প্রচলিত বোমারু বিমান আকারে বেশ বড় হয়। এছাড়াও অধিক ভার বহন, অধিক দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম এবং গতিবেগের দিক থেকে এরা প্রচলিত ফাইটার বা জঙ্গী বিমানের থেকে অনেক পিছিয়ে। বোমারু বিমান আধুনিক সেনাবাহিনী, বিশেষ করে দূরপাল্লার মিশনে প্রায় অংশ নিতে হয় এমন বাহিনীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
হালের মাল্টিরোল বিমানের যুগে অবশ্য উন্নয়নশীল দেশগুলো বোমারু বিমান নিয়ে এখন আর বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। তবে বিশ্বের শক্তিশালী দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা যুক্তরাজ্য কিন্তু বরাবরই নিজেদের বিমানবাহিনীতে মাঝারি আর দূর পাল্লার বোমারু বিমান রেখেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা হালের ইরাক যুদ্ধে মানুষ দেখেছে কীভাবে বি-৫২ এর মতো বিশাল বোমারু বিমানগুলো প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র, দুই পক্ষই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেছে ভয়ংকরদর্শন সব বোমারু বিমানের পেছনে। পরবর্তীতে দূর পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলের নিখুঁত লক্ষ্যভেদী ক্ষমতার কারণে বোমারু বিমানের দিকে মনোযোগ কিছুটা কমে যায় উভয় পক্ষের। তবে এখনও বিশ্বের শক্তিশালী বিমানবহরগুলোতে অনেক বোমারু বিমানের উপস্থিতি দেখা যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত বিমানবিদ্যা বোমারু বিমান নির্মাণে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠে। আজ এমনই কয়েকটি সোভিয়েত বোম্বার নিয়ে জেনে নেওয়া যাক।
তুপোলেভ তু-১৬
চল্লিশের দশকে সোভিয়েত বোমারু বলতে ছিল কেবল তুপোলেভ তু-৪। এটি ছিল মার্কিন বি-২৯ এর একটি দুর্বল সংস্করণ। যুদ্ধের পর সোভিয়েত কর্তারা উঠে পড়ে লাগলেন সম্পূর্ণ দেশীয় একটি বিমানের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৩ সালে প্রথম আকাশে ওড়ে তুপোলেভ তু-১৬। এর ন্যাটো কোড নাম ছিল ‘ব্যাজার’।
১১৪ ফুট লম্বা তু-১৬ এক দফায় পাড়ি দিতে পারতো প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার। পরমাণু বোমার পাশাপাশি বহন করতে পারতো মোট ৯ হাজার কেজি বোমা। রাদুগা সিরিজের মিসাইল বহনের পাশাপাশি বিমানটিতে থাকতো কয়েকটি মাকারভ এম-২৩ কামান। দুটি প্রকান্ড মিকুলি এম-৩ জেট ইঞ্জিন বিমানটিকে ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটার বেগে ওড়ার সুযোগ করে দিতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ইরাক এবং মিশরের বিমানবাহিনীর হাতে ছিল এই বিমান। ‘৯০ এর দশকের দিকে তু-১৬ বোমারুর উপযোগিতা ফুরিয়ে যায়। এর একটি চীনা ভার্সন- জিয়ান এইচ-৬ এখনো ব্যবহার করছে সেই দেশের বিমানবাহিনী। স্থল বা নৌ-যুদ্ধ, উভয় ক্ষেত্রেই তু-১৬ বহুল ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
তুপোলেভ তু-২২
শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে যেসব বিমান উড়তে পারে তাদেরকে বলে সুপারসনিক বিমান। তু-২২ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম সুপারসনিক গতিসম্পন্ন বিমান। তবে ১৯৬২ সালে নির্মিত এই বিমানটি যুদ্ধক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি।
