বাল্যবিবাহের কারণে প্রতিদিনই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজারও কিশোরী। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েদের লেখাপড়া বেশিরভাগক্ষত্রেই বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া এর কারণে অল্পবয়সে সন্তান জন্ম দেয় মেয়েরা। একটি ছোট শরীরের উপর প্রসবের প্রভাব মা এবং শিশুর উভয়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, পরিণত নারীর বিপরীতে বাল্যবিবাহের ফলে হওয়া কিশোরী মায়ের ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুহার ৫০% বেশি এবং গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত জটিলতা ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
বিভিন্ন দেশের সরকার বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য তৈরি করেছে আইন, দিয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। তবুও বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সামাজিকতা ও পারিবারিক চাপের কারণে অনেক কিশোরীই এর প্রতিবাদ করতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ভারতের রজনী দেবী।
রজনীর সংগ্রাম
রজনী দেবী স্কুল পছন্দ করতেন এবং বড় স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ভারতে আরো অনেক মেয়ের মতো বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে জীবন শেষ করেননি, বরং নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। ১৪ বছর বয়সেই তার মা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলেও তিনি রাজি হননি। রজনী স্কুলে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তখনই বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।
তবে ভারতের মতো একটি দেশের গ্রামের মেয়ের জন্য এ কথা বলা অতো সহজ ছিল না। ইউনিসেফের হিসেব অনুযায়ী, ভারতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাল্যবধূ রয়েছে। দেশটিতে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মেয়ে রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ। ভারতে বাল্যবিবাহ ২০০৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও এই অবস্থা বিদ্যমান। বাল্যবিবাহ বন্ধ করার প্রয়াসে, নাবালকের সাথে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে বলে এ বছরের শুরুতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন সত্ত্বেও দারিদ্র্য, নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণে প্রায়ই পরিবার ও সম্প্রদায় বাল্যবিবাহ দিয়ে থাকে।
তবে রজনী এর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। প্রতিদিনই তিনি তার পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি বিয়ে করতে চান না। তার মাকে তিনি মনে করিয়ে দেন, অল্প বয়সে বিয়ে ও বাচ্চা নিয়ে তার কতো কষ্ট হয়েছিল। অবশেষে তার বাবা-মা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। তবে রজনীর জন্য তখন এটি ছিল সবে শুরু। তিনি শুধু নিজের জন্যই না, সকল মেয়ের জন্যই পরিস্থিতি পাল্টে ফেলতে চেয়েছেন।
পরবর্তীতে তিনি তার সম্প্রদায়ের আরও পাঁচটি মেয়ের বাল্য বিবাহ থামাতে সক্ষম হন। তিনি উত্তর প্রদেশের তার ছোট গ্রামে মেয়েদেরকে শেখান কীভাবে তাদের পিতামাতার সাথে কথা বলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যায়। তিনি তাদের বোঝাতে সাহায্য করেন যে বিয়ে না করেও পড়াশোনা করে তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।
রজনীর চেষ্টা
রজনীর বয়স এখন ১৮ বছর। তিনি তার গ্রামের মেয়েদের স্কুলে থাকার জন্য এবং অল্প বয়সে বিয়েকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দান করেন। তিনি তার প্রচেষ্টার জন্য সম্মান এবং ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছেন। এখন তার গ্রামের ২০ জন মেয়ের একটি দলের স্বনির্ভর ও ক্ষমতায়নের জন্য নেতৃত্ব দান করেন।
রজনী গার্ল আইকন ফেলোশিপ প্রাপ্তদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দেন। মিলান ফাউন্ডেশন কর্তৃক তাকেও এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই সংগঠনটি সংকল্পবদ্ধ কিশোর-কিশোরীদের একটি দুই-বছর মেয়াদী সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা তাদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে।
