Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অমরত্বের অপেক্ষায় মার্সেলো লিপ্পি

ইতিহাসে ব্রাজিলের স্থান যদি হয় অনিন্দ্যশৈলীর ফুটবলার তৈরির জন্য, তবে ইতালির স্থান হবে কোচদের পীঠস্থান হিসেবে। ফুটবল জগতে একটা কথা মাঝে মাঝেই বলা হয় যে, ‘ইতালির ইতিহাসে কে সেরা কোচ তা নির্ণয় করো, ব্যস! বিশ্বসেরা কোচের নামও বোনাস হিসেবে পেয়ে যাবে!’ 

একসময় লাতিন আমেরিকার দলগুলো ভাল ট্যাকটিশিয়ানের অভাব বোধ করতো। তখন ওরা আক্ষেপ করে বলতো যে, ইতালির যুবদলের কোচেরাও নাকি অনেক লাতিন দেশের কোচদের চেয়ে ভাল! ইতালিয়ান ফুটবল মানেই ট্যাকটিক্স, ইতালিয়ান ফুটবলের শুরু আর শেষ কথা এই ট্যাকটিক্সই। ঠিক তেমনই একজন মহীরূহ ট্যাকটিশিয়ান ২০০৬ এর বিশ্বকাপজয়ী কোচ মার্সেলো লিপ্পি।  পুরো লেখাটাতেই থাকবে কেবল সাফল্যের গল্প, আর একই সমান্তরালে চোরাগুপ্তা কিছু ব্যর্থতার। লেখার যবনিকায় দেখা যাবে অসাধারণ সাফল্য আর চিরশ্রেষ্ঠত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে সেই চোরাগোপ্তা ব্যর্থতাগুলো।

আজকালকার যুগে সেরা কোচ মানেই তিনি হবেন কম ট্যাকটিক্যাল, বিনয়ী গোছের, সুন্দর ফুটবলের ধারক বা খেলোয়াড়দের সাথে তার সুসম্পর্ক থাকবে। খেলোয়াড়দের কথা মাথায় রেখেই হবে তার রণকৌশল। কিন্তু ইতালিয়ান অধিকাংশ জাঁদরেল কোচই এমন ছিলেন না।

প্রথমে তাকেই একটু উদ্ধৃত করা যাক। চার্চিলকে নিয়ে বলা হয় যে, বিশ্বযুদ্ধের প্ল্যান করতে করতে নাকি দশদিনে অর্ধেক চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। লিপ্পিও নিজেকে নিয়েই একবার বলেছিলেন,

“ফুটবলে আসার আগে আমার চুল কালোই ছিল, তবে কোচিং এ আসার পর চার বছরেই সব পেকে যায়!”

এই ছিলেন লিপ্পি । তার সহজ ফুটবল বা সুন্দর ফুটবলের দর্শনে রোমান্টিসিজম ছিল না। তার আসল দর্শনই ছিল বিজয়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, নব্বই এর দশকের সবচেয়ে শক্ত দল ছিল তার জুভেন্টাস।

“I romance with only winning, not with a sole tactics or philosophy.”

মার্সেলো লিপ্পি; Image Source: JuveFC

শুরুর জীবন

অধিকাংশ সফল কোচদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের খেলোয়াড়ি জীবন হয় খুব সাদামাটা। লিপ্পিরও খেলোয়াড়ি জীবন ছিল কোচিং জীবনের তুলনায় নগন্য। মূলত দ্বিতীয় বিভাগের ছোটখাটো দলেই কাটে তার খেলোয়াড়ি জীবন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা বলতে গেলে, মাত্র দুই মৌসুম সিরি ‘আ’র মধ্যম সারির দল সাম্পাদোরিয়ার হয়ে খেলা।

কোচিং ক্যারিয়ারও শুরু হয় ধীর গতিতে। বিভিন্ন ক্লাবের যুবদলগুলোতে কোচিং করিয়েই যাচ্ছিলেন। না কোনো ব্রেক-থ্রু পাচ্ছিলেন, না কোথাও হচ্ছিলো কোচিংয়ের ইনিংসটা দীর্ঘস্থায়ী। শেষ অবধি তারই সাবেক ক্লাব সাম্পাদোরিয়া তাকে কিছুটা সময় দেয় দেয়। সাম্পাদোরিয়ায় তার সময়কালের খেলানোর ধরন দেখে আটলান্টা তাকে নিয়োগ দেয়। এরপর আরো কিছু ক্লাবের পরও খুব একটা সাফল্য ছিল না।