দুটি কোলেসভ আরডি-৭ ইঞ্জিন বিশিষ্ট তু-২২ চালাতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হতো। এর ব্যতিক্রমী ডানাগুলোর কারণে বিমানটির ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন ছিল। পূর্বসূরী তু-১৬ চালিয়ে হাত রীতিমত পাকা, এমন পাইলটদেরকেই কেবল তু-২২ চালাতে দেওয়া হতো। বলা যায়, ১৩৬ ফুট লম্বা বিমানটি খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি। এর অস্ত্র বহন ক্ষমতা আর ওড়ার পাল্লাও তু-১৬ এর থেকে খুব বেশি উন্নত ছিল না। কাজেই বিমানবাহিনী তু-২২ নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়নি।
যুদ্ধে তুপোলেভ-২২ প্রথম ব্যবহার করে লিবিয়া। গাদ্দাফীর সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিলাষ থেকে ১৯৭৮ সালে বেঁধে যায় লিবিয়া-শাদ যুদ্ধ। সেখানে শাদ, সুদান এবং শাদের বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্সের সেনাদলের ওপরে ব্যাপক আক্রমণ চালায় লিবীয় তু-২২। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় সাদ্দামের বাহিনীতেও অনেকগুলো তু-২২ ছিল।
তুপোলেভ তু-২২এম
তুপোলেভ-২৬ নামেও পরিচিত এই বোমারু বিমানটির অভিষেক হয় সত্তরের দশকে। সোভিয়েত বিমানবিদ্যার সে এক ক্রান্তিলগ্ন। বিপুল অর্থ খরচ করে বানানো হয়েছে তু-২২। সেই বিমানের হালচাল দেখে সবাই তখন বলছে যে বোমারু নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের দরকার মিসাইল। খানিকটা লজ্জা আর খানিকটা জেদ দেখিয়ে দেওয়ার বশে তুপোলেভ ডিজাইন ব্যুরো হাজির করলো তুপোলেভ-২৬ বা তুপোলেভ-২২এম। আগের বিমানটির দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার প্রয়াস থেকেই এই বিমানটির সৃষ্টি।
ম্যাক ১.৮৮ গতিসম্পন্ন তু-২৬ ওজন নিতে পারে ৫০ হাজার কেজির মতো। ১৪০ ফুট লম্বা বিমানটিকে চালায় ৪ জন মানুষের একটি দল। একেক পাল্লায় উড়তে পারে ৬ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। বিমানটিতে আবার উড়ন্ত অবস্থাতেই অন্যান্য বিমান থেকে পুনরায় তেল ভরার ব্যবস্থা ছিল। একটি ২৩-এমএম কামানের পাশাপাশি তিনটি রাদুগা কেএইচ-২২ এবং ৬টি কেএইচ-১৫ মিসাইল বইতে পারে তু-২৬। নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে বোমা বর্ষণে বিমানটি বিশেষ পারদর্শী।
তুপোলেভ-২৬ এর ন্যাটো কোড নেম হলো ব্যাকফায়ার। এটি আফগানিস্তান, সিরিয়া, জর্জিয়া এবং চেচনিয়ার যুদ্ধে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। অবশ্য এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। বর্তমানে রুশ বিমানবাহিনীতে ৭০টির মতো তুপোলেভ-২৬ ব্যবহৃত হচ্ছে।
তুপোলেভ তু-৯৫
১৫০ ফুট লম্বা ও প্রায় ৯০ হাজার কেজি ওজন বহনের সক্ষমতাসম্পন্ন তুপোলেভ-৯৫-কে রীতিমত একটি দৈত্য বলা চলে। এর ন্যাটো কোড নেম ভাল্লুক। বিরাট এই বিমানটিতে আছে ১১ হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি কুজনেতসভ-১২ টারবোপ্রপ ইঞ্জিন। টারবোপ্রপ বা প্রোপেলার চালিত ইঞ্জিনবিশিষ্ট আর কোনো বোমারু বিমান বর্তমান বিশ্বে নেই।
‘৫০ এর দশকে সোভিয়েত সেনাবাহিনী চাইতো এমন দূরপাল্লার বিমান, যা পশ্চিম ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে বোমাবর্ষণ করতে সক্ষম। এরই ফলাফল হচ্ছে তু-৯৫। বিমানটি পাল্লা দিতে পারে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার পথ। ৬-৭ জন ক্রুর একটি দল বিমানটি চালায়। প্রপেলার চালিত হলেও এর গতিবেগ কিন্তু অনেক বেশি, ঘণ্টায় ৯০০ কিলোমিটার বেশি বেগে উড়তে পারে তু-৯৫। এর বিরাট প্রপেলার ইঞ্জিনগুলোর কারণে বিমানটি বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষণকারী বিমানগুলোর একটি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাদুগা কেএইচ-২০,২২, ৫৫ আর ১০১ সহ প্রায় ১৫,০০০ কেজি মিসাইল বইতে পারে বিমানটি।
