মেরি শেলির নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশালদেহী দানব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ছবি। কারণ মেরি শেলির সাথে আমাদের পরিচিতি এই উপন্যাসের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর রচয়িতা মেরি শেলির আরেকটি পরিচয় হলো, তিনি বিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলির স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এই দুই পরিচয়ের বাইরে ‘মানুষ মেরি’র সাথে আমাদের পরিচিতি তুলনামূলকভাবে কম। এর পূর্বে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং লেখিকা মেরিকে নিয়ে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: বইয়ের পাতায় জীবন্ত দানব’-নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও, মেরির ব্যক্তিগত জীবনের গল্প যেন অন্তরালেই রয়ে গেছে। তাই আমাদের আজকের আয়োজনে সেই কিংবদন্তী মেরির সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন অজানা তথ্যের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
জন্ম এবং অবহেলিত শৈশব
১৭৯৭ সালের ৩০ আগস্ট ইংল্যাণ্ডের রাজধানী লণ্ডনে জন্ম হয় প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক মেরি শেলির। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মুক্তমনা লেখক উইলিয়াম গডউইন এবং নারীবাদী সমাজসেবক মেরি উলস্টনক্রাফটের ঘর আলো করে জন্ম নেন এই লেখিকা। লণ্ডনের আর দশটা শিশুর চেয়ে মেরির শৈশব ছিল একটু আলাদা। জন্মের পর থেকে একের পর এক কাছের মানুষের মৃত্যুশোকে জর্জরিত হন কিশোরী মেরী। দুর্ভাগ্যবশত, জন্মের কিছুদিন পরই মাকে হারান তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন পিতা গডউইন। মেরি ছাড়াও গডউইনের সংসারে আরেক কন্যা ছিল, নাম ফেনি ইমলে। ফেনি ছিলেন গডউইনের সৎ কন্যা।
আত্মকেন্দ্রিক গডউইনের পক্ষে দুটি শিশুর দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। দিনের বেশিরভাগ সময় নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে, স্ত্রীর মৃত্যুর পর কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েন তিনি। দিন দিন তার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তিলাভের আশায় নতুন করে প্রেমে পড়েন তিনি। প্রতিবেশী মেরি জেইন ক্লেয়ারমটের সাথে কয়েক বছর প্রেম করার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন গডউইন। সংসারে সৎ মায়ের আগমনে মেরি শেলির অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়। তাকে পূর্বের ন্যায় অবহেলায় অনাহারে দিন পার করতে হয়নি।
উইলিয়াম গডউইনও সবকিছু নতুনভাবে শুরু করেন। মেরি জেইন ক্লেয়ারমেটের আগের সংসারে দুই কন্যাসন্তান ছিল। গডউইন এবং জেইনের সংসারে নতুন পুত্রসন্তানের আগমন ঘটে। মেরি জেইন ক্লেয়ারমেট মেরি শেলি এবং ফেনির তুলনায় নিজের সন্তানদের প্রতি বেশি যত্নশীল হয়ে উঠেন। মেরির সাথে জেইনের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। জেইন নিজের সন্তানদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে স্কুলে প্রেরণ করেন। কিন্তু মেরির ভাগ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ হয়নি।
বইয়ের সাথে বসবাস
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত কিশোরী মেরি একাকী দিনযাপন করতেন। দিনের বেশিরভাগ সময় আপনমনে ঘরের কোণায় বসে খেলা করতেন। সন্ধ্যা নামলে নিজের ঘরে শুয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নিজের মায়ের কথা ভাবতেন। তার কল্পনায় একজন মমতাময়ী মায়ের ছবি ভেসে উঠতো। কিশোরী মেরির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। মাঝে মাঝে শহরের গোরস্তানে ছুটে যেতেন। মায়ের কবরের পাশে বসে চুপ করে থাকতেন। স্কুলে ভর্তি হতে না পারলেও মেরি পড়াশোনা বন্ধ করে দেননি।
সৎ বোন এবং পিতার সহায়তায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। একটু বড় হওয়ার পর তার পরিচয় হয় বইয়ের জগতের সাথে। লেখক বাবা এবং পরলোকগত মায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বই নিয়ে পড়া শুরু করেন তিনি। বইয়ের সাথে সখ্যতায় তার একাকিত্ব দূর হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তিনি বই পড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। বইয়ের নেশায় মত্ত মেরিকে মাঝে মাঝে নিজের মায়ের কবরের পাশেও বই পড়া অবস্থায় পাওয়া যেত। বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, “এ কেমন মেয়ে? খাওয়া-দাওয়ার নাম নেই! শুধু বই আর বই।”
