পৃথিবীর নানা দেশে রয়েছে নানারকম সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস। বিশ্বাসে বৈচিত্রের কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন রকম আচার-অনুষ্ঠান। মেক্সিকোতে তেমনই একটি জনপ্রিয় উৎসব হলো ডে অব দ্য ডেড বা মৃতদের দিন। স্প্যানিশ ভাষায় একে বলে Día de los Muertos। অনেকে একে হ্যালোইনের মেক্সিকান সংস্করণ ভেবে ভুল করে থাকেন। হ্যালোইনের মতো রাতের বেলা মানুষকে ভয় দেখানো নয় বরং দুই দিনব্যাপী মৃত্যুকে স্মরণ করে জীবনের কিছু মুহূর্ত মৃতদের সাথে উদযাপন করাই হলো ডে অব দ্য ডেড এর মূল উদ্দেশ্য। প্রতি বছর নভেম্বরের ১ তারিখ উৎসবটি উদযাপিত হয় মৃত শিশুদের স্মরণ করে। দ্বিতীয় দিন নভেম্বরের ২ তারিখ স্মরণ করা হয় প্রাপ্তবয়স্কদের। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো কতৃক স্বীকৃতি লাভ করে এই উৎসবটি।
উৎপত্তি
ডে অব দ্য ডেড-এর উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৫০০-৩০০০ বছর আগে। তখনকার সময়ে অ্যাজটেক, টলটেক এবং নাহুয়া সভ্যতার মানুষদের মধ্যে এধরনের রীতিনীতির প্রচলন ছিল। এসব প্রাক-হিস্পানিক সংস্কৃতিতে মৃত মানুষদের জন্য শোক প্রকাশ করাকে একধরনের নিন্দনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো। তারা মনে করতো কারো মৃত্যুতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, কারণ মৃত্যু আসলে জীবনের শেষ নয় বরং দীর্ঘ জীবনের একটি অংশের পরিসমাপ্তি মাত্র। মৃতদেরকে নিজেদের অংশ হিসেবেই মনে করতো তারা।
তারা বিশ্বাস করতো কিছু সময়ের জন্য মৃত মানুষেরা তাদের প্রিয়জনদের সাথে দেখা করার জন্য মর্ত্যলোকে আসেন। তাই তাদেরকে আপ্যায়ন করার জন্য তৈরি করা হতো নানারকম আয়োজন। অ্যাজটেক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আগস্টের শুরু থেকে পুরো মাসব্যাপী এই আয়োজন চলতো। এই উৎসবকে তারা উৎসর্গ করতো তাদের মৃত্যুর দেবীকে।
স্প্যানিয়ার্ডরা যখন মেক্সিকোতে আসে তখন তারা অ্যাজটেকদেরকে বর্বর হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদের এই উৎসবকে অপবিত্র বলে ঘোষণা দেয়। তাদের মধ্যে ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জোর চেষ্টা চালায় এবং সেই উৎসবের বিকল্প হিসেবে ১ নভেম্বর অল সেইন্ট’স ডে এবং ২ নভেম্বর অল সোল’স ডে প্রস্তাব করে। কিন্তু এই দুই উৎসবের কোনোটিই বন্ধ না হয়ে খ্রিস্টীয় ও প্রাক-হিস্পানিক সংস্কৃতি একীভূত হয়ে যায় এবং ডে অব দ্য ডেড উৎসবের প্রচলন ঘটে।
যেভাবে উদযাপিত হয় ডে অব দ্য ডেড
ডে অব দ্য ডেড উৎসবটির জন্য পুরো বছর ধরেই প্রস্তুতি নেয়া হয়। মেক্সিকোর মধ্যভাগ এবং দক্ষিণের এলাকাগুলোতে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় এই উৎসব। ৩১ অক্টোবর থেকেই মূলত শুরু হয়ে যায় সব আয়োজন। এদিনে ছোট ছেলেমেয়েরা একসাথে জড়ো হয়। একত্রে অল্প বয়সেই যারা মারা গিয়েছিলো তাদের আত্মাকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানায়। পরের দিন ১ নভেম্বর আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যারা মারা গিয়েছিল তাদেরকে। এরপরের দিন সকলে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সমাধিক্ষেত্রে যায় এবং সমাধিক্ষেত্রকে নানারকম জিনিস দিয়ে সাজায়। এসব জিনিসের মধ্য আছে মেরিগোল্ড ফুল, মুয়ের্তোস নামে একধরনের রুটি, সুগার স্কাল, কার্ডবোর্ড স্কেলিটন, টিস্যু পেপারে তৈরী বিভিন্ন শিল্পকর্ম, ফল এবং নানারকম ঐতিহ্যবাহী খাবার। মেরিগোল্ড ফুলকে তারা বলে ফ্লর ডি মুয়ের্তো বা মৃতদের ফুল। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, এ ফুল মৃতদের আত্মাকে পৃথিবীর দিকে আকৃষ্ট করে।
