Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্মিথদের বল-টেম্পারিং কেলেঙ্কারিতে সরব বিশ্ব

নিজের পরিবারই যদি পায়ে ঠেলে দেয়, তাদের জায়গা হবে কোথায়? এ যেন গৃহে সর্বনাশের মতো। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অবস্থা এমনই হয়েছে। কেপ টাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিনে বল টেম্পারিং করতে গিয়ে টিভি ক্যামেরার কারণে হাতেনাতে ধরা খেলেন ক্যামেরন ব্যানক্রফট।

এমন প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে যেন ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ হলো অস্ট্রেলিয়া দলের। জানা গেল, অধিনায়কও-সহ-অধিনায়ক জড়িয়ে আছেন! অর্থাৎ, দলীয় ‘পাপ’ করেছে স্মিথরা। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) শাস্তি ঘোষণার আগেই স্বয়ং অস্ট্রেলিয়াতেই নিন্দা শুরু হল। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত স্মিথের অধিনায়কত্ব কেড়ে নিতে বললেন!

সাবেক ক্রিকেটারদের গঞ্জনা ততক্ষণে বিষবাক্যে রূপ নিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে স্মিথ-ব্যানক্রফটরাও স্বীকার করেছেন যে তারা বল টেম্পারিং করেছেন। এরপর থেকে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই বিপাকে আছেন অজি ক্রিকেটাররা। সঙ্গে যোগ হয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব জুড়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নিন্দা।

১.

ম্যাচে বল টেম্পারিংয়ের সময় প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ড্রেসিংরুম থেকে ওয়াকিটকিতে ডাগআউটের ক্রিকেটারকে কিছু একটা বলছেন কোচ ড্যারেন লেহম্যান। তারপর সেই অতিরিক্ত ক্রিকেটার মাঠে ঢোকার পর থেকেই বল টেম্পারিংয়ের কাজ শুরু করেন ব্যানক্রফট। হলুদ রঙয়ের শিরিষ কাগজ নিয়ে বলের একপ্রান্ত ঘষে ঘষে সেটা আবার পকেট থেকে নিয়ে ট্রাউজারের মধ্যে লুকোচ্ছিলেন তিনি। সবকিছুই ধরা পড়ে যায়।

সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক; Source: News.com.au

ঐদিনই সংবাদ সম্মেলনে সবকিছু স্বীকার করেছেন অধিনায়ক স্মিথ ও ব্যানক্রফট। তবে কোচ জড়িত কিনা সে ব্যাপারে মুখ খোলেননি তারা। শাস্তি হিসেবে আইসিসি স্মিথকে ওই ম্যাচের বাকি দু’দিন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পরের টেস্টেও নিষিদ্ধ করে। কেটে নেওয়া হয় শতভাগ ম্যাচ ফি। ব্যানক্রফটের নামের পাশে একসঙ্গে তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট ও ম্যাচ ফি’র ৭৫% কাটা হয়। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই শাস্তি প্রদান করেন আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন। তিনি সেখানে জানান, অস্ট্রেলিয়া এই কাজটি করেছে তাদের ‘লিডারশিপ গ্রুপ’ এর মাধ্যমে। অর্থাৎ, দলের কোচ থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফ, জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার, অধিনায়ক-সহ-অধিনায়ক সবাই জড়িত আছে।

ওটিস গিবসন, দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ; Source: APF

ঘটনার পর সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক চরম নিন্দা করেছেন উত্তরসূরিদের। দলের সবাই মিলে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেছে উল্লেখ করে ক্লার্ক বলেছেন, ”এটা এককথায় প্রতারণা। লজ্জাজনক ব্যাপার। একেবারেই নেওয়ার মতো নয়। এই অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলিং লাইনআপ আছে। তাদের প্রতারণা করে ম্যাচ জয়ের দরকার নেই!“