বইয়ের পাতায় নতুন করে স্বপ্ন দেখা মেরির মনে সাহিত্যের অঙ্কুরোদগম হয়। মনে মনে ছোট গল্প তৈরি করতেন তিনি। কিন্তু কখনো গল্প লেখার সাহস হয়নি তার। জনাব গডউইন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করতেন। সামাজিকতার খাতিরে প্রায়ই তারা গডউইনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেতেন। এদের মাঝে বিখ্যাত কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজও ছিলেন। কোলরিজের সাথে মেরির ভাব জমে ওঠে। তাদের আলাপচারিতার ফলে তার মনে সাহিত্যের প্রতি তীব্র অনুরাগ জন্ম নেয়। একবার সাহস করে মেরি কলম হাতে নিয়ে বসে পড়েন সাহিত্য রচনায়। কবির সান্নিধ্যে থাকার দরুন তার মাঝে কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। কাঁচা হাতের লেখায় রচিত কবিতা Mounseer Nongtongpaw নিয়ে পিতার দরবারে হাজির হন। নিজের মেয়ের কবিতা হাতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে যান গডউইন। ১৮০৭ সালে স্থানীয় পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
পার্সি শেলির সাথে প্রণয়
দিন দিন সৎ মা জেইনের সাথে মেরির সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। প্রায়ই দুজনের ঝগড়া বেঁধে যেত। ১৮১২ সালে সৎ মায়ের প্ররোচনায় গডউইন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কন্যা মেরিকে লণ্ডনে উইলিয়াম বেক্সটার নামক এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। নিজের ঘর থেকে বিতাড়িত মেরির মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। তবে এই ঘটনা তার জীবনে শাপে বর হয়ে আসে। বেক্সটার পরিবার মেরিকে আপন করে নেয়। লণ্ডনের নতুন বাসায় নিরিবিলি পরিবেশে মেরি শেলি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। এক বছর পর পিতা গডউইন মেরিকে পুনরায় নিজের কাছে ফেরত নিয়ে যান।
সেই বছর গডউইনের অতিথি হিসেবে বাড়িতে নিমন্ত্রণ পান বিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলি এবং তার স্ত্রী হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুক। পার্সি বিসি শেলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে মেরির। কিন্তু তখনও ব্যাপারটা প্রেম পর্যন্ত গড়ায়নি। ১৮১৪ সালে পার্সির সাথে হ্যারিয়টের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এই সময়ে পার্সির সাথে মেরির প্রেম হয়। সেই বছর পার্সি এবং মেরি ফ্রান্সে পালিয়ে যান। কিন্তু পার্সি তখনও হ্যারিয়টের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তাই কিছুদিন পরই তাদের ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসতে হয়। তারা দুজন লুকিয়ে প্রেম করতে থাকেন।
মেরির পিতা গডউইন হ্যারিয়টের সাথে বিচ্ছেদের পূর্বে পার্সিকে বিয়ে করার অনুমতি দেননি। ১৮১৫ সালে মেরি একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু জন্মের পরপরই শিশুটি মৃত্যুবরণ করে। ফলে তার জীবনে মায়ের মৃত্যুশোক পুনরায় ফিরে আসে। তিনি কন্যার মৃত্যুর দুঃখ ভোলার উদ্দেশ্যে পুনরায় মা হলেন। এবার তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিলো পুত্রসন্তান উইলিয়াম। সম্পূর্ণ সুস্থ শিশুর দিকে তাকিয়ে তার চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব
পার্সি শেলি মেরির সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কথায় আছে- ‘জহুরি জহর চেনেন’। পার্সি তাই শুরু থেকেই মেরিকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। কিন্তু ‘লেখি লেখি’ করেও কেন যেন লেখা হচ্ছিলো না। মেরি শেলি তিনটি উপন্যাস লেখার কাজ হাতে নেন। কিন্তু গর্ভকালীন বিরতির ফলে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একটা সময় তিনি লেখিকা হবার সকল আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু একটি ঝড়ের রাতে মেরির জীবনের মোড় ঘুরে যায়।
