Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হারিয়ে যাওয়া বাঘেদের গল্প

বাঘ নিয়ে দু’কথা জানেন না, এমন লোক আছে বলে মনে হয় না। যারা ব্যাঘ্রপ্রিয়, তারা বাঘের উপপ্রজাতি বিশেষ সম্বন্ধেও যৎকিঞ্চিত খোজঁখবর রাখেন। বাঘের এখন পর্যন্ত মোট নয়টি উপপ্রজাতি বিজ্ঞান মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাংলার বাঘ, ইন্দোচীনের বাঘ, মালয় বাঘ, সুমাত্রার বাঘ, আমুর বা সাইবেরীয় বাঘ, কাস্পিয়ান বা তুরানের বাঘ, জাভার বাঘ, বালির বাঘ এবং দক্ষিণ চীনের বাঘ। এদের মধ্যে বালি, জাভা আর কাস্পিয়ান বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আজ এদের নিয়েই আলোচনা হবে।

কাস্পিয়ান বাঘ

কাস্পিয়ান বাঘের অনেকগুলো নাম আছে। অঞ্চলভেদে এরা তুরানের বাঘ, পারস্যের বাঘ বা মধ্য এশীয় বাঘ নামে পরিচিত। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এরা মধ্য এশিয়া এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে থাকতো। তুরস্ক, চীনের পশ্চিমভাগ, রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চল এবং ইরান-ইরাকের উত্তরেও এদের দেখা পাওয়া যেত।

কাস্পিয়ান বাঘেরা আসলে সুদূর সাইবেরীয় বাঘের আত্মীয়বিশেষ। মানুষের কারণেই হোক বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে, এই দুই প্রজাতির বাঘেদের মধ্যে একটা সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারপর থেকেই এরা স্বতন্ত্র উপপ্রজাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে তাহলে কী হবে, সাইবেরীয় বাঘেদের মতো কাস্পিয়ান বাঘও আকারে পেল্লাই হত। ওজনে প্রায় আড়াইশো কেজি, লম্বায় প্রায় নয় ফুট।

কাস্পিয়ান বাঘের হাতেগোনা কয়েকটি ছবি মাত্র টিকে আছে। ছবিসূত্র: criptozoo.com

মধ্য এশিয়াতে আছে বিশাল দুই মরুভূমি- কিজিল কুম এবং কারা কুম। শুধু তা-ই বা বলি কেন, ইরান-তুর্কিমেনিস্তানের কোপেত দাগ পর্বতমালা থেকে শুরু করে চীনের টাকলা মাকান মরুভূমি এবং পশ্চিমে তুরস্ক, এই বরাবর রেখা টানলে যে বিরাট অঞ্চল পাওয়া যাবে, সেটাই এই উপপ্রজাতির বাঘদের আবাসভূমি ছিল। এখানকার প্রধান দুই নদী আমু দরিয়া আর সির দরিয়ার যাতায়াত পথের দু’পাশে গড়ে ওঠে জঙ্গল এবং জলাভূমি। সাথে কাস্পিয়ান সাগরের আশেপাশেও কিছুটা সবুজের সমারোহ দেখা যায়। এসব গাছ আর তৃণভূমিতে ভিড় জমাত ব্যাকটেরিয়ান হরিণ আর শূকরের পাল। কাস্পিয়ান বাঘেদের প্রধান শিকার ছিল এগুলোই। আকাশছোঁয়া বিরাট সব পাহাড় এদেরকে দিত নিরাপত্তা।

কোপেত দাগ পর্বতমালা; ছবিসূত্র: pinterest

মধ্য এশিয়াতে যুদ্ধবিগ্রহের খামতি কোনোকালেই হয়নি। তবে বিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার পরে যন্ত্রদানবদের কল্যাণে পাল্টে যেতে থাকে চিরাচরিত মধ্য এশিয়া। জারের রুশ সাম্রাজ্য বা পরবর্তীকালের সোভিয়েত ইউনিয়ন, উন্নয়নের হাড়িকাঠে প্রকৃতিকে বলি দিতে অন্তত শুরুর সেই বছরগুলোতে তাদের কারো বিশেষ আপত্তি ছিল না। হাজার হাজার একর জমিতে গড়ে তোলা হল তুলোক্ষেত। ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত এই ফসলটির কল্যাণে মানুষের পকেটে বিলক্ষণ অর্থ সমাগত ঘটল, কিন্তু তুলো চাষে আবার পানি লাগে প্রচুর। অতিরিক্ত সেঁচের প্রভাবে শুকিয়ে গেল নদী, খাদ্যের অভাবে কমে গেল তৃণভোজী শিকারের সংখ্যা। এর সাথে সাথে আবার বাশকির আন্দোলন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের ঘনঘটায় সমাগম ঘটল অস্ত্রের।