কিন্তু প্রতিভাটা প্রথম ধরতে পারেন আরেক দক্ষ জহুরী লুসিয়ানো মজ্জি। ‘ক্যালসিওপলি স্ক্যান্ডাল’-এর এই হোতা বর্তমানে আজীবন বহিস্কৃত এই স্পোটিং ডিরেক্টর তখন নাপোলিতে ম্যারাডোনাকে এনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কিন্তু ম্যারাডোনা যাওয়ার পর নানা কারণে হঠাত্‍ নাপোলি অর্থসংকটে পড়ে যায়। শুরু হয় ক্লাবটির দৈন্যদশা। অবনমনের খড়্গের মুখে থাকা ক্লাবটি ততদিনে আর বড় কোনো ক্লাব নয় ইতালিয়ান লিগে। নাপোলি খুব কম বেতনে নিয়োগ দিল লিপ্পিকে।

যদি পুরো নাপোলিতে তার সময়কাল দেখা হয়, তবে বিস্ময়কর ঠেকবে যে, কী এমন সাফল্য যার বলে পরবর্তীতে তাকে জুভেন্টাস নিয়োগ দেয়! তিন বছরে মাত্র একবার ইউরোপিয়ান সুপার কাপে খেলার সুযোগ করে দেয়া – এই ছিল তার নাপোলি ক্যারিয়ারের সাফল্য। কিন্তু সেই নাপোলি দল ছিল অবনমনের যোগ্য দল, সেখান থেকে লিগ টেবিলের উপরের দিকে টেনে আনাটা বড় দলগুলোর চোখ এড়ায়নি। নাপোলিতে সেই সময়কার খেলোয়াড়রা নানাবিধ মাঠের বাইরের বিতর্ক, ড্রাগ-মাফিয়াদের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু লিপ্পির হিসেব ছিল সোজা – শুধুই ফুটবল। কঠোর হাতে পুরো ক্লাবেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সীমিত সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার আর দল পরিচালনায় কঠোরতা দেখেই জুভেন্টাস প্রেসিডেন্ট বুঝে যান, একেই দরকার তার জুভেন্টাসের। 

নাপোলিতেই প্রথম নিজের আগমন জানান দেন লিপ্পি
নাপোলিতেই প্রথম নিজের জাত চেনান লিপ্পি; Image Source: La Repubblica Napoli

জুভেন্টাসে শুরু সাফল্যের মূল যাত্রা

জুভেন্টাসের সাথে ইন্টার মিলানও ইচ্ছুক ছিল তাকে বাগানোর জন্য। তবে জুভেন্টাসই শেষমেশ বাগিয়ে নেয় লিপ্পিকে। এবার তার অমরত্বের যাত্রার শুরু।

লিপ্পি আসার আগের আটবছরে তখন জুভেন্তাসের কোন লীগ শিরোপা নেই। থাকবে কীভাবে? এসি মিলানে ইতালির সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ সাচ্চির আধিপত্যের পর ম্যারাডোনার নাপোলির বিজয়রথ, এর আগে ও পরে এসি মিলানে সর্বকালের সেরাদের দৌঁড়ে থাকা আরেকজন মহীরুহ ফ্যাবিও ক্যাপেলোর টানা আধিপত্য। কোনো এক অসাধারণ প্রতিভাকেই লাগতো জুভেন্তাসের দুর্দিন ঘোচাতে।

যোগ দিয়েই নয় বছর পর প্রথমবারের মতো লিগ ও ঘরোয়া কাপসহ ডাবল জেতান, বলা চলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মিলানের নাকের ডগা দিয়েই। স্যার আলেক্স ফার্গুসনের বায়োগ্রাফিতে বলা আছে,

“আমি ড্রেসিংরূমে প্লেয়ারদের লিপ্পির জুভেন্টাসের ভিডিও দেখাতাম। বলতাম, ট্যাকটিক্স দেখার দরকার নেই, ধন্দে পড়ে যাবে। কেবল দেখাতাম, একটা টিম কতটা মানসিকভাবে শক্ত হতে পারে।”