প্রেমিকা পার্সির সাথে মেরি সেবার সুইজারল্যাণ্ড বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের সঙ্গী হিসেবে যোগ দেন বিখ্যাত সাহিত্যিক লর্ড বায়রন এবং তার বন্ধু চিকিৎসক জন পলিডরি। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সারাদিন তাদের ঘরের ভেতর বন্দী হয়ে বসে থাকতে হয়েছিলো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এক রাতে লর্ড বায়রন এক নতুন খেলা নিয়ে হাজির হলেন। তিনি সবাইকে ভূতের গল্প লেখার জন্য আহ্বান করেন। সবাই সানন্দে রাজি হয়ে যান। পলিডরি এবং বায়রন দু’জনই ভ্যাম্পায়ার-ড্রাকুলা ভিত্তিক গল্প লিখে জমা দিলেন।
কিন্তু মেরি শেলি ড্রাকুলার ধার ধারলেন না। তিনি লিখে নিয়ে এলেন এক দানবের গল্প। বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি এবং বজ্রপাতের সাহায্যে প্রাণসঞ্চার করা এক বীভৎস দানবের রোমাঞ্চকর কাহিনী নিয়ে সাজানো সেই গল্পের নাম দেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। লর্ড বায়রন এবং পার্সি শেলি দুজনেই বিস্মিত হন। সম্পূর্ণ ভিন্নধারায় লেখা এই গল্প যেন মেরির লুক্কায়িত প্রতিভার সাহসী প্রকাশ। পার্সি শেলির অনুরোধে মেরি শেলি তার ছোট গল্পকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে রূপ দেন। পরবর্তীতে ১৮১৮ ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ মেরির প্রথম উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে সাহিত্যপ্রেমীরা এক নতুন মাত্রার সাহিত্যরস আস্বাদন করার সুযোগ লাভ করেন, যার নাম ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী’। এই অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘দ্য লাস্ট ম্যান‘ নামক একটি উপন্যাস রচনা করেন। কিন্তু সাহিত্যপ্রেমীদের নিকট তিনি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রচয়িতা হিসেবেই পরিচিত আছেন।
প্রণয় থেকে পরিণতি
চমৎকার কিছু স্মৃতি নিয়ে মেরি ২৯ আগস্ট ১৮১৬ সালে সুইজারল্যাণ্ড থেকে ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যাণ্ডে ফেরার পর পর তাকে বেশ কয়েকটি দুঃসংবাদের মুখোমুখি হতে হয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তার সৎ বোন ফেনি আত্মহত্যা করেন। আর ওদিকে পার্সি শেলির স্ত্রী হ্যারিয়ট পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। বোনের মৃত্যুতে শোকে জর্জরিত হয়ে পড়েন মেরি। কিন্তু পার্সি শেলি তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেরিকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এবার বাবা গডউইনের সম্মতিক্রমে ২০ ডিসেম্বর দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর নতুন করে লেখালেখি শুরু করেন তিনি।
পার্সির সাথে ইউরোপ ভ্রমণের স্মৃতির উপর ভিত্তি করে ১৮১৭ সালে History of a Six Weeks নামক ভ্রমণকাহিনী রচনা করেন। সেই সাথে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের শেষ পর্ব লিখে ফেলেন। পরের বছর লণ্ডনের বেশ কিছু প্রকাশনীতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশিত হয়। বেনামী প্রচ্ছদে ছাপা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকা লেখেন স্বামী পার্সি। এজন্য প্রাথমিকভাবে অনেকেই উপন্যাসটি পার্সির লেখা বলে ধারণা করেছিলো। কিন্তু পরবর্তী সংস্করণেই রহস্য উদঘাটিত হয়। মেরি শেলির নিজের নাম ব্যবহার করে বই প্রকাশের অনুমতি দেন। এর মাধ্যমে তিনি সাহিত্যসমাজে বীরদর্পে পদার্পণ করেন।
জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন এই লেখিকা। কিন্তু তার এই আনন্দ বেশিদিন দীর্ঘায়িত হতে পারেনি। সেই বছর সেপ্টেম্বরে তার কনিষ্ঠ কন্যা জন্মের কয়েক মাস পরে রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করে। কন্যার মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তার প্রথম পুত্র উইলিয়াম মৃত্যুবরণ করে। মেরি এই দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে নতুন করে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৮২০ সালে মেরির এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। সন্তানের নাম রাখেন পার্সি ফ্লোরেন্স শেলি। এরপর তিনি বেশ কয়েকটি নাট্য সংকলন রচনা করেন। কিন্তু ১৯২২ সালের পূর্বে তা প্রকাশিত হয়নি।
মেরির দুঃখ পার্সি