মধ্য এশিয়ার গোত্রগুলোর কাছে এই বিরাট কমলা-হলুদ প্রাণীগুলো শিকার করতে পারা ছিল এক দুর্লভ সম্মানের ব্যাপার। শুরু হলো দেদারসে শিকার। এতকিছুর ধাক্কা বাঘেরা সামলাতে পারেনি। চীন ও জর্জিয়াতে এরা বিশ এর দশকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। মোটামুটি চল্লিশ থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে মধ্য এশিয়া হয়ে পড়ে ব্যাঘ্রশূন্য। তুরস্কে আশির দশক পর্যন্ত বহাল তবিয়তে বাঘ শিকার চালু ছিল, বিলুপ্তির আগপর্যন্ত। সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি সে সময়ে। তবে সোভিয়েত আফগান যুদ্ধ বা পরবর্তী নব্বইয়ের দশকেও এই বাঘ দেখা যাওয়ার কথা শোনা গিয়েছে। ২০০৮ সালেও উজবেক সীমান্ত প্রহরীরা এই বাঘ দেখবার দাবি করেছেন।

সুদুর ভবিষ্যতে হয়তো বাঘেরা ফিরবে মধ্য এশিয়াতে; ছবিসূত্র: nationalgeographic

সোভিয়েত সরকার ১৯৪৭ সালে কাস্পিয়ান বাঘ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সোভিয়েত তাজিকিস্তানে একটা সংরক্ষিত অঞ্চল গড়ে তোলা হলেও তা যথেষ্ট ছিল না। ইদানিং অবশ্য রুশ ও কাজাখ সরকারের তরফ থেকে নতুন এক প্রস্তাব তোলা হচ্ছে। সেটা হলো, মধ্য এশিয়াতে সাইবেরীয় বাঘ এনে ছেড়ে দেওয়া। যেহেতু সাইবেরীয় আর কাস্পিয়ান বাঘের জিনগত মিল খুব বেশি, গবেষকদের ধারণা নতুন আমদানি করা এসব বাঘ দিব্যি মানিয়ে নিতে পারবে। তবে সমস্যা হলো বাঘেদের জায়গা অনেক বেশি লাগে (মধ্য এশিয়া্র ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় ১০০টি বাঘের জন্য অন্তত ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন্য পরিবেশ প্রয়োজন) এবং চিতাবাঘ বা শূকরের তুলনায় মনুষ্য উপদ্রুত অঞ্চলে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম।

কাজেই আমু দরিয়াতে পানি পানরত বাঘ দেখবার জন্য প্রকৃতিপ্রেমীদের আরো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন পর্যন্ত কাস্পিয়ান বাঘ বেঁচে থাকবে মধ্য এশীয় সাহিত্য আর শিল্পে।

ইন্দোনেশিয়ার দুর্ভাগা বাঘেরা

বাস্তবিকই ইন্দোনেশিয়ার বাঘেরা দুর্ভাগা। ধরুন, কোনো জঙ্গলে ব্যাপক শিকার আর গাছ কাটা শুরু হলে জঙ্গলের প্রাণীরা কী করে? অন্য জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার বাঘেদেরকে বিধাতা সেই সুযোগটা দেননি। প্রায় সতেরো হাজার দ্বীপবিশিষ্ট রাষ্ট্রটির তিনটি মাত্র দ্বীপে বাঘেদের আবাস ছিল জাভা, বালি এবং সুমাত্রা। এর মধ্যে সুমাত্রা ছাড়া বাকি দ্বীপ দু’টি বেজায় জনাকীর্ণ। ইন্দোনেশিয়ার বেশিরভাগ কলকারখানা, বড় শহর সব এখানেই গড়ে উঠেছে। ফলে, শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে জাভা আর বালি দ্বীপের বাঘ।