লিপ্পির জুভেন্টাস ছিল ডিফেন্সিভলি দারুণ শক্ত। দলের ভিত্তিটা ছিল লিপ্পির নিজের মানসিকতার মতোই। সেবার মিলানের চেয়ে ১৩ পয়েন্ট এগিয়ে জেতে জুভেন্টাস। মাঝমাঠে ছিলেন ‘দ্য বুল’ খ্যাত কন্তে আর দিদিয়ের দেশম। অনেকের কাছে সেই মাঝমাঠ পার হওয়াই নাকি ছিল গোল করার সবচেয়ে শক্ত ধাপ। প্রথম মৌসুমেই হয়তো ‘ট্রেবল’ জেতা হয়ে যেত লিপ্পির, কিন্তু অধুনালুপ্ত ইউরো কাপ তথা হালের ইউরোপা লিগের ফাইনালে উঠেও হেরে যান পার্মার কাছে।

নয় বছর পর প্রথম লিগ জেতানোয় জুভেন্টাসের যেকোনো কৌশল প্রণয়নে একচ্ছত্রাধিপত্য পেয়ে যান তিনি। কিন্তু এবার দিলেন অন্য এক চাল। চাইলেই কিনতে পারতেন সেই আমলের সবচেয়ে বড় বড় তারকাদের। কিন্তু তা না করে তিনি তুলে আনলেন দেল পিয়েরোদের মতো যুব একাডেমির খেলোয়াড়দের। নিয়ে আসেন সদ্য উঠে আসা জিনেদিন জিদান, ভিল্লাই, এদগার ডেভিসের মতো তরুণ খেলোয়াড়দের, যারা পরের দশকে কাঁপিয়েছেন ইতালি তথা ইউরোপকে। পরের মৌসুমে ইতালি পেরিয়ে জুভেন্তাসের হার না মানা ফুটবলের সাথে পরিচিত হয় ইউরোপ। আয়াক্সকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে নেয় জুভেন্টাস। পুরো ব্যর্থ একটা দলকে দুই বছরের মধ্যে লিগ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ঘরোয়া কাপ সব জেতান লিপ্পি। পরের বছর ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে আবারও লিগ শিরোপা জেতান জুভেন্টাসকে। ‘৮৮ থেকে চলা মিলানের আধিপত্যের যতি টানেন এই শুক্লকেশ ট্যাকটিশিয়ান। ঠিক এরপর থেকে এখনবধি আর মিলান লীগে ধারাবাহিক হতে পারেনি। এর প্রথম ধাক্কাটা ছিল লিপ্পিরই দেয়া। ঐ জুভেন্টাস আসলেই অন্য পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জিদান-ইনজাঘি-পিয়েরো ত্রয়ী, সাথে কন্তে-দেশমের ইস্পাত-দৃঢ় মাঝমাঠ। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগে সেই আমলের ফার্গুসনের ম্যানইউ, ভন হালের আয়াক্সকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় জুভেন্তাস। সবাই ভাবছিল, টানা দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফিটা তুরিনেই যাচ্ছে। কিন্তু অটোমার হিজফেল্ড নামের একজন তখন ডর্টমুন্ডকে নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন। ফাইনালে লিপ্পিকে তার ঔষুধেই বধ করলো ডর্টমুন্ড।

একই ফ্রেমে জিদান ও লিপ্পি; Image Source: Twitter

দোর্দণ্ড প্রতাপের এসি মিলান, ইন্টার মিলান, ফিওরেন্তিনার দাপটকে লিপ্পির জুভেন্তাস এমনভাবে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল যে, ‘৯৮ এর লিগটাও অনুমিতই ছিল যে জুভেন্টাসই জিততে চলেছে। সেবার মৌসুম শেষ হতে চার ম্যাচ বাকি। ইন্টারের তখন ভালো ফর্ম, পয়েন্ট টেবিলে এক পয়েন্ট পিছিয়ে জুভেন্টাস। বলে রাখা ভালো, ইন্টারের চিরশত্রু হলো জুভেন্টাস। ইন্টারকে তাদের মাঠে হারিয়েই লিগটা জিতে নেয় তারা, হয়তো এর চেয়ে বেশি খুশির কিছু ছিল না জুভেন্টাসের সমর্থকদের জন্য। ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমেও দাপটের সাথে জুভেন্টাস উঠে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। অর্থাৎ, টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে লিপ্পির জুভেন্টাস। অদম্য এক জুভেন্টাসের সামনে ঘরোয়া বা ইউরোপিয়ান জায়ান্ট – সবাই অসহায়।