সোভিয়েত আমলে তু-৯৫ লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতো। পরে আর্থিক কারণে তা বন্ধ হলেও ২০০৭ সাল থেকে আবার রুশী তু-৯৫ কে দূর পাল্লার মিশনে যেতে দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই ইউরোপের আকাশ সীমায় রুশী তু-৯৫ এর উপস্থিতি রাশিয়ার আক্রমণাত্মক মনোভাবের পরিচয় বহন করে। সিরিয়া যুদ্ধে এই বিমান ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। রুশ বিমানবাহিনীতে ৬০টির মতো তুপোলেভ-৯৫ কর্মক্ষম আছে এবং পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তন না হলে অন্তত ২০৪০ সাল পর্যন্ত সমরক্ষেত্রে এই বিশালকায় বিমানটি দেখা যাবে বলে ধারণা করা যায়।
তুপোলেভ তু-১৬০
সাদা রাজহাঁস নামটি কাব্যিক শোনালেও তুপোলেভ তু-১৬০ ওরফে ব্ল্যাকজ্যাক কোনো সাদামাটা কিংবা সাধারণ বিমান নয়। মার্কিন বি-১ বোম্বার প্রজেক্টের পাল্টা জবাব হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সত্তরের দশকে তু-১৬০ এর নির্মাণ শুরু করে। ১৭৭ ফুট লম্বা এই যুদ্ধবিমান আক্ষরিক অর্থেই এক অসাধারণ কীর্তি। বিশ্বে এর থেকে বড় সুপারসনিক কোনো বিমান নেই। ম্যাক-২ বেগে ছুটতে পারে এই বিরাট যন্ত্রটি। বইতে পারে ৪০ হাজার কেজি বোমা এবং ৬টি দূরপাল্লার অথবা ১২টি মাঝারি পাল্লার ক্রুজ মিসাইল। ১৯৮৯ সালে প্রথম জনসম্মুখে ওড়ে এই বিমান। পরের ৩ বছরেই ৪৪টি বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বিশ্বজোড়া হৈচৈ ফেলে দেয় তুপোলেভ ১৬০।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে আর্থিক সংকটের কারণে তু-১৬০ আর ব্যবহার করা হতো না বললেই চলে। তবে পরবর্তীতে ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসলে এই বিমান আবারো দৃশ্যপটে হাজির হয়। বর্তমানে রুশ বিমানবাহিনীতে ১৬টি তুপোলেভ-১৬০ আছে। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ২০১৫ সালে রাশিয়া সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করলে তাতে তুপোলেভ-১৬০ও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ২০০৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা, জার বোম্বার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল একটি রুশ তুপোলেভ-১৬০ থেকে। পুতিন ইতোমধ্যে বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্যও কিছু তু-১৬০ নির্মাণ করবার পরিকল্পনা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে একটি জিনিস জেনে রাখা দরকার। ওপরের সবকয়টি বিমানই কিন্তু ‘সুইপ্ট উইং‘ প্রযুক্তি সম্পন্ন। সুইপ্ট উইং এর অর্থ হচ্ছে এই বিমানগুলো প্রয়োজনে বিভিন্ন কোণে নিজেদের ডানা সামনে বা পেছনে বাঁকাতে সক্ষম। সাধারণত কম উচ্চতা দিয়ে উড়লে ডানা ছড়িয়ে এবং বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়লে ডানা পেছনে বাঁকিয়ে নিলে বিমানের জ্বালানী কম খরচ হয় এবং ভারসাম্য রাখতেও পাইলটের সুবিধা হয়।
ফিচার ইমেজ – pinterest.com