শেষ হিমযুগের পর বাঘেরা সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। এই বাঘেদেরই কয়েকটি দল একসময় এসে পৌঁছায় ইন্দোনেশিয়াতে। সমুদ্রতলের উচ্চতা কম থাকায় তখন ইন্দোনেশিয়া এশিয়ার মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত ছিল। এরপরে যখন সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে গেল, এসব বাঘে দ্বীপগুলোতে আটকা পড়ে গেল। সৃষ্টি হল আলাদা তিনটি ব্যাঘ্র প্রজাতি।

বালি দ্বীপের বাঘেরা আকারে ছোটখাটো হতো। সাত ফুটের মতো লম্বা আর শ’খানেক কেজির মতো ওজন হতো ওদের। ইন্দোনেশিয়াতে ডাচরা আসার পরপরই বেচারাদের সুখের দিন শেষ হয়ে এল। ইউরোপীয়রা হাতি নিয়ে, বন জঙ্গল তোলপাড় করে বাঘ মারতে লাগল। ইন্দোনেশিয়া যেহেতু কলোনি, এখান থেকে ফায়দা লোটা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা ডাচদের মাথায় ছিল না। বন-জঙ্গল ধ্বংস করে গড়ে তোলা হলো পাম অয়েলের খামার। ফলে চল্লিশ কিংবা বড়জোর পঞ্চাশের দশকেই বিলুপ্ত হয়ে যায় এই উপপ্রজাতিটি। সবথেকে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বালি দ্বীপের কোনো বাঘকে জীবিত অবস্থায় ধরা কোনোদিন সম্ভব হয়নি, কেউ ওদের কোনো ছবিও তোলেনি। ফলে, বালির বাঘেদের ব্যাপারে অনেক তথ্যই অন্ধকারে রয়ে গিয়েছে।

বালি দ্বীপের বারং মাকান ওরফে ব্যাঘ্র নাচ; ছবিসূত্র: indonesiatravelingguide.com

এবারে আসা যাক জাভার বাঘেদের প্রসঙ্গে। এরা আকারে বালির বাঘেদের তুলনায় কিছুটা বড় ছিল। ভাগ্যের দিক দিয়েও এরা কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। অন্তত সত্তরের দশক পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার সবথেকে জনবহুল প্রদেশে টিকে থাকতে পারাটাকে সৌভাগ্য হিসেবেই দেখা উচিত। এদেরকেও ইউরোপীয়রা দেদারসে গুলি করে মারত। তবে বালি দ্বীপ বাঘশূন্য হয়ে যাওয়ার পর চল্লিশের দশক থেকে জাভার বাঘেদের সংরক্ষণ করবার ব্যাপারে কর্তাদের টনক নড়ে। তবে চোরাশিকার আর বন ধ্বংস কমানো যায়নি। সত্তরের দশকের পর আর বাঘটির অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনো নির্ভেজাল প্রমাণ পাওয়া যায় না।

জাভার বাঘ; ছবিসূত্র: tigerforum

তবে আশি বা নব্বইয়ের দশক তো বটেই, একবিংশ শতাব্দীতেও জাভা দ্বীপের নানা প্রান্ত থেকে বাঘ দেখবার খবর পাওয়া গিয়েছে। এই বিগত ২০১৭ সালেই এক বনরক্ষী উজুং কুলন বনাঞ্চলে অস্পষ্ট গোছের ছবি তোলেন। সেখানে দেখা যায়, একটা বড় বেড়াল জাতীয় প্রাণী একটি ষাঁড় খাচ্ছে। জাভার বাঘ টিকে গিয়েছে ভেবে যথেষ্ট শোরগোল উঠলেও পরবর্তী সময়ে গবেষকেরা ছবির প্রাণীটিকে জাভার চিতাবাঘ হিসেবে রায় দেন।

ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গল; ছবিসূত্র: vacationbaliindonesia

জাভা ও বালি দ্বীপে আজ বাঘেরা না থাকলেও লোকজ সাহিত্যে তাদের স্থান খুবই দাপুটে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় সব গল্পকথাতেই বাঘকে উপস্থাপন করা হয় ভয়ানক কোনো ক্ষতিকর চরিত্র হিসেবে। ইন্দোনেশীয় গোত্রগুলোর মানুষ বাঘেদের দাঁত বা নখ গলায় তাবিজের মতো করে ঝুলিয়ে রাখে, বিশ্বাস করে, এতে করে অমঙ্গল বা বিপদ-আপদ ঘটে না। বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পেছনে এসব লোকজ বিশ্বাস দায়ী বলেও মনে করেন অনেকে।

ফিচার ইমেজ: Pinterest

Related Articles