১৮২১ সালে মেরি এবং পার্সি ইতালির পিসা শহরে প্রত্যাবর্তন করেন। মেরি নতুন করে সন্তানসম্ভবা হন। কিন্তু সে বছর জুলাইয়ে তার গর্ভপাত হয়। মেরী শেলির জীবনে দুঃখ যেন পিছুই ছাড়ছে না। তার দুঃসহ জীবনকে আরো বিষিয়ে দিতে এবার হাজির হলো আরেকটি দুঃসংবাদ। পার্সি শেলি বন্ধুদের সাথে সমুদ্র ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। স্পেজিয়া উপসাগরে সেই ভ্রমণ হয়ে উঠলো পার্সির জীবনের শেষ ভ্রমণ। সাগরের মাঝামাঝি অবস্থায় শেলির জাহাজডুবি হয়। ঠিক প্রথম স্ত্রীর মতো নিজেও পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন পার্সি। ওদিকে সন্তান হারানোর শোকে বিহ্বল মেরির কানে সংবাদ পৌঁছানো মাত্র তিনি মূর্ছা যান।
পার্সিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মেরি। বেশ কিছুদিন অর্থাভাবে থাকার পর তিনি লেখালেখিকে প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের সন্তানসহ বেশ কষ্টে দিন গুজরান করতে থাকেন। ১৮২৬ সালের মধ্যে তিনি দুটি উপন্যাস লেখতে সক্ষম হন। ‘ভালপ্রেগা’ নামক উপন্যাসটি তেমন ভালো বিক্রি না হলেও, ‘দ্য লাস্ট ম্যান’ উপন্যাসটি পাঠক সমাজে বেশ সমাদৃত হয়। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পার্সি শেলির কবিতা প্রচারেও নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সাহিত্য সমাজে পার্সি শেলির প্রাপ্য সম্মান আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। ওদিকে আবার তার পারিবারিক জীবনেও দুঃখ নেমে আসে। শ্বশুরের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো তার। মেরির সন্তানের বোহেমিয়ান জীবনযাপন নিয়েই তার যত আপত্তি।
ঘুরে দাঁড়ানো
শেষপর্যন্ত বিধাতা তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। ধীরে ধীরে ভাগ্য পরিবর্তন হয়। মেরি ‘দ্য লাস্ট ম্যান’ এর পর বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করলেও তা পাঠক সমাজে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। ১৮৪০ সালে পার্সির প্রথম স্ত্রীর সন্তান চার্লস বিসি শেলির অকাল মৃত্যু ঘটে। ফলে মেরির পুত্র ফ্লোরেন্স শেলি পরিবারের সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করে। মেরির স্বাস্থ্যের অবস্থাও তখন ভালো ছিল না। তাই হঠাৎ করে বেশ কিছু টাকা হাতে পাওয়ায় তার জীবনে স্বস্তি নেমে আসে। পার্সির সাথে কাটানো সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিগুলো পুনরায় রোমন্থন করতে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন সন্তানসহ।
জার্মানী এবং ইতালির বিখ্যাত স্থানসমূহ ঘুরে দেখেন দুজনে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরেই হাত দেন লেখালেখির কাজে। ১৮৪০ সালে তার ভ্রমণকাহিনীর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। ১৮৪২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তার ভ্রমণকাহিনী। এর মাধ্যমে তিনি বেশ ভালো উপার্জন করতে থাকেন। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পার্সি শেলির জীবনী লিখবেন। কিন্তু ততদিনে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় তিনি লেখালেখি থেকে বিরতি নেন।
শেষ জীবন
শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। হাসপাতাল থেকে জানা গেলো, তার মস্তিষ্কে টিউমার হয়েছে। তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে। লেখিকা নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, এবার তাকে যেতে হবে। পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা দিতে হবে নতুন গন্তব্যে। তিনি সম্পূর্ণভাবে লেখালেখি ছেড়ে না দিলেও তার সেই পুরনো আগ্রহ আর ফিরে আসেনি। ১৮৫১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এই লেখিকা। বোর্নমাউথ শহরের সেন্ট পিটার্স গির্জার সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ হন তিনি।
সারাজীবন দুঃখের সাথে বাস করা মেরি শেলি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। তিনি কখনও হার মানেননি, যার প্রতিদান হিসেবে তার নাম আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে লাখ লাখ সাহিত্যপ্রেমী। বইয়ের দোকানগুলোতে শোভা পাওয়া অনবদ্য সৃষ্টি ফ্রাংকেনস্টাইনের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রিয় এই সাহিত্যিক।
ফিচার ইমেজ: The Great Courses Daily