বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফুটবলারদের নামের তালিকায় অনায়াসে উঠে আসে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসি, নেইমার, ইব্রাহিমোভিচ এবং রুনিদের নাম। ফুটবল দুনিয়ায় তারকারা তাদের সেরা সময়টাতে যেমন সেরা পারফরমেন্স করে থাকে, ঠিক তেমনি আয় করে নেয় দুই হাত ভরে। বর্তমানে ফুটবলের শীর্ষ দুই তারকা খেলোয়াড় রোনালদো ও মেসির মোট সম্পদের পরিমাণ যথাক্রমে প্রায় ২০০-২৫০ মিলিয়ন ইউরো এবং ২০০-২৩০ মিলিয়ন ইউরো সমমূল্যের। ২০১৩ সালে অবসর নেওয়া কিংবদন্তি ইংলিশ ফুটবলার ডেভিড ব্যাকহামের আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইউরো, যা এখনো মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো যেকোনো ফুটবলারের চেয়ে বেশি।
গেতাফের হয়ে এখনো ফুটবল খেলছে এমন একজন ফুটবলারের নাম বলছি, যিনি একজন বিলিয়নিয়ারও। যার সম্পদের আনুমানিক মূল্য রোনালদো কিংবা ব্যাকহামের থেকেও বেশি। ফুটবলের নিখাদ ভক্ত যারা তারা অবশ্যই চমকে উঠবেন এই ভেবে যে, এমন একজনের নাম তো আমি জানি না! তাহলে আপনার জন্যই শুরু করছি, ফুটবল খেলে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এক অসাধারণ মানুষের কথা।
ম্যাথিও ফ্লামিনি, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও আর্সেনাল ভক্তরা সহজেই চিনতে পারবেন ৩৪ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে। ২০ বিলিয়ন ইউরোর মালিক ম্যাথিও ফ্লামিনি খেলেছেন আর্সেনাল, এসি মিলান, অলিম্পিক মার্সেই, ক্রিস্টাল প্যালেসের মতো ক্লাবে। আর্সেনালের হয়ে ২৪৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন মাত্র ১৩টি এবং এসি মিলানের হয়ে ১২২ ম্যাচে তার গোল মাত্র ৬টি। ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৪১ গোল করা এই খেলোয়াড়টিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিভাবে মনে রাখবে তা হয়তো প্রশ্ন সাপেক্ষ, কিন্তু পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার অগ্রদূত হিসেবে ফ্লামিনি একজন অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন হয়তো।
জিএফ বায়োকেমিক্যালস
জিএফ বায়োকেমিক্যালস (GF Biochemicals) নামে একটি কোম্পানির শুরু করেন ফ্লামিনি ও তার বন্ধু প্যাসকুয়েল গ্রানাতা ২০০৮ সালে। এই কোম্পানিটি শুরু থেকে কাজ করছে জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের বিকল্প কিছু আবিষ্কার করার লক্ষ্যে, যা বদলে দিবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। জিএফবি (GFB) কোম্পানিটির নাম গ্রানাতা (Granata) ও ফ্লামিনির (Flamini) অদ্যাক্ষর নিয়ে শুরু, যারা মূলত তৈরি করছে লেভুলিনিক এসিড (Levulinic Acid) নামের একধরনের যৌগ, যা তেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
জিএফবির দাবি অনুযায়ী, তারা পৃথিবীর প্রথম কোম্পানি যারা এটি ব্যাপক হারে উৎপাদন ও বাজারজাত করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত ও এই বছর মিলিয়ে কোম্পানিটি পা দিয়েছে নতুন দিগন্তে, ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে জিএফবি কোম্পানি তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে ১০,০০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত। ধীরে ধীরে গড়ে উঠা ফ্লামিনির এই কোম্পানিটির আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২০ বিলিয়ন ইউরো। ফ্লামিনি যে এই কোম্পানিটির একজন সহ-উদ্যোক্তা, তা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তার পরিবার এবং কাছের বেশিরভাগ মানুষ জানতোই না।
লেভুলিনিক এসিড
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি (DoE) এর মতে, লেভুলিনিক এসিড হলো সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে এমন ১২টি মুখ্য রাসায়নিকের একটি। বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিনি থেকেই এই ধরনের ‘বিল্ডিং ব্লক কেমিক্যালস’ তৈরি করা সম্ভব এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উচ্চ মাত্রার জ্বালানীযোগ্য রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তর করা সম্ভব। এই ধরনের রাসায়নিক জ্বালানি তেলের বিকল্প উৎস হিসেবে ব্যাপক হারে ব্যবহার সম্ভব, যা নিয়ে কাজ করছে ফ্লামিনির কোম্পানি।
লেভুলিনিক এসিড তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের বায়োমাস (Biomass) যেমন ঘাস বা কাঠ ব্যবহার করা যায়। এই রাসায়নিক পদার্থটি শুধুমাত্র সবধরনের তেলের বিকল্প উৎস হিসেবেই নয়, প্লাস্টিক, দ্রাবক এবং ঔষধ শিল্পেও ব্যবহার করা সম্ভব। লেভুলিনিক এসিডের বহুমাত্রিক ব্যবহার পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় দারুণ সহায়ক। ফ্লামিনি ও গ্রানাতার কোম্পানি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রকৃতির জন্য সহনীয় পর্যায়ের রাসায়নিক ও জীবাশ্ম তেলের বিকল্প জ্বালানির উন্নতি সাধনে।