ফাইনালে প্রতিপক্ষ ৩২ বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বঞ্চিত রিয়াল মাদ্রিদ, যারা ঘরোয়া লিগে পঞ্চম হয়ে ফাইনালে আসে এটা মাথায় রেখে যে হারলে ছাল থাকবে না, অন্যদিকে সদ্য লিগ জয়ে তৃপ্ত জুভেন্টাস। রিয়ালের সেই দলটা ছিল বেশ দারুণ একটা ধাঁচে গড়া; সেই দলটা ক্যাপেলো গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আর হেইংকেস সেটায় প্রায় নতুন কিছু দেননি মানসিকতাটা ছাড়া।

সেই ফাইনালকে ট্র্যাজেডি বলা যায় ট্যাকটিক্সের দিক থেকে। ট্যাকটিক্সের দিক থেকে লিপ্পি হারিয়ে দিয়েছিলেন হেইংকেসকে। কিন্তু রিয়ালের ডিফেন্ডার ফার্নান্দো হিয়েরো হয়তো তার জীবনের সেরাটা খেললেন। দেল পিয়েরো আর ইনজাঘিকে প্রায় একাই আটকালেন। প্রায় স্রোতের বিপরীতে কার্লোসের বানানো বল থেকে ভাগ্যক্রমে একটা গোল করে বসে রিয়াল। আর ফিরে আসা হয়নি। মরিয়েন্তেসকে ফোকাল পয়েন্ট করে রাউলকে বাইরে খেলানোর কৌশলকে মাঠেই হারিয়ে দিয়েছিল লিপ্পির ৪-১-২-২-১, কিন্তু পারেননি হিয়েরোর রক্ষণ দেয়ালকে ভাঙতে। ফলাফল, আবারও শিরোপাবঞ্চিত হলো জুভেন্টাস।

জুভেন্টাস ত্যাগ, ব্যর্থতা এবং প্রত্যাবর্তন

বোর্ডের সাথে সমস্যা বাঁধলো, ছোটখাটোই বলা যায়। কিন্তু এত এত সাফল্য এনে দেয়া কোচ নিজের হাত থেকে জুভদের ছেড়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টারে গেলেন! ভীমরতি যাকে বলে।

ইন্টারে তার প্রতিটা পদক্ষেপ আতশকাঁচের নিচে ধরা হতো। সাফল্যের সুবাস পেতে পারতেন, ল্যাজিওর কাছে কোপা ইতালিয়ার ফাইনালে হেরে যান শেষ মুহূর্তে। এটা জিতলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতেও পারতো। বলে রাখা ভাল, লিপ্পি ক্লাব ছাড়ার পর তারই সাবেক সর্বজয়ী জুভেন্টাস লিগে ছিল সপ্তম স্থানে! এটাই ছিল  তাঁর ‘আফটার ইফেক্ট’ এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ইন্টারের লিপ্পি পাচ্ছিলেন না তার আগের সেই একচ্ছত্রাধিপত্য। জুভেন্টাসে যখন তিনি যোগ দেন, ব্যাজ্জিও ছিলেন জুভেন্টাস তথা ইতালির সবচেয়ে বড় তারকা। তিনি নিজের তারকাখ্যাতির মোহে এমনই মোহাবিষ্ট ছিলেন যে লিপ্পি এসেই তাকে বিক্রি করে দেন এই ভেবে যে, খেলোয়াড় দলের চেয়ে বড় হতে পারেন না। অন্যদিকে, সেই সময় জুভেন্তাস ছিল ব্যাজ্জিও-নির্ভর। ফলে তাঁকে ছেড়ে দেয়ায় জুভেন্তাস দলগতভাবে খেলার সুযোগ পায়। এই জিনিসটা ইন্টারে করতে পারলেন না। ইন্টার কর্তৃপক্ষ তাকে এতটা ক্ষমতা দিল না। ইন্টার বুঝে গেল, লিপ্পিকে দিয়ে তাদের হবে না। আর জুভ বুঝল, লিপ্পিকে ছাড়া তাদের হবে না। ইন্টার তাকে বরখাস্ত করল, আর দুই সপ্তাহ পর ঘরের বুড়োকে ঘরেই নিয়ে গেল জুভ!

