করোনাকালীন মানুষের জীবন যেমন সঙ্কটাপন্ন, এবং করোনাপূর্ব সময়ে জীববৈচিত্র্য যেমনটা দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবমান ছিল, এই মুহূর্তে গণমাধ্যম যেন এই দুই চিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর রোষানলে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যখন ভয়াল হুমকিতে, তখন বর্তমান বৈশ্বিক দুর্যোগের অভিঘাতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভটি। সংবাদশিল্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার অধ্যাপক পেনেলোপে অ্যাবারনেথির মতে,
সংবাদপত্র এখন মৃত্যুর মুখে।
ইইউ অবজারভারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টের শীর্ষ পরামর্শক টম গিবসনের মন্তব্য,
সাংবাদিকতা পেশাটি এমনিতেই অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতির মাঝে বিচ্ছিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রকৃত এবং ঘটনার অন্তরালের খবর তুলে ধরা একজন সাংবাদিকের জন্য অনেক বেশি জটিল এবং দুরূহ হয়ে উঠেছে।
অথচ এই সময়টিতেই বরং পূর্ণশক্তি এবং স্বাধীনতায় করোনাকেন্দ্রিক গুজবের বিরুদ্ধে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা জরুরি বলে মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট আরসুলা ফন ডার লিয়েন।
অর্থনীতি, রাজনীতি, মানুষের জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাসসহ পুরো পৃথিবীকে করোনা কীভাবে পাল্টে দেবে, তা নিয়ে চলছে গবেষণা। কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা বোঝার জন্য অন্য কোনো বিশ্লেষণের দিকে না তাকালেই চলবে আপাতত। শুধু ভাবুন গণমাধ্যমের কথা। যুদ্ধ-মহামারিসহ কালে কালে নানা ধরনের সংকট-দুর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে ছিল সংবাদপত্র। শত-সহস্র বছরের সেই সংবাদপত্র জগৎ আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। আয়ের প্রধান দুই উৎস বিজ্ঞাপন এবং ইভেন্ট থেকে ছিটকে পড়েছে গণমাধ্যম। অস্থির এই সময়ে ইভেন্ট ব্যবসায় যেমন ধস নেমেছে, তেমনি তা কাভার করতে গিয়ে সাংবাদিকরা পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। অন্যদিকে, উত্তরোত্তর কমছে বিজ্ঞাপনের হার। দেশ থেকে দেশে সগর্বে টিকে থাকা হাজার হাজার পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে করোনাজনিত আরও অনেক কারণ। যেমন: সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের গুজবে ভয় আর আতঙ্কে সার্কুলেশন কমে আসা, স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়ে পরিবেশক এবং হকারদের পত্রিকা বিতরণে অপারগতা প্রকাশ।
স্তব্ধ সময়টিতে শুধু যে সংবাদপত্রকেই টিকে থাকার লড়াইয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে, তা নয়। গত ৩ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের সময়ে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দর্শকসংখ্যা অনেক বাড়লেও আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে বিজ্ঞাপনের হার।
ভাইরাস-সংক্রান্ত কোনো সংবাদের পাশে নিজেদের বিজ্ঞাপন দিতে চাচ্ছে না বড় বড় ব্র্যান্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। সংবেদনশীল বিষয়টির সঙ্গে নিজেদের ব্র্যান্ড মেলাতে ভয় এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া লকডাউনের কারণে বন্ধ রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। স্থগিত তাদের প্রচার-বিজ্ঞাপনও। পরিবহন বন্ধ থাকায় ভেঙে পড়েছে পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের অনিশ্চিত স্থায়ীত্বকালের কারণে নিজেদের বাজেট বাতিল করেছে অনেক বিজ্ঞাপনদাতা। ফলে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে গণমাধ্যম।
করোনাতে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কত, কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হলো কি না, না হলে কবে হবে, টেস্টিং সেন্টার কোথায়, দেশ থেকে দেশান্তরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎটা কেমন, অফিস-আদালত কবে খুলছে, পৃথিবী আবার কবে সচল হবে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানতে মানুষ যখন মরিয়া, ঠিক তখনই মানুষ সৃষ্টির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্যোগে আক্রান্ত গণমাধ্যম দুনিয়াও।
