকে।
কিন্তু এই হোল্ডেন কফিল্ড ক্যারেক্টারটিকে পাগল ভেবে বারবার ফিরিয়ে দেয়া প্রকাশকের বা সম্পাদকদের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়! স্যালিঞ্জারকে বিশ্বযুদ্ধের সময় উদ্বুদ্ধ করেছিল, প্রেরণা যুগিয়েছিল হোল্ডেন। যখন ডি-ডেতে স্যালিঞ্জার নরম্যান্ডির বুকে অবতরণ করেন, তখন তার পকেটে ছিল বন্দুক, গোলা-বারুদ আর ছ’টা চ্যাপ্টার ক্যাচার এর। হোল্ডেন কফিল্ড যুদ্ধ দেখেছে, দেখেছে নাৎসি শরণার্থীদের পরিণাম, নাকে লাগিয়েছে পোড়া মাংসের গন্ধ। নিউইয়র্ক টাইমসে ছোটগল্প ছাপানোর জন্য মরিয়া ডি-ডের আগের স্যালিঞ্জার আর ভি. ই. ডের স্যালিঞ্জারের মাঝে তাই যোজন যোজন দূরত্ব। যদিও হোল্ডেনের প্রথম আবির্ভাব ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’য়ে নয় আক্ষরিক অর্থে (একটি ছোটগল্প, যা যুদ্ধ শুরুর আগে নিউইইয়র্ক টাইমসে ছাপা হতে হতেও হয়নি), তবে ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ বইটিই আসল হোল্ডেনের পরিচয়ধারী।
লেখক জন রোমানো এর মতে- “ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে মার্ক টোয়েন এবং হুইটম্যান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দিয়েছে স্যালিঞ্জার”। এই বইটিতে স্যালিঞ্জার তার অন্তর্সত্ত্বার সবটুকু বিষণ্ণতা ও সমাজের প্রতি অসন্তোষ ঢেলে দিয়েছিলেন। একটি ভালো বই লিখতে চেয়েছিলেন তিনি সবসময়, কেবল আরেকটি ‘বেস্টসেলার’ নয়। ফলাফল– তাঁর বইটি শুধু তাঁরই না, লাখো-কোটি মানুষের হতাশার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বইটি নিয়ে সমালোচকদের মাঝে হরহামেশাই বিভক্তি দেখা যায়। ৬৫ মিলিয়ন কপি এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে বইটির। এখনও বছরে ২,৫০,০০০ কপি বিক্রি হয়, গড়ে প্রতিদিন ৬৮৫ কপি। স্যালিঞ্জারের নিজেকে নিয়ে ধোঁয়াশা এবং জনমনে উৎসাহ সৃষ্টির কারনে এই বই আরো কিছু রেকর্ডের অধিকারী। তবে সবচেয়ে মজার একটি রেকর্ড হলো ১৯৮১ সালে এটি একইসাথে সবচেয়ে সেন্সরড এবং সবচেয়ে বেশি স্কুলে পাঠ্যবই হওয়ার রেকর্ডটি। একটা সময় ছিল যখন এই বইটি তাঁর ছাত্রদের পড়তে বলার কারণে চাকরি খোয়াতে হয়েছিল একজন শিক্ষককে। পরে অবশ্য আমেরিকান স্কুল সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, এই বইটি প্রায়শই নিষিদ্ধ এবং সেন্সর করার নজির কিন্তু কম নয়।
এমন নয় যে বইটির ভাষা বা বিষয়বস্তু নিয়ে স্যালিঞ্জার ওয়াকবিহাল ছিলেন না! কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন একটি স্বচ্ছ বই লিখতে, এমনভাবে লিখতে যেন সবাই তাকে মনে রাখে তাঁর শব্দ ও রচনার ভিন্নতার জন্য। স্যালিঞ্জার তাঁর গল্পের উপাদান সংগ্রহ করতেন জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা থেকে। বলা হয়, বইটি দশ বছর ধরে লিখলেও তিনি বইয়ের পাতাগুলোতে বন্দী করার চেষ্টা করেছেন তাঁর ত্রিশ বছরের যাপিত জীবন। এবং মনে ইতিহাস বইটিকে রাখবেই- হয়ত ‘the great subversive anti-establishment book of all time’ হিসেবে। এগুলো কেবল ভূমিকা। বইটি ঘিরে আসল বিপত্তির শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে, ততদিনে স্যালিঞ্জার খ্যাতির শীর্ষ থেকে নিজেকে সরিয়ে, লোকালয় থেকে দূরে বসবাস শুরু করেছেন। কিন্তু তাঁর বইটি কিশোর-তরুণদের মাঝে এক কাল্টক্লাসিক হয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল তখনও, আজও করছে, আগামীতেও করবে। ‘৮০ এর দশকের সবচেয়ে আলোচিত কিছু হত্যাকান্ডের কারণ হিসেবে ধরা হয় বইটিকে। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৮০ সন থেকে মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামটা বেশ ঘৃণার সাথেই উচ্চারিত হয় আজও। কারণটা বেশ সোজাসাপটা। তার এক বুলেট গোটা পৃথিবীকে শোকের চাদরে ঢেকে দেয়, কেড়ে নেয় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গায়কির অধিকারী জন লেননকে।
