পতিতার জীবন থেকে জেলের চার দেয়াল; সিন্টোইয়া ব্রাউনের জীবনের গল্প কোনো চলচ্চিত্রের চাইতে কম কিছু নয়। ১৯৮৮ সালে জন্ম নেয় সিন্টোইয়া। মা জর্জিনা মিচেল দুই বছরের শিশু সিন্টোইয়াকে দত্তক দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তার জীবন খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। সিন্টোইয়া গর্ভে থাকাকালীন সময়েই প্রচন্ড মাদকাসক্ত ছিলেন জর্জিনা। পরবর্তীতে কোকেইনে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। সিন্টোইয়ার বয়স তখন মাত্র ৮ মাস। কোকেইনের দুনিয়ায় পুরোপুরি বুঁদ হয়েছিলেন জর্জিনা। ফলাফল হিসেবে সিন্টোইয়ার জায়গা হয় এলেনেট ব্রাউনের বাড়িতে। খুব যে অভাবে ছিল সিন্টোইয়া সেখানে তা নয়। তবে নিজের জীবনে মানসিকভাবে স্থির হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায়নি সে। ফলে, একসময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সিন্টোইয়া।
২০০৪ সালের কথা। টেনেসিতে একজনকে হত্যার দায়ে ১৬ বছর বয়সী সিন্টোইয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৪৩ বছর বয়সী লোকটির নাম ছিল জন অ্যালেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা সিন্টোইয়া ‘কাট-থ্রট’ নামক একজন ২৪ বছর বয়সী ব্যক্তির সাথে ছিল। কেমন ছিল সে ওখানে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কাট-থ্রট সিন্টোইয়ার উপরে যৌন নির্যাতন চালায়। জোর করে ভয় দেখিয়ে তার সাথে থাকতে বাধ্য করে। শুধু তা-ই নয়, একইসাথে সিন্টোইয়াকে দিয়ে পতিতাবৃত্তির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল সে টাকার বিনিময়ে। অনেকেই টাকার বিনিময়ে সিন্টোইয়ার সাথে সময় কাটিয়েছে। আর তাদেরই একজন ছিলেন জন অ্যালেন। সিন্টোইয়াকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান জন। তবে তার কথা ও কাজে ভয় পেয়ে যায় সিন্টোইয়া। তার মনে হচ্ছিল, জন হয়তো তাকে আক্রমণ করতে পারে।
সিন্টোইয়ার কথানুসারে, জনের সাথে দেখা করার আগে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে মাদক এবং যৌন নির্যাতনের ভুক্তোভোগী ছিল সে। কাট-থ্রট মাদক নিতে বাধ্য করত তাকে। অন্যথায় গুলি করার হুমকি দিত। ফলে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসম্ভব বিপর্যস্ত ছিল সিন্টোইয়া। পরবর্তীতে জন তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলে সেখানে বেশ কিছু অস্ত্র দেখতে পায় সে। জনকে বন্দুকগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায়নি সিন্টোইয়া। জনের হাবভাব দেখেও সুবিধাজনক কিছু মনে হয়নি তার। কেবল মনে হচ্ছিল, যেকোনো বন্দুক তুলে হয়তো জন তাকে মেরে ফেলবে। ভয় পেয়ে জনের বাড়িতে রাখা একটি পিস্তল ব্যবহার করে সে। সিন্টোইয়ার গুলিতে মারা যায় জন। গ্রেপ্তার করা হয় সিন্টোইয়াকে। বিচার চলে অনেকদিন। নিজের বয়স সম্পর্কে প্রথমে মিথ্যে বলে সিন্টোইয়া। পরবর্তীতে জনকে মারার পেছনে নিজের ভয়ের কথা জানালেও প্রতিপক্ষ আইনজীবী জানান, জনের মৃত্যু হয়েছিল ঘুমের মধ্যে। তাকে গুলি করে তার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সিন্টোইয়া। ফলে, সিন্টোইয়া ইচ্ছাকৃতভাবে জনকে খুন করে, প্রতিরক্ষার জন্য নয়। ২০০৬ সালে সিন্টোইয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয় আদালত। যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় তার। ২০১২ সালে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া নিয়ে কথা ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপ্রিম কোর্ট কিশোর-কিশোরীদের যাবজ্জীবন এবং প্যারোল ছাড়া যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে সমালোচনা করে। তবে এত কিছুর পরেও, ৬৯ বছর বয়সের পর প্যারোলের আবেদন করতে পারবে সিন্টোইয়া- এমনটাই ঠিক করা হয়।
সিন্টোইয়া ব্রাউনের গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারতো এখানেই। কেউ কখনো জানতও না যে জেলের চার দেয়ালে নিরপরাধ এক তরুণী মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। তাহলে কীভাবে আবার নতুন করে সবার সামনে এল সিন্টোইয়া?