জিএফ বায়োকেমিক্যালস ও ফ্লামিনির স্বপ্ন
ফ্লামিনির ও তার বন্ধুর হাত ধরে গড়ে উঠা কোম্পানিটির বদৌলতে বিলিয়নিয়ার হলেও ফ্লামিনিকে এই মহৎ উদ্যোগে অর্থ তাড়িত করেনি। ফ্লামিনি বিশ্বাস করেন, তাকে সবসময় ভাবিয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়ার পরিবর্তন ও প্রভাব। কার্বন নিঃসরণের ভয়ংকর প্রভাব থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতার যে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতেই মূলত ফ্লামিনি কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা উল্লেখ করে ফ্লামিনি বলেন, “এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা।” লেভুলিনিক এসিড পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করনে ফ্লামিনি। “এই এসিডের দারুণ সক্ষমতা রয়েছে, কারণ এটি ঠিক তেলের মতোই কাজ করে, যার অর্থ এটি তেলের একটি বিকল্প হতে পারে।”
স্বপ্নের শুরুর দিকে কথা বলতে গিয়ে ফ্লামিনি জানান যে, ফুটবলারদের ক্যারিয়ারে উত্থান-পতনের সমষ্টি এবং এই কোম্পানিটি শুরু করা ছিলো এই উত্থান-পতন থেকে একধরনের মুক্তি। ভিন্ন কিছু ও প্রকৃতির জন্য কিছু করার তাড়না থেকে শুরু করা কোম্পানিটি আজ ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়েছে, যার পেছনে তাদের দৃঢ় বিশ্বাসও কাজ করেছে বলে মনে করেন তিনি। ফ্লামিনি বলেন, “এটি বিশ্বাসের ব্যাপার। আমি রসায়ন সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করেছি। আমি কোনো রসায়নবিদ নই। আইন নিয়ে মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, কিন্তু ফুটবলের জন্য এটি আমাকে ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু এখন আমি অনেক কিছু জানি এলএ (Levulinic Acid) এবং অবশ্যই এটির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে।”
তেলের বিকল্প হিসেবে এই ধরনের রাসায়নিক একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে যেতে তখনই সক্ষম হবে যখন এটির উৎপাদন ব্যয় কম হবে এবং এটি বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করা সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হবে। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করাই এখন জিএফবি কোম্পানিটির মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা কাজ করছে ইউনিভার্সিটি অব পিসা ও পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অব মিলানের সাথে।
ইতালির মিলানে থাকাকালে ফ্লামিনি এই কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেই ইতালির কাজের্তাতেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেভুলিনিক এসিড তৈরির প্ল্যান্ট। ২০১৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি, যা আজ সবুজ পৃথিবীর ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাচ্ছে গোটা দুনিয়াকে। লেভুলিনিক এসিড তৈরিতে জিএফবি ব্যবহার করে ঘাস, ভুট্টার খড়, কাঠ ইত্যাদি। জিএফবির নিজস্ব প্রযুক্তির প্ল্যান্টে বিভিন্ন রকমের জৈব পদার্থ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে সেলুলোজিক বর্জ্যও রয়েছে। এসব দ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে লেভুলিনিক এসিড, ফরমিক এসিড তৈরি করে জিএফবি, যা পরিবেশবান্ধব ও বাণিজ্যিক দুনিয়ার পথপ্রদর্শক। শক্তির বিকল্প উৎস হিসেবে লেভুলিনিক এসিড তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার এবং জিএফবি সেই সম্ভাবনার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে।
গেতাফের হয়ে ২০১৭/১৮ মৌসুমে মাত্র একটি ম্যাচ খেলা ফ্লামিনি নিজেকে এখনো একজন ফুটবলার হিসেবে দেখতেই ভালোবাসেন। তাই বিলিয়নিয়ার হওয়ার পরও ৩৪ বছর বয়সেও এখনও খেলে যাচ্ছেন ফুটবল এবং একই সাথে নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দুর্দান্ত গতিতে। ফুটবলের ব্যাপারে ফ্লামিনি বলেন, “একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমার অগ্রাধিকার ফুটবল।” তিনি মনে করেন, অনেক ফুটবলারের যেমন মাঠের বাইরে আগ্রহ থাকে, তেমনি তার আগ্রহ পরিবেশ বান্ধব অর্থনীতি।
৩টি এফএ কাপ, ১টি ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও ২টি ইংলিশ সুপার কাপজয়ী এই ফরাসী মিডফিল্ডারকে ফুটবল বিশ্ব এবং ফুটবলের বাইরের পৃথিবী অবশ্যই আলাদাভাবে দেখবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে এবং ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের জন্য পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ মানুষই যখন অশুভ প্রতিযোগিতায় মত্ত, তখন একজন ফুটবলারের এমন উদ্যোগ পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখার পথ খুলে দেয় অন্যান্যদের জন্য।
ফিচার ইমেজ- envirotop.hu