![](https://assets.roar.media/assets/AT8powWBCafA5vI4_gettyimages-1158212585-612x612.jpg?w=1200)
‘তামিম জানে তার কাজটা কী। আমাদের কথা হবে, আমরা মনে করি তার আরও দুটি (পাওয়ার প্লেতে) বাউন্ডারি দরকার। সে এটা কীভাবে করবে আর তার অ্যাপ্রোচ কেমন থাকবে, সেটা তার ব্যাপার। কেউ তামিমের হয়ে ব্যাটিং করবে না। তারটা তাকেই করতে হবে।’
২০২০ সালেই জিম্বাবুয়ে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাঠে নামার আগে মিডিয়াকে এমনটাই বলেছিলেন তখনকার ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জি। ইঙ্গিতটা ছিল পরিষ্কার, ম্যাচের শুরুতে তামিম যদি ধরে না খেলেন তাহলে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ড নাকি বেশিদূর গড়াবেই না – বহুল আলোচিত এই ‘অ্যাঙ্করিং রোল’ বলতে যেটা প্রচলিত আছে ক্রিকেট পাড়ায়, তামিমকে হয়তো এমন বিশেষ কোনো নির্দেশনা দলের পক্ষ থেকে দেওয়া ছিল না। তবে বিভিন্নভাবে বারবারই এই ‘অ্যাঙ্করিং’ বিষয়টা বারবার উঠে এসেছে প্রেস কনফারেন্সে, সাক্ষাৎকারে, কিংবা বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এমন নির্দেশনা আদৌ ছিল কি না, সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটে এই ‘অ্যাঙ্করিং’ টার্মটা আসলেই কতটুকু যৌক্তিক? কিংবা একপ্রান্তে ধরে খেলে অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানের ওপর চাপ বাড়ানোটাও বা কতটুকু স্বাভাবিক? বাংলাদেশই এতে কতটুকু লাভবান হচ্ছে?
![](https://assets.roar.media/assets/T41qXUDUCSBBdzwQ_e878edb4-1a92-4962-822a-d4784ffbe865.jpg)
অ্যাঙ্করিংয়ের পরিসংখ্যান
২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে আফগানিস্তান সিরিজের শেষ ম্যাচ অব্দি তামিম ইকবাল ওয়ানডে খেলেছেন মোট ৪৭টি। এই ৪৭ ওয়ানডেতে যদি আমরা প্রথম দশ ওভারের পরিসংখ্যান তুলে ধরি, তাহলে আমরা দেখতে পাব, এই ৪৭ ম্যাচে প্রথম দশ ওভারে তামিম ইকবালের স্ট্রাইকরেট ছিল মাত্র ৬৮। এমনকি নিজের খেলা ১,১১৮ বলের মধ্যে ৬৫.৬% বল তিনি ডট খেলেছেন। আধুনিক ক্রিকেটের হিসেবে একজন ওপেনারের ওয়ানডেতে প্রথম দশ ওভারের পাওয়ারপ্লে চলার সময় এত বেশি পরিমাণ ডট খেলার ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও দলের জন্যে ভালো কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু যেহেতু তামিম ইকবাল ‘অ্যাংকরিং’ করেন, সেক্ষেত্রে প্রথম দশ ওভারে তামিম ইকবালের এই ধীরে খেলার ব্যাপারটা যদি আমরা স্বাভাবিক হিসেবেও ধরে নিই, তাহলে নিশ্চয়ই ম্যাচের শেষ দিকে তামিম এই ডট খেলাটা পুষিয়ে দেবেন?
