কিছুই না বলেও যেমন চোখের ভাষায় বোঝানো যায় মনের কথা, তেমনি দুর্দান্ত সব ছবি বলে দেয় ইতিহাসের অনেক অজানা কথা। ছবিগুলো দেখতে দেখতে আপনিও চলে যেতে পারেন ইতিহাসের সেই সময়গুলোতে।
টাইটানিকের অনাথ দুই শিশু
টাইটানিকের এই দুই শিশু সম্পর্কে কি আপনার জানা আছে? মিশেল ও অ্যাডমন্ড নরবাতিল টাইটানিকের সেই বিনাশ থেকে বেঁচে গিয়েছিলো। টাইটানিকের যাত্রায় তাদের সাথে ছিলেন তাদের বাবা, যিনি দুর্ভাগ্যবশত সেদিনের দুর্ঘটনায় মারা যান। আর রয়ে যায় তার এই দুই সন্তান। মূলত তাদের আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে বের করার জন্যই এই ছবিতিটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়। যেহেতু তখন পর্যন্ত কেউ তাদের নাম জানতেন না, তাই সে সময় তাদের নাম দেয়া হয়েছিলো ‘লুই’ ও ‘লোলা’ বা ‘দ্য টাইটানিক অরফ্যানস্’।
একজন কর্মরত পোষ্য ব্যক্তি
ছবিতে যে লোকটি দেখা যাচ্ছে, তার নাম পিনহুস কার্লিনস্কি। তিনি ছিলেন ইউক্রেনের উত্তরাংশের ঐতিহাসিক শহর চেরেনিগোভের জল নির্গমন পথের কর্মকর্তা। এই ছবিটির প্রণেতা এস.এম. প্রোকুদিন-গোর্সকি তার মন্তব্যে জানিয়েছিলেন, ১৯০৯ সালে ছবির এই লোকটির বয়স ছিলো ৮৪ বছর এবং তিনি অর্থাৎ পিনহুস কার্লিনস্কি টানা ৬৬ বছর ধরে এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
অবিশ্বাস্য এই ছবিটি মূলত এই বিষয়টি প্রকাশ করে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকেরা তাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মৃত ঘোড়াদের তীব্র সম্মাননা জানাচ্ছেন। মর্মস্পর্শী এই ছবিটিতে ৬৫০ জন সৈনিক একটি গঠন বা সৈন্যবিন্যাসে দাঁড়িয়েছে, যা উপর থেকে দেখলে মনে হবে যে, একটি ঘোড়ার মাথা, ঘাড় ও লাগামের যে অংশ নাকের ওপর লাগানো থাকে। মতবাদ আছে যে, এই ছবিটি ১৯১৫ সালে তুলেছিলো নিউ মেক্সিকোর ক্যাম্প কোডি-এর নতুন করে ঘোড়া সরবরাহকারী বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রায় ৮০ লক্ষ ঘোড়া মারা যায় সেই সংঘর্ষে। এছাড়াও মারা যায় অগনিত খচ্চর ও গাধা।
রাজকীয় বিমান বাহিনীর একজন বিমানচালক মিশনে যাওয়ার আগে চুল কাটাচ্ছেন
১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যের এসেক্সে ফেয়ারলপ এয়ারফিল্ড বেজ-এ এই ছবিটি তোলা হয়। ছবিটিতে চেয়ারে বসে থাকা যে লোকটি চুল কাটাচ্ছেন, তার নাম ফ্রান্সিস মেলারশ। তিনি ছিলেন রাজকীয় বিমান বাহিনীর একজন বিমানচালক। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, দুটি মিশনের মাঝমাঝি অবসর সময়ে তিনি চুল কাটানোর সময় জন বুকান-এর ‘গ্রিনম্যান্টেল’ বইটি পড়ছেন।
ফ্রান্সের এক প্রতিরোধ যোদ্ধা তার ঘাতকদের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিচ্ছেন
জর্জেস ব্লাইন্ড (ছবিতে যে লোকটি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন) ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধকারীদের মধ্যে একজন। ১৯৪৪ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। কথা বলতে বা মুখ খলতে অস্বীকৃতি জানালে নাৎসিপন্থীরা (হিটলারের জার্মান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য) তাকে ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা করে। তাতেও কাজ না হওয়ায় তাকে ব্ল্যাকহেমা (নাৎসি-পন্থীদের এক বন্দী-শিবির)-এ নিয়ে মেরে ফেলা হয়। গোপনে এই ছবিটির একটি কপি রেখে দেন ফরাসি বেসামরিক বাহিনীর এক আলোকচিত্রী।
একটি সতর্কতা
ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে কু ক্লাক্স ক্লান-এর একজন সদস্য গাড়ির জানালা থেকে একটি ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে রেখে গাড়ি চালাচ্ছে। কু ক্লাক্স ক্লান সাধারণত কেকেকে বা কেবল ক্লান নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ভিন্ন আন্দোলন যা চরমপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানগুলো যেমন- সাদা আধিপত্য, সাদা জাতীয়তাবাদ, বিরোধী অভিবাসন, ক্যাথলিক বিরোধী ও ইহুদী বিদ্বেষ নীতিতে কাজ করে। গাড়িতে এই যে তারা ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে রাখতো, এতে করে তারা মায়ামির আফ্রিকান-আমেরিকান জেলার অধিবাসীদের সতর্কবাণী দিতো, যেন তারা ১৯৩৯ সালের নির্বাচনে অবশ্যই অংশগ্রহণ করে।
একজন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী
১৯৫১ সালে বার্ষিক বোস্টন ম্যারাথনের সময় শিগেকি তানাকা নামের জাপানের একজন লোক প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাক লাগানো বিষয় এই যে, তানাকা নামের সেই লোকটি ওই ম্যারাথন আয়োজনের ঠিক ৬ বছর আগে আমেরিকান এয়ার ফোর্স দ্বারা হিরোশিমায় যে পরমাণু বোমা নিক্ষেপণ হয় সেই দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়ছিলেন। সেদিন ম্যারাথনে উপস্থিত সব দর্শকেরা নীরবতা পালন করে এই দৌড়বাজকে সম্মাননা জানায়।
অত্যধিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত একটি পরিবার
আলোকচিত্রকর ডরথিয়া ল্যাঙ্গ বেকারত্বের কারণে ভুক্তভোগী মানুষের তীব্র বিষণ্ণ চেহারা ক্যামেরাবন্দী করে। তার সবচাইতে জনপ্রিয় ছবির নাম ‘মাইগ্রেন্ট মাদার’। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ফ্লোরেন্স থম্পসন নামের একজন একক মা, যিনি ৭ সন্তানের জননী। পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো ফ্লোরেন্সের এই ছবিটি প্রকাশ করে যা সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যাগুলো নিয়ে সবার নজর কেড়েছিলো।
যে রাষ্ট্রপতি কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন
চিলির রাষ্ট্রপতি স্লাভেদর অ্যালান্দে কারাবাইনারদের উৎখাতের সময় তার বাসভবন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অগাস্টো পিনোশে (১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩)। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, অ্যালান্দে তার সাথে একটি স্বয়ংক্রিয় বন্দুক বহন করছন, যা কিউবার রাজনৈতিক নেতা ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। এই ছবিটি যখন ধারণ করা হয়েছিলো, তার কিছুদিন পরই এই বন্দুক দিয়ে অ্যালান্দেকে হত্যা করা হয়।
কার্যদিবসেই যখন কর্মীরা দিব্যি ঘুমে কাতর থাকে
বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে তোলা এই ছবিটিতে ছুরি চূর্ণকারী বা ‘ইয়েলো বেলিস’ (তাদের এই নামটি দেয়ার কারণ হলো চূর্ণ বা পেষণ করার মেশিনের হলুদ রঙের ধুলা)। সেখাকার কর্মীরা পেটের উপর ভর দিয়ে শুয়ে থেকে নিজেদের পিঠকে সুরক্ষিত রাখতো। তাদের সাথে সবসময় কতগুলো কুকুর থাকতো। সেই কুকুরগুলো যে শুধুমাত্র তাদের ভালো সঙ্গী ছিলো তা-ই নয়, বরং তাদের পায়ের উপর বসে থেকে তাদেরকে উষ্ণও রাখতো সেই কুকুরগুলো।
সম্মান
ছবিটি জাপানে ১৯৪৫ সালে তোলা। জাপানের নারী ও কিশোর-কিশোরীরা কামিকাযি বৈমানিকদের বিমান ঘাঁটিতে যাওয়ার আগে তাদেরকে বিদায় জানাতে জড়ো হয়েছিলেন। কামিকাযি বৈমানিকদের জীবনের পরিসরটা বেশ ছোট ছিলো। সেই সংঘে থাকা যুবকেরা তাদের সম্রাটদের জন্য ত্যাগের ক্ষেত্রে ছিলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ২,৮০০ জন কামিকাযি বৈমানিক মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও তারা আমেরিকার জাহাজে বিস্ফোরক বোঝাই বিমান দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালাতো। জাপানে এই বাহিনী তোকোতাই নামে পরিচিত।
নিউ ইয়র্ক: ৪০ বছর আগে
এই ছবিটিতে কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে সাবওয়ে ট্রেন দিয়ে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। রুডলফ গিউলিয়ানি নিউ ইয়র্কের নগরপাল হওয়ার আগে (১৯৯৪-২০০১), এই শহরটি বর্তমান অবস্থা থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিলো। সত্তর এবং আশির দশকের সময়ে দালানকোঠা ও পরিবহনগুলোতে বিস্তৃত ভাংচুর ও গ্রাফিতি যেন ছিলো নিউ ইয়র্কের প্রতীক!
জাপানের সামুরাই যোদ্ধা ও স্ফিংক্স, ১৮৬৪ সাল
এরা হলেন একদল সামুরাই যোদ্ধা যারা ‘ইকেদা মিশন’-এর অংশগ্রহণকারী হিসেবে স্ফিংক্সের সামনে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৮৪ সালে জাপানের রাষ্ট্রদূতেরা শোগুয়ান আকাইদা নাগাওকি (তিনি ছিলেন জাপানের ইবারা, বিছু রাজ্যের ছোট ছোট গ্রামগুলোর গভর্নর) এর নেতৃত্বে পারস্য যাওয়ার পথে মিশর পরিদর্শন করেছিলেন।
দুজন বিপ্লবপন্থী
এই ছবিতে, ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে ইউরি গ্যাগারিনের (সোভিয়েত বৈমানিক ও মহাকাশচারী, যিনি মহাশূন্যে যাওয়া প্রথম মানুষ, ১৯৬১ সাল) একটি উষ্ণ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছবিটি তোলা হয়েছিলো ১৯৬১ সালের ২৬শে জুলাই। তখন ছিলো মোনাকাদা ব্যারাক আক্রমণ বার্ষিকী (কিউবার বিপ্লবের প্রথম পর্ব)। ইউরি গ্যাগারিন ছিলো ফিদেল কাস্ত্রোর পছন্দের একজন মানুষ। তাই তিনি গ্যাগারিনকে প্রথম অর্ডার অব প্লায়া গিরনটি দেন।
ফিচার ইমেজ: Twitter