মাত্র ৮ টেস্ট ম্যাচ খেলা ক্যামেরন ব্যানক্রফটকে দিয়ে দলীয়ভাবে এই ঘৃণিত কাজ করানো হয়েছে দেখে হতাশ হয়েছেন ক্লার্ক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ”লিডারশিপ গ্রুপ এই কাজটা ৮ টেস্ট খেলানো এক ক্রিকেটারকে দিয়ে করিয়েছে, এটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি।”

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সকালে উঠে যখন খবরটা জানলাম, আমি খুব অবাক হয়েছি, হতাশ হয়েছি। আমাদের ক্রিকেটাররা প্রতারণা করেছে! তারা আমাদের রোল মডেল। তারা কিভাবে প্রতারণার সঙ্গে জড়াতে পারে! কিভাবে ব্যাগি ক্রিনের সম্মানহানি করতে পারে! আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে অধিনায়কসহ কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম আমাদের হাতে এসেছে।“

এ তো গেল অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা। ক্রিকেটের অন্যান্য দেশগুলোও যেন সুযোগ পেয়েছে এবার। অনেকে দাবি করছেন, অস্ট্রেলিয়া এখন থেকে বল টেম্পারিং করে না। অনেক আগে থেকেই করে। কিন্তু এবার প্রথম ধরা পড়ল বলে ব্যাপারটা চোখে লাগছে। অনেকে বলছেন, তারা হতাশ হয়েছেন স্মিথদের এই কাণ্ডে।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) স্টিভেন স্মিথের দল রাজস্থান রয়্যালসের কোচ জুবিন বারুচা বলেছেন, ”কেপ টাউনে যা হয়েছে তা পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে বিরক্ত করেছে। আমরা বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। স্মিথের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসলেই তা নিয়ে ভাবব।”

ক্যামেরায় বল টেম্পারিং করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর; Source: National

বল টেম্পারিংয়ের ঘটনার পর আইপিএলে নিজের দলের অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন স্মিথ। একই অবস্থা হয়েছে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের অধিনায়ক ওয়ার্নারের ক্ষেত্রেও। স্টিভেনকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে আইপিএলে তার কোচ বলেন, ”স্টিভেন বিশ্বাস করে এই মুহূর্তে আরসি’র অধিনায়কত্ব ছাড়াটা ভালো সিদ্ধান্ত।”

সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন স্মিথদের বল টেম্পারিংয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “অস্ট্রেলিয়ার এটা নতুন নয়। আমি নিশ্চিত, তারা অ্যাশেজ সিরিজেও বল টেম্পারিং করেছে। যদিও ইংল্যান্ডের ৪-০ তে হারের কারণ এটি নয়। অস্ট্রেলিয়া বল টেম্পারিং না করলেও সিরিজ হারতো ইংল্যান্ড।”

দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ ওটিস গিভসন ‘দোষীদের’ নিয়ে মুখ খুলেছেন। অস্ট্রেলিয়া এমন কাজের মাধ্যমে ভুল করেছে তা মানছেন তিনি। তার দাবি, প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্টে আগেই হতাশ হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দল। তাই এই কাজ করেছে।

তিনি বলেছেন, “আপনি যদি অ্যাশেজের দিকে তাকান, তারা কখনই ম্যাচের পিছনে ছিল না। সহজভাবে জিতে যেত। কিন্তু এখানে কয়েকবার তারা পিছিয়ে পড়েছে। এটা তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে। তারা যা করেছে খুবই লজ্জার ব্যাপার। বল প্রাকৃতিকভাবেই সুইং দিচ্ছিল। কিন্তু সবাই একটু বেশি সুইংয়ের জন্য বল টেম্পারিং করল। এটা দুর্ভাগ্যজনক।”

২.