![](https://assets.roar.media/assets/zJuAcSgRuEq0MMaZ_10-over.jpg)
কিন্তু না, তামিম ইকবাল কিন্তু দলকে এখানেও সুবিধা দিতে ব্যর্থ। এগারো থেকে পঞ্চাশ ওভারের পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাব, এই সময়ে ২০১৮ সাল থেকে এই অব্দি তামিমের স্ট্রাইকরেট ছিল ৮৮.৩, নিজের খেলা ১,৩০৯ বলের ৪৫.৯% বলই তিনি খেলেছেন ডট। ওহ আরেকটি কথা, ২০১৮ সাল থেকে এই অব্দি যে ৪৭ ওয়ানডেতে মাঠে নেমেছেন তামিম, সেখানেও কিন্তু ২১ বারই তিনি বিদায় নিয়েছেন ম্যাচের প্রথম দশ ওভারের মধ্যেই।
![](https://assets.roar.media/assets/OwRulygGwq5iU3GJ_11-50.jpg)
এবার যদি আমরা ওভারভিত্তিক তামিমের স্ট্রাইক রেট ও ডট বল খেলার হার দেখি তাহলে সেই চিত্রটা হল-
-
০-১০ ওভার: ৬৮.০ স্ট্রাইকরেটে ৬৫.৬% ডট বল (৪৭ ইনিংস)
-
১১-২০ ওভার: ৭৪.২ স্ট্রাইকরেটে ৫১.২% ডট বল (২৫ ইনিংস)
-
২১-৩০ ওভার: ৯০.১ স্ট্রাইকরেটে ৪৬.৪% ডট বল (১৮ ইনিংস)
-
৩১-৪০ ওভার: ১১০.৮ স্ট্রাইকরেটে ৩১.৯% ডট বল (৮ ইনিংস)
-
৪১-৫০ ওভার: ১৬১.০ স্ট্রাইকরেটে ২৫.৪% ডট বল (৪ ইনিংস)
এবার যদি আমরা উপরের তথ্যগুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, তামিম ইকবাল ইনিংসের শুরুতে ধীরে খেললেও ৩০ ওভারের আগে তামিমের স্ট্রাইকরেট কিন্তু একশ পার করছে না। এখানেও কোনো সমস্যা ছিল না, যদি আমরা দেখত পেতাম তামিম নিয়মিত দীর্ঘ সময় ব্যাটিং করছেন। কিন্তু ৪৭ ইনিংসের মধ্যে ‘অ্যাংকরিং’ করতে নামা তামিম ইকবাল মাত্র ৮ ইনিংস ৩০ ওভারের পর অব্দি টিকে ছিলেন। সেক্ষেত্রে শুরুতে ধীরে খেলে পরে পুষিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও কিন্তু খাটছে না, কারণ তামিম ইকবাল ঐ অব্দি টিকতেই পারছেন না!
এখানেই ঘুরে ফিরে আসে, সেই প্রশ্নটা – তামিম ইকবালের অ্যাঙ্করিংয়ে কতটা লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ? প্রথম ম্যাচের প্রথম দশ ওভারে তামিম ইকবালের স্ট্রাইকরেট ও ডট বল খেলার হার আধুনিক ক্রিকেটের সাথে একদমই যায় না। যদি আমরা ধরে নিই, তামিম ইকবাল প্রথম দিকে ধীরে খেলে পরে পুষিয়ে দেবেন, সেটাও কিন্তু হচ্ছে না। দশ ওভার পার হওয়ার পরও কিন্তু তামিম ইকবালের স্ট্রাইকরেট কিংবা ডট বল কম খেলার ব্যাপারে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আরো বড় ব্যাপার, প্রথম দিকে ডট খেলে তামিম ইকবাল আসলে ম্যাচের শেষ অব্দি টিকতেই পারছে না। এতে করে তামিম ইকবালের ধীরে খেলার ‘অ্যাঙ্করিং’-এর চাপ নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ও তামিম ইকবাল – কেউই এতে খুব একটা লাভবান হচ্ছে না।
![](https://assets.roar.media/assets/k4MsqcLXmkrAdJiS_gettyimages-1309185025-612x612.jpg)
ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান দলকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন, রান করার মাধ্যমে। সেই রান তিনি কীভাবে করছেন, সেটার চাইতে বড় কথা সেই রানে দলের উপকার হচ্ছে কি না। আমরা যদি নিচের গ্রাফের দিকে তাকাই, তাহলে সালভিত্তিক রানের ক্ষেত্রে তামিম ইকবাল আর আইরিশ ওপেনার পল স্টারলিংয়ের মাঝে একটা তুলনা দেখতে পাব। সেই তুলনাতে আমরা দেখতে পাব, তামিম ইকবালের রানের গ্রাফ সবসময়ই পল স্টার্লিংয়ের চাইতে নিচের দিকেই থেকে গেছে।
![](https://assets.roar.media/assets/3XtZgwnIyKDNb9vd_tamim-vs-paul-runs-year.jpg)
তামিম ও বাংলাদেশের অন্যান্য ওপেনার
![](https://assets.roar.media/assets/on2b4ZnzCRvuiBkQ_tamim-desh-opener-matrix.jpg)