এ উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অাল্টার। এর দ্বারা মূলত চার্চে থাকা একধরনের বিশেষ টেবিলকে বোঝায়। তবে এ উৎসবে এটি ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করা হয় না। অনেক দূর থেকে আসা স্বজনদের ক্লান্ত আত্মাকে আপ্যায়ন করা হয় এখানে। এজন্য প্রতিটি বাড়িতে এরকম একটি টেবিলের উপর মৃত আত্মীয়-স্বজনদের পছন্দের নানা রকম খাবার, পানীয়, পারিবারিক ছবি কিংবা স্মৃতি ধরে রাখার জন্য যেকোনো কিছু সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখে দেয়া হয়। মানুষের মাথার খুলি এবং হাড়গোড় দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় খাবারগুলো।
খাবারের পাশাপাশি মৃত শিশুদের জন্য সেখানে থাকতে পারে বিভিন্ন রকম খেলনা। মৃতদের জন্য রাখা এসব খাবার পরবর্তীতে অবশ্য অনেকেই খেয়ে ফেলেন। অনেকে বিশ্বাস করে বেড়াতে আসা আত্মারা এসব খাবারের সব পুষ্টি নিয়ে নেয়। সে হিসেবে এই খাবারগুলো কেউ খেলেও তা থেকে কোনো পুষ্টি পাবে না!
এই সময়টাতে মেক্সিকোর শহরগুলোর রাস্তাঘাটে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। সবার পরনে থাকে বিশেষ ধরনের পেশাক। পোশাকে থাকে মানবদেহের কঙ্কালের মতো ডিজাইন। তাদের বিশ্বাস অনুসারে এর কারণ মূলত আসন্ন মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং নিজের মৃত্যুর জন্য একরকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মেক্সিকান কার্টুনিস্ট জোসে গুয়াডালুপ পোসাদার The Elegant Skull নামে একটি পেইন্টিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এতে মেক্সিকোর ধনীদের কটাক্ষ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে বলা হয়েছিল কেউ যতই ধনী হোক না কেন সবার মাথার খুলি একই রকম। বাইরে থেকে আমরা যা-ই হই ভেতরে আমরা সকলে কংকাল ছাড়া আর কিছুই না। এরপর এটি জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং সকলে কংকালের মতো করে পোশাক পরে, মুখে নানা রকম রং মেখে বাইরে বেরিয়ে আসে এই উৎসবের সময়ে। এধরনের পোশাক মৃত মানুষদেরকে তাদের কাছে নিয়ে আসে বলেই তাদের বিশ্বাস।
মেক্সিকোতে স্থানভেদে এ উৎসবের রীতিনীতির মধ্যে খানিকটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু এলাকায় শিশুরা হ্যালোইনের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিংবা পথচারীদের কাছে সুগার স্কাল বা চকলেট বা টাকা চায়। এছাড়া কিছু জায়গায় আত্মাদের জন্য রাখা খাবার বিতরণ করা হয় সবার মাঝে।
মেক্সিকো ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে ছোট পরিসরে পালিত হয় এই উৎসব। কিন্তু মেক্সিকোর মূল ডে অব দ্য ডেড এর সাথে এসব দেশের উৎসবের কিছু পার্থক্য রয়েছে।
২০১৫ সালে মুক্তি পায় জেমস বন্ড সিরিজের স্পেকটার চলচ্চিত্রের দৃশ্যপট। শুরুতেই দেখানো হয় জেমস বন্ড মেক্সিকো সিটিতে ডে অব দ্য ডেড প্যারেডের মধ্যে ভিলেনদের ধরতে ব্যস্ত। প্রকৃতপক্ষে, মেক্সিকো সিটিতে এরকম কোনো প্যারেডের অস্তিত্বই কোনোদিন ছিল না। কিন্তু সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার এক বছর পর মেক্সিকান সরকার প্রাক-হিস্পানিক এই সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বের মানুষের সামনে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য এধরনের প্যারেড প্রতি বছর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে অনেক রকম মতামত দিলেও ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর এই প্যারেড ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন এই প্যারেডে অংশ নেয় প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মেক্সিকান। এভাবে ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃত হচ্ছে হাজার বছর ধরে চলে আসা এই উৎসবটি।
ফিচার ইমেজ: National Geographic