কেপ টাউনের উত্তাপ এসে পড়েছে ঢাকাতেও। মিরপুরের ক্রিকেট পাড়ায় ওই ঘটনার পরদিন থেকেই একমাত্র ইস্যু ‘বল টেম্পারিং’। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার এমন কাজে অবাক হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ”বল টেম্পারিং আসলে স্পিরিট নষ্ট করে। এটা করা ঠিক না। স্পেশালি অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। এ জিনিসটা থেকে সব ক্রিকেটারেরই বিরত থাকা উচিত।“

এভাবেই বল টেম্পারিং করেছেন ক্যামেরন; Source: CricTracker.com

বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেছেন, ”অস্ট্রেলিয়ার কেউ আগে এমনটা করেনি এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এবার হয়তো ধরা পড়েছে বলেই এতো হৈচৈ হচ্ছে।”

বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ ও বর্তমানে জাতীয় দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ বল টেম্পারিং নিয়ে বলতে গিয়ে পুরনো অতীতকে ফিরিয়ে আনলেন। ঢাকা লিগের প্রসঙ্গে টেনে দাবি করলেন, অতীতে এই কাজ ঢাকা লিগে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা নিয়মিত করতো। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এটা কখনও করেনি, করছেও না।

তিনি বলেছেন, “আমরা সব সময় ফেয়ার ক্রিকেট খেলেছি। আমাদের এমন (টেম্পারিং করার) বিশেষজ্ঞও না-ই বলতে গেলে। বাংলাদেশ পাকিস্তানি অনেক খেলোয়াড় লিগ খেলতে আসত। ঢাকা লিগে এটা অনেক হতো। অনেক অভিযোগ ছিল এটা নিয়ে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখবেন যে কোনো বোলার প্রথম ৫ ওভারে ৪০ রান দিত, পরে ৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে নিত। বল রিভার্স হতো এই কারণে। পাকিস্তানিরা যখনই আসত এটা হতো। কিন্তু এখন যেটা হলো আসলে খুবই দুঃখজনক। অস্ট্রেলিয়ার মতো এত বড় দল, তাদের কেন এসব করতে হবে। মিনোস বা আমরা করলে কি হতো জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের কাউকে আমি দেখিনি আসলে।’

অস্ট্রেলিয়ার ঘটনায় হতাশ মাশরাফি-সুজন; Source: Daily Star

সুজন মনে করেন, বল টেম্পারিং এখন খেলার একটা অংশ হয়ে গেছে। এর দায় দিলেন কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের।

বিদেশে যা-ই হোক, বাংলাদেশে এটা হয়নি বলে গর্বিত সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। তিনি বলেছেন, “যারা খেলছে, তারা খুবই সচেতন। সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নেয়। নেতিবাচক কিছু করে জেতার মানসিকতা নেই এবং থাকবেও না এই বিশ্বাস করি। বোর্ডের তাই আলাদা করে সচেতন হওয়ার দরকার নেই।”

দুনিয়াজুড়ে যখন এমন নিন্দার বাতাস, তখন স্মিথ-লেহম্যান-ওয়ার্নার-ব্যানক্রফটরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন এটাই স্বাভাবিক। গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক কেভিন পিটারসেনের মতো পরিণতি হতে পারে ওয়ার্নারের। এছাড়া দায়িত্ব ছাড়ার খুব কাছেই আছেন কোচ লেহম্যান। স্মিথ আছেন সবচেয়ে বিপদে। কারণ, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নীতিমালাতেই আছে, বল টেম্পারিংয়ের মতো অপরাধে আজীবন নিষিদ্ধ হতে পারে।

যত যা-ই হোক, অস্ট্রেলিয়ার এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকে। সাবেকরা বেঁচে গেছেন অনেক দায় থেকে। বর্তমানদের জন্য এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর হতে পারে না। ‘ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট’- এই প্রবাদকে রক্ষা করতে ভবিষ্যতেও যেন এমনটা না হয় সেই চেষ্টা হয়তো চালিয়ে যাবে নতুনরাও।

ফিচার ইমেজ- DNA

Related Articles