ভারতীয় সমাজে বাল্যবিবাহ এত বেশি কেন তা তার নিজের কাহিনীর মাধ্যমে রজনী ব্যাখ্যা করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি জানতে পারেন যে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। যে ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করা হয়, তার সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি বলেন, “আমি বিয়ে করার পরে কী ঘটবে তা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। আমি জানতে পারি আমার পিতামহ, আমার বাবা ও আমার ভাইয়েরা- সবাই ছেলে দেখতে গিয়েছে।“
তিনি জানান, তার মা বাল্যবিবাহকে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই তার মায়েরও বিয়ে হয়েছিল। গ্রামের অনেক প্রবীণের মতে, মেয়েদের বয়ঃসন্ধির আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া সর্বোত্তম। রজনী বলেন, গ্রামের লোকজনের ধারণা, বিয়ের সময় মেয়ের বয়স যত কম হয় তত ভালো।
রজনীর পরিবারের ক্ষেত্রে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে দারিদ্র্য একটি বড় কারণ ছিল। তিনি বলেন, “আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মেয়ে যত বেশি পড়াশোনা করে, সে যত বেশি বেড়ে ওঠে এবং বয়স্ক দেখায়… তখন তার যৌতুক আরও বেশি হয়।” এছাড়া সম্মানের ব্যাপারও ছিল; মেয়েরা বেড়ে উঠতে থাকলে গ্রামের মানুষ মনে করে, সে যদি অবিবাহিত থাকে তবে সে পরিবারের জন্য অসম্মান বা লজ্জাজনক হবে।
বাল্যবিবাহ সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সারা ভারতে এনজিওদের সাথে কাজ করা সংগঠন ডিএএসআরএ এর অ্যাডোলেসেন্ট কোল্যাবোরেটিভের সহযোগী পরিচালক শৈলজা মেহতা মানুষের একটি সাধারণ ধারণা তুলে ধরেন। তার মতে, মানুষ ভাবে, একবার একটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে তার দায়িত্ব তার স্বামীর। এরপর তার মর্যাদা নিয়ে আর কোনো ঝুঁকি থাকে না। তিনি বলেন, “অনেক পরিবারের সাথে কথা বললে জানা যায় এটি আসলে একটি মেয়ের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার ব্যাপার। একবার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে সে অন্য পরিবারে সুরক্ষিত। সে তখন একটি নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থান অর্জন করে।“
রজনীর সাফল্য
মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ফলে পিতামাতারা পারিবারিক খরচ কমাতে সক্ষম হয়। নিরাপদে যাতায়াতের রাস্তার অভাবের মতো মৌলিক পরিকাঠামো সমস্যাও একটি যুবতী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য পারিবারিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক গ্রামেই মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। বাবা-মায়েরা কিশোর-কিশোরীর অনেক দূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজগুলিতে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন।
তবে রজনীর কারণে তার ছোট্ট গ্রামে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। তার গ্রাম ভাওনা মাউয়ের কিশোরী মেয়েরা সংগঠিত হয়েছে। কোনো মেয়ের বাল্যবিবাহ হতে যাচ্ছে শুনতে পেলে তারা তার বাবা এবং চাচার সাথে বাল্যবিবাহের সমস্যা সম্পর্কে কথা বলে। তারা তাদের মাকে নিজস্ব বাল্যবিবাহের প্রারম্ভিক বছরগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং বোনদের রক্ষা করার জন্য ভাইদের দৃঢ়প্রত্যয়ী করার চেষ্টা করে। রজনী জানান, আগে গ্রামটিতে ১৫ বছর বয়সের বেশি ১০ জন অবিবাহিত মেয়েও ছিল না। বর্তমানে তার মতো অন্তত ২৫ জন অবিবাহিত রয়েছে, যারা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন রজনী সাইকেল চালিয়ে প্রায় ৪০ মাইল দূরে কলেজে পড়তে যান। তিনি নারী ও শিশুদের ন্যায়বিচারের জন্য তার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ভবিষ্যতে তিনি একজন পুলিশ অফিসার হতে চান এবং তার গ্রামে একটি স্কুল চালু করতে চান।
Featured Image Source: CNN