এখানে ১লা জানুয়ারি ২০১৮ সাল থেকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে অব্দি যেসব ক্রিকেটার বাংলাদেশের হয়ে ওপেনিং করতে নেমেছে, তাদের একটা গ্রাফ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে ওপেন করতে নামা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে একাদশ ওভার থেকে স্ট্রাইক রেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দশ ওভারের পরে বাংলাদেশের হয়ে ওপেন করতে নামা খেলোয়াড়দের মধ্যে সবার স্ট্রাইক রেটই তামিম ইকবালের চাইতে বেশি। এর মধ্যে তামিম ইকবালের চাইতে কম স্ট্রাইক রেট আছে কেবল আনামুল হক বিজয় ও মেহেদি হাসান মিরাজের। মেহেদি হাসান মিরাজ আবার প্রতিষ্ঠিত ওপেনার নন। আবার অন্যদিকে আনামুল হক বিজয়কে দল থেকে বাদ দেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তার স্ট্রাইকরেট। কিন্তু বহাল তবিয়তে আছেন তামিম ইকবাল।
পেস ও স্পিনে তামিম ইকবাল
আবার তামিম ইকবাল যদি অ্যাংকরিং করতে চান, তাহলে তো তামিম ইকবালকে পেস এবং স্পিন দুটোর বিরুদ্ধেই সমান পারদর্শী হতে হবে। কেননা, ইনিংসের শুরুতে পেস বোলিংয়ের মুখোমুখি হতে হলেও মাঝের দিকে তাকে সামলাতে হবে স্পিনের ঘূর্ণি। সেখানেও যদি আমরা গত তিন বছরের পরিসংখ্যান দেখতে চাই, তাহলে দেখতে পাব –
২০১৮ সাল থেকে পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে তামিমের স্ট্রাইক রেট ও ডট খেলার হার:
-
০-১০ ওভার: ৭০.১ স্ট্রাইক রেটে ৫৪.৬% ডট বল (৭৭৭ বল মুখোমুখি)
-
১১-২০ ওভার: ৮১.১ স্ট্রাইক রেটে ৪৭.৩% ডট বল (৩২৮ বল মুখোমুখি)
-
২১-৩০ ওভার: ১০৮.৮ স্ট্রাইক রেটে ৩৭.৫% ডট বল (১৩৬ বল মুখোমুখি)
-
৩১-৪০ ওভার: ১২০ স্ট্রাইক রেটে ২৫% ডট বল (৮০ বল মুখোমুখি)
-
৪১-৫০ ওভার: ১৮৫.৪ স্ট্রাইক রেটে ২৪.৪% ডট বল (৪১ বল মুখোমুখি)
এখানে, শেষ পরিসংখ্যানটা আকর্ষণীয় লাগলেও জানিয়ে রাখি, গত তিন বছরে মাত্র ৪ ইনিংসে তামিম ইকবাল ৪১ ওভারের পরে টিকে ছিলেন!
২০১৮ সাল থেকে স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে তামিমের স্ট্রাইক রেট ও ডট খেলার হার:
-
০-১০ ওভার: ৪৯.৩ স্ট্রাইক রেটে ৬৫.৮% ডট বল (১৫২ বল মুখোমুখি)
-
১১-২০ ওভার: ৬৪.৬ স্ট্রাইক রেটে ৫৬.৭% ডট বল (২৭৭ বল মুখোমুখি)
-
২১-৩০ ওভার: ৮২.৩ স্ট্রাইক রেটে ৪৯.৮% ডট বল (২৯৩ বল মুখোমুখি)
-
৩১-৪০ ওভার: ১০২.৩ স্ট্রাইক রেটে ৩৮.৪% ডট বল (৮৬ বল মুখোমুখি)
-
৪১-৫০ ওভার: ১০৫.৬ স্ট্রাইক রেটে ২৭.৮% ডট বল (১৮ বল মুখোমুখি)
এবার এই পেস আর স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে তামিমের পারফরম্যান্সগুলিকে দেখা যাক। তামিম ইকবাল যেহেতু অ্যাঙ্করিং করে দীর্ঘ সময়ে টিকে থাকতে চান, তার মানে ইনিংসের মাঝের দিকে তাকে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাট করতে হবে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, স্পিনের বিপক্ষে তামিম ইকবালের স্ট্রাইকরেট যথেষ্টই করুণ। তাহলে হিসেব অনুযায়ী, প্রথমে ডট দিলেও ইনিংসের মাঝপথে তামিম ইকবালের স্ট্রাইকরেট বাড়িয়ে বেশি রান তোলার কথা। আর মাঝের দিকে যেহেতু বেশিরভাগ সময়ই স্পিন বল সামলাতে হয়, তাই স্পিনের বিপক্ষেই তামিমের রানের গতি বেশি থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, মাঝের ওভারে স্পিনের বিপক্ষে তামিমের পারফরম্যান্স খুব একটা সুবিধাজনক নয়। এক্ষেত্রে তামিমের ‘অ্যাঙ্করিং’ এর আইডিয়া ঠিক কতটা ফলপ্রসূ, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
আমরা আজকে দেখতে চাইছিলাম, তামিম ইকবালের অ্যাংকরিংয়ের আইডিয়া ওয়ানডে ক্রিকেটে কতটা ঠিক? প্রশ্নটার উত্তর কতটুকু দেওয়া গেল, সেটা পাঠকই বলতে পারবেন। তবে পরিসংখ্যানভিত্তিক কিছু আলোচনা করা গেল, সেটাই বা মন্দ কী!