একই ফ্রেমে কার্লো আনচেলোত্তি ও লিপ্পি; Image Source: Eurosports

এক বছর সময় নিলেন লিপ্পি। জিদান তখন জুভেন্টাস ছেড়ে চলে যান রিয়ালে। আবার নতুন করে গড়ে তোলার পালা তারই আগের সাম্রাজ্যের। তখন ক্যাপেলো রোমায় এসেই আঠার বছর পর জেতান লিগ। বনে তখন দুই বাঘ, লিপ্পি আর ক্যাপেলো! ক্যাপেলো তখন আগে লিপ্পিকে হারিয়ে দু’বার লিগ জিতেছেন, বিপরীতে লিপ্পি একবার।

বাতিস্তুতা-টট্টিকে নিয়ে ক্যাপেলোর রোমা অদম্য, আর ঐদিকে ইনজাঘি পিয়েরোকে নিয়ে লিপ্পি। সিরি-আ দেখল স্মরণকালের সেরা ট্যাকটিকাল প্রতিযোগিতা। সমানে সমানে যুঝতে থাকা ক্যাপেলোর রোমাকে কেবল এক পয়েন্টে হারিয়ে ইতালির ইতিহাসের সর্বোত্তম দুই কোচ ব্যক্তিগত দ্বৈরথের সমতায় এলেন। জিদান চলে যাওয়ার পরবর্তীতে ফ্যাবিও ক্যাপেলোর উদীয়মান দলকে হারিয়ে যে গতিটা পায় জুভেন্টাস, তা আর রোখার সাধ্য ছিল না কারো। এর পরেরবার আবার লিগ জিতে যায় জুভেন্টাস, বলা চলে অনেকটা হেলাফেলায়ই! দুই মিলানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিগে একক আধিপত্য তুলে নেয় জুভেন্টাস। ‘০৩ সালে লিগ জিতেই থেমে থাকেনি জুভেন্টাস, আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে উঠে যায়, এবার প্রতিপক্ষ মিলান। 

দ্বিতীয় মেয়াদে লিপ্পি জুভেন্টাসের দায়িত্ব নেন কার্লো আনচেলোত্তির কাছ থেকে। কার্লো ছিলেন জুভেন্টাসে ব্যর্থ। ২০০৩ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে সেই কার্লো আনচেলোত্তির এসি মিলানের সাথেই দেখা। মিলানের তখন নতুন বসন্ত, আর কার্লোর চোখে প্রতিশোধের নেশা। পর্তুগিজ সোনালি প্রজন্মের কস্তা-সিডর্ফদের মিডফিল্ড আর শেভচেঙ্কোদের নিয়ে কার্লোর ‘ডায়মন্ড ফর্মেশন’, সাথে জিদান-নেদভেদবিহীন লিপ্পির জুভেন্টাস। সেই জুভেন্টাস ততদিনে আর আগের অদম্য পর্যায়ে ছিল না। লিপ্পি বুঝে গিয়েছিলেন, সেই মিলানকে আটকানো কঠিন। হারাতে গেলে ভাগ্যের ছোঁয়াও চাই, অর্থাত্‍ টাইব্রেক। হঠাত্‍ই ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে এনে মিডফিল্ডকে ফ্ল্যাট করে দেন। শুরু হয় ‘গেগেনপ্রেসিং’, ঠিক যে কৌশলে আজকের ক্লপের দল বাজিমাত করে দিচ্ছে। বিরক্তিকর আর জঘন্যতম এক ফাইনালের ১৮০ মিনিটের পর টাইব্রেকে আর সেই ভাগ্যটা পাননি লিপ্পি। আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগে ফাইনালে লিপ্পির হার। চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগে ফাইনালে উঠে তিনবারই হার। 

বিশ্বজয়ী লিপ্পি; Image Source: Flickr

অমরত্বের শেষ ধাপ

সবচেয়ে মাহাত্ম্যময় কাহিনীটা সবচেয়ে কম বর্ণনা করা যাক। বিশ্বকাপ ২০০৬। কেননা, এই প্রজন্মের সবাই এটা চাক্ষুষ দেখেছে।

২০০৪ সালে ইউরোতে ভরাডুবির পর লিপ্পির হাতে সঁপে দেয়া হয় ‘ক্যালসিওপলি’ বিতর্কে জুভেন্টাস অবনমিত, আর মিলানকে ১৫ পয়েন্ট খোয়াতে হয়েছে। অথচ ইতালি দলের ভিত্তিটা তখন মিলান আর জুভের। তাদেরই এই অবস্থা! লিপ্পি বর্তমানে মরিনহোর বহুল ব্যবহৃত ‘Us against the world’ মন্ত্রে জাগিয়ে তুললেন মরণোদ্যত ইতালিকে।