১৬ই নভেম্বর, ২০১৭; ফক্স ১৭ ন্যাশভিল সিন্টোইয়া ব্রাউনের জীবন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার এ্যানেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশন এন্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক ডান বারম্যান কথা বলেন সিন্টোইয়ার ব্যাপারে। প্রায় ১৪ বছর ধরে সিন্টোইয়াকে জানেন বারম্যান। বহু আগে থেকেই এ ব্যাপারে কাজ করে চলেছেন তিনি। সিন্টোইয়া ব্রাউনের উপরে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন বারম্যান। ‘মি ফেসিং লাইফ: সিন্টোইয়া’স স্টোরি’ নামক তথ্যচিত্রটি প্রকাশ পায় ২০১১ সালে। মেয়েটির গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু করে ছয় বছর পর্যন্ত সময়কে তথ্যচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করেন বারম্যান। ফক্স ১৭ এর ঐ প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সিন্টোইয়া লিপসকম্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহকারী ডিগ্রী গ্রহণ করেছে এবং বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছে। শুধু তা-ই নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি যুব বিচার ব্যবস্থার জন্য অবৈতনিক কাজ করছে সে। সিন্টোইয়ার কারণেই টেনেসির আইন অনেকটা বদলে গিয়েছে। ২০১৫ সালে টেনেসিতে যাবজ্জীবন শাস্তিভুক্ত কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে ১৫ বছর শাস্তি ভোগ করার পর মুক্তি পাওয়ার আবেদন করার ব্যাপারে প্রস্তাব তোলা হয়। তবে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়াও, সিন্টোইয়ার ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কারণ সিন্টোইয়া ১৫ বছর শাস্তি ভোগের পর তার বয়স হবে ৩১ বছর। অন্যদিকে, ২০১১ সালে আইনে নতুন একটি পরিবর্তন আসে। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে ‘পতিতাবৃত্তি’ শব্দটি ব্যবহার না করে তার বদলে ‘যৌন পাচার এবং ম্যানিপুলেশনের শিকার’ কথাগুলো ব্যবহার করার কথা বলা হয় সেখানে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সিন্টোইয়ার মামলাটি এই আইন তৈরির অনেক আগে শেষ করা হয়। ফলে, আইন তৈরির পরেও কারাগারেই থাকতে হয় তাকে।
ফক্স ১৭ এবং বারম্যানের তৈরি তথ্যচিত্র মানুষকে নতুন করে সিন্টোইয়ার ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করে। সোচ্চার হয়ে ওঠে তারা। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, সিন্টোইয়ার ব্যাপারে কথা বলেন তারকারাও। সিন্টোইয়া ব্রাউনের মুক্তির দাবীতে কথা বলেন সবাই। আরো অনেকের সাথে ২১শে নভেম্বর রিহানা এবং কিম কারদাশিয়ান ওয়েস্ট নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একাউন্টে সিন্টোইয়ার কথাগুলোকে তুলে ধরেন। কিম কারদাশিয়ান লেখেন, “পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। বাচ্চা একটা মেয়েকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে দেখা এবং এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দেখানোর পর তাকে সারা জীবনের জন্য জেলে আটকে রাখাটা হৃদয়বিদারক। আমাদের কিছু করতে হবে এবং সঠিক কাজটাই করতে হবে। আমি আমার আইনজীবীকে ডেকেছি ব্যাপারটি কীভাবে ঠিক করা যায় সেটা দেখার জন্য।” এই লেখাগুলোর উপরেই ছিল সিন্টোইয়ার আকুতি। তার বাঁচার আকুতি। নিজের লেখার মধ্য দিয়ে অনুরোধ জানায় সে সবাইকে তার ব্যাপারে কিছু করার জন্য। সিন্টোইয়া সেখানে সবাইকে নিজের অবস্থার কথা, নিজের অতীতের কথা সংক্ষেপে বলে। অনুরোধ করে যেন সবাই তার জায়গায় নিজেকে অল্প সময়ের জন্য হলেও দাঁড় করায় আর ভাবে যে, বিনা অপরাধে সারা জীবন জেলের ভেতরে থাকতে কেমন লাগে।
The system has failed. It’s heart breaking to see a young girl sex trafficked then when she has the courage to fight back is jailed for life! We have to do better & do what’s right. I’ve called my attorneys yesterday to see what can be done to fix this. #FreeCyntoiaBrown pic.twitter.com/73y26mLp7u
— Kim Kardashian West (@KimKardashian) November 21, 2017
হ্যাশট্যাগে ফ্রি সিন্টোইয়া ব্রাউন লিখে সিন্টোইয়াকে মুক্ত করার, তার জীবনকে নতুন করে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানায় সবাই। তবে এখনো পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সাড়া পড়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সিন্টোইয়া এখনো জেলের চার দেয়ালের মধ্যেই আটকে আছে। অপেক্ষা করছে মুক্তির। কিম কারদাশিয়ান এ ব্যাপারে কিছু করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, মামলাটি আবার নতুন করে শুরু করা গেলে হয়তো কোনোভাবে সিন্টোইয়ার শাস্তির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। তবে সেটা ঠিক কতটা কমবে, কিংবা আদৌ কমবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে এখনো।
ফিচার ইমেজ: i-D Magazine – Vice