মজার ব্যাপার হল চ্যাপম্যানও নিজেকে হোল্ডেন দাবি করত। এমনকি দাবিও করেছিল যে স্যালিঞ্জার বইটি তাঁর উপর লিখেছেন। যখন চ্যাপম্যানকে অ্যারেস্ট করা হয়, তার হাতে একটি কপি পাওয়া যায় ক্যাচার ইন দ্য রাই, যার পেছনে সে লিখে রাখে “This is my statement”। জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে যে টাইমস ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকার পড়ে, লেননের ‘দ্য বিটলস’ এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি ‘ফোনি’ স্বভাবের কারণে লেননকে খুন করেছে। এমনকি মামলার শুনানিতেও সে আওড়িয়ে চলে ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’ এর পাতা। নিজেকে হোল্ডেন দাবি করা এই খুনির উপরেও নির্মিত হয়েছে ছবি (Chapter 27, 2007), এবং জন লেননের খুন হওয়ার দৃশ্যে দেখানো হয়েছে চ্যাপম্যানের হাতে এক কপি ক্যাচার ইন দ্য রাই এবং ইয়কো ওনোর সাথে জন লেননের অ্যালবাম রেকর্ড।
এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, উর্বর মস্তিষ্কের পাগলামো বলে চালিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিছুটা ভয়ঙ্কর তো বটেই। ১৯৮১ সাল, মার্চ ৩০, জন হিনকলি জুনিয়র নামের এক ব্যক্তি অভিনেত্রী জোডি ফোস্টারের মনোযোগ পাবার আশায় তখনকার পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর মানুষটিকে হত্যার চেষ্টায় প্রলুব্ধ হয়। ঝোঁকের বশে আমেরিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান সহ চারজনকে আহত করতে সক্ষম হয় সে। এক্ষেত্রে বইটি প্রত্যক্ষভাবে তার হাতে না থাকলেও, তার বাড়িতে কফি টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় বইটি পায় পুলিশে কর্মকর্তারা। বইটির ভক্ত ধরা হয় ১৯৬৫ সালে কেনেডি হত্যাকারী, লি হারভি অজওয়াল্ডকেও। অজওয়াল্ডের বিষয়টি চ্যাপম্যান তার বয়ানেও ব্যক্ত করে।
অভিনেত্রী রেবেকা শিফার (মাই সিস্টার স্যাম) খুন হন ১৯৮৯ সালের ১৮ জুলাই তারই এক ভক্তের হাতে, নিজ বাড়িতে। রবার্টো বারডো নামক এক ব্যক্তি তাকে প্রায়ই চিঠি লিখত। একদিন তার স্বপ্নের মানুষটি তাকে একটা বড় একটা পোর্ট্রেট পাঠান নিজের। রেবেকা যদিও এক ভক্তকে খুশি করতে চাইছিলেন, কিন্তু এটা বারডো এটা সম্মতি হিসেবে ধরে নেয়। তাই যখন রেবেকা তাকে ফিরিয়ে দেন, সে তাঁর বাড়িতে এসে গুলি করে পালিয়ে যায়।
পালানোর সময় সে পেছনে ছুঁড়ে ফেলে যায় স্যালিঞ্জারের বইটির একটি কপি। বারডো তার এহেন কাজের হেতু হিসেবে বলে যে সে রেবেকার ‘কোমলতা’ রক্ষা করছিল মাত্র। বারডো এবং মার্ক চ্যাপম্যানের মাঝে চিঠি আদান-প্রদানের প্রমাণও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পেয়েছিল পরে। এরপরেও অনেক খুনির জবানবন্দিতে ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’ এর প্রচ্ছন্ন এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব এসেছে। তবে সুনিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে দিনকে দিন, কারা আসলেই বইটার দ্বারা প্রভাবিত আর কারা কেবল খুনের দায় থেকে বাঁচার জন্য কাজটি করছে।
ব্যাপারটা অনেকটা হাস্যকরই বটে যে, স্যালিঞ্জার সরলতা, নিরীহতার সবচেয়ে বড় রক্ষক হিসেবে যেই হোল্ডেনকে দেখতে চেয়েছিলেন, দিনশেষে সেই হোল্ডেনের মাধ্যমেই ইতিহাসে ঘটে গেছে বড় বড় কিছু হত্যাকাণ্ড।
স্যালিঞ্জারের হয়ে হোল্ডেন কিশোরদের নিষ্কলুষতাকে কোনোভাবে সময়ের বাক্সে আটকে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও হয়ত ভাবেননি স্যালিঞ্জার, তাঁর এই একই লেখনী একসময় কেড়ে নেবে কিছু নিরীহ জীবন, চিরতরে।
ফিচার ইমেজ: lithub.com