ইতালি এমন এক ছাত্র, যার পড়া শুরুই হয় পরীক্ষার আগের রাত্রে! অস্ট্রেলিয়ার সাথে ধুঁকতে থাকা অবস্থায় শেষ মুহূর্তে পার পাওয়া ইতালির আসল রূপ দেখা যায় সেমিতে জার্মানির সাথে। জার্মান মাটিতে জার্মান যন্ত্রকে বিকল করে ফাইনালে যায় ইতালি। ফাইনালে পুরনো শিষ্য জিদানের মুখোমুখি গুরু লিপ্পি। সব গুরু দ্রোণ আর শিষ্য অর্জুনের যুদ্ধে শিষ্য জেতে না, এবার গুরুর পালা ছিল। কে জানে, সাবেক প্রিয় শিষ্যের এই মাথা গরম স্বভাবকে ‘অ্যাকিলিস হিল’ করার কৌশলটাও গুরুই বাতলে দিয়েছিলেন হয়তো বা! ভাগ্যটা যেন রাখা ছিল বিশ্বকাপ ফাইনালের জন্য। তা না হলে কেনই বা জিদান অমন ফ্রি হেড মিস করে বা মাতেরাজ্জির বুকে মাথা ঠুকে দিয়ে লাল কার্ড পাবেন? কেনই বা ত্রেজেগের মতো চৌকশ খেলোয়াড় পেনাল্ট মিস করবেন?

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সরিয়ে বিশ্বকাপ জেতানো লিপ্পি তখন জাতীয় বীর। ঠিক যে ট্রফিটা দিয়ে হয়তো তিনি ইতালির সেরা তথা বিশ্বেরই সর্বকালের অন্যতম সেরা বনে গেলেন।

বিশ্বকাপ জয়ের পর যেন চলে যান সব লাইমলাইটের বাইরে; Image Source:  Imaginechina Limited / Alamy Stock Photo

এরপর চায়নার বিভিন্ন ক্লাব, চায়না জাতীয় দল কিংবা ২০১০ বিশ্বকাপে ইতালির দায়িত্ব নিয়ে ১ম রাউন্ড থেকে বিদায় – সাফল্য আর লাইমলাইট দুইয়ের বাইরে চলে যান। কিন্তু এ এক মহাজীবনের অধ্যায়। আজীবন দলভিত্তিক চিন্তা ছিল তার। তারই মত ছিল,

“১১ জন চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় থাকলেই দল চ্যাম্পিয়ন হয় না, বরং ১১ জন দলের প্রতি নিবেদিত খেলোয়াড়ই দলকে চ্যাম্পিয়ন করে।” 

এরই বড় প্রমাণ, ইতালি যেবার বিশ্বকাপ জেতে, সেবার ২৩ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে দুইজন গোলরক্ষক বাদে ২১ জন খেলোয়াড়ই কোনো না কোনো ম্যাচে খেলেছেন, দলের গোল করা খেলোয়াড় ছিল ১০ জন। এ থেকেই বোঝা যায়, তার মূল শক্তিই ছিল দলগত প্রয়াস।

এই শ্বেতকেশী নিজের মোটা ফ্রেমের ভিতর দিয়ে মিটিমিটি চোখে ফুটবলকে একটা দাবা হিসেবেই দেখতেন। ইতালি এবং জুভেন্টাসকে স্রোতের বিপরীতে যা দিয়েছেন, তার জন্য অমর হয়েই থাকবেন ইতিহাসে। কী নেই তার ট্রফিকেসে! ৫টি স্কুডেট্টো, বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ – সব। চারবার খেলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল, কিন্তু জিতেছেন মাত্র একবার।

একবার ভেবে দেখুন, একটু ভাগ্যের ছোঁয়ায় যদি শুধু ঐ তিনটি ফাইনালে ব্যর্থ না হতেন, নামের পাশে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ আর বিশ্বকাপ জয় নিয়ে কি অমরত্ব পেরিয়েও সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরার তকমাটা পেতেন না? অবশ্যই পেতেন। কিন্তু কে জানে, হয়তো বা ঈশ্বর সর্বকালের সেরার বিতর্কে এত আগেই কাউকে জয়ী করে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না! 

This article is in Bangla language. It is about the life story of Marcelo Lippi, one of the greatest masterminds of football.

Featured Image Credit: Shaun Botterill/Getty Images

Related Articles