এ অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার সংবাদপত্র। নভেল করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে লড়াই করে কোনো কোনোটি আবার টিকে থাকার চেষ্টায় করছে কর্মী ছাটাই, প্রচারসংখ্যা নামিয়ে এনেছে অর্ধেকে, কেউ আবার পত্রিকার কলেবর দিয়েছে কমিয়ে। ব্রিটেনে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ম্যানচেস্টার টাইম, গ্লোবাল রিমার্ক, ফোকাস দ্য নিউজসহ কমপক্ষে ২০টি পত্রিকা। বিজ্ঞাপন এবং বাজারজাতকরণের সমস্যার কারণেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটেনের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ব্যানি স্টিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএ টুডে-সহ শতাধিক স্থানীয় পত্রিকার স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান গ্যানেট জানিয়েছে, তারা ঋণ কমাতে রিয়েল এস্টেট বিক্রি করে দিচ্ছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান স্থগিত করেছে। দেশটির নিউজ পোর্টালগুলোতে বিজ্ঞাপনের হার কমে গেছে ৫০ শতাংশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে রুপার্ট মারডকের অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া গ্রুপ নিউজ কর্পোরেশন জানিয়েছে, তাদের আঞ্চলিক ৬০টি সংবাদপত্রের ছাপা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে অনলাইনে যাওয়ার পথে নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ড-এর মতো পত্রিকাগুলো। টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালার প্রচারে কোভিড-১৯ এখন পালন করছে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা। ভাইরাসজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং আয়ের খাত কমে যাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে একের পর এক অনুষ্ঠান। কন্টেন্টের অভাবে নতুন করে সাজাতে হচ্ছে অনুষ্ঠানের সময়সূচী। অনলাইন পোর্টালগুলোও এর বাইরে নয়।
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজ নিজ দেশের সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। মহামারিতে দুস্থ মানুষগুলোর মতোই গণমাধ্যমকেও বাঁচাতে ত্রাণ সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম মিডিয়া ট্রেড গ্রুপ, প্রকাশক এবং ব্রডকাস্টারের মতো অনেক সংগঠন। কংগ্রেসের পরবর্তী বিলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিশেষ সহায়তা জন্য গত ৯ এপ্রিল আবেদন জানিয়েছে নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্রডকাস্টার (এনএবি), ন্যাশনাল নিউজ পেপার অ্যাসোসিয়েশন (এনএনএ)। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, এমন আবেদন এখন দেশে দেশে।
ক্ষতিগ্রস্ত গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে ৯১ মিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলীয় সরকার। এতে ৪১ মিলিয়ন ডলারের করছাড় এবং ‘রিজিওনাল জার্নালিজম প্রোগ্রামের’ আওতায় আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কমিউনিকেশন মন্ত্রী পল ফ্লেচার। স্থানীয় সম্প্রদায়কে তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে আঞ্চলিক ও দূরবর্তী এলাকার রেডিও, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলোর জন্য এই প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমের জন্য প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের চিন্তা-ভাবনা করছে ডেনমার্ক সরকার। দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রী জয় মগেনসেন বলেছেন,
দেশের গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে তার অন্যতম অংশীদার গণমাধ্যমকেও বাঁচিয়ে রাখিতে হবে।
‘জরুরি গণমাধ্যম অনুদান তহবিল’ গঠন করে করোনাভাইরাস সৃষ্ট চাপ সামলাতে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে গুগল। প্রথম ধাপে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার স্থানীয় ৫০টি গণমাধ্যম অনুদান পাবে বলে জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি।
এদিকে বাংলাদেশেও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদপত্রের মুদ্রণ। সিলেট, রাজশাহী, যশোর, চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত সব সংবাদপত্রের মুদ্রণ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এরই মধ্যে। বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার মুদ্রণ। প্রভাবশালী নানা পত্রিকার কলেবর নেমে এসেছে অর্ধেকে। মৃত্যুপথযাত্রী গণমাধ্যমকে বাঁচাতে সরকারের কাছে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে সংবাদপত্র পরিষদ, এডিটর্স গিল্ডসহ সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন। করোনাকেন্দ্রিক সংবাদ কাভার করতে গিয়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। তাদের জন্যও বিশেষ বীমার দাবি উঠেছে।
প্রচলিত গণমাধ্যমের ইতিহাসে তীব্রতম সঙ্কটময় এই মুহূর্তে সরকারগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় জায়গা করে নেবে সোশ্যাল মিডিয়ার মতো অপ্রচলিত গণমাধ্যম, যার পরিণাম হতে পারে প্রাণঘাতী ভাইরাসটির চেয়েও ভয়ঙ্কর। এর গুরুত্ব বুঝতে আমাদেরকে আবারও ফিরে যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেফারসনের কাছে। তিনি বলেছিলেন, সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র, দুটোর একটা বেছে নিতে হলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন। কেননা, সভ্যতার সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনে শক্তিশালী গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী।