
“রূপবতীদের মধ্যে নার্সিসাস কমপ্লেক্স দেখা যায়। তারা নিজের রূপের প্রেমে পড়ে, অন্য কারো প্রেমে পড়তে পারে না।” –হুমায়ুন আহমেদ।
চূড়ান্তরূপে আত্মমগ্নতা বা আত্মমুগ্ধতাকেই এককথায় বলে দেয়া যায় ‘নার্সিসাস কমপ্লেক্স’। নার্সিসিস্টিক ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য হলো আত্মপ্রেম ও আত্মমগ্নতা, নিজের গুণ সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করা, নিজেকেই এত গুরুত্ব দেয়া যে জীবনে অন্য কাউকে গুরুত্ব দেবার বিন্দুমাত্র স্থান না থাকা! এক্ষেত্রে মানুষ অন্যের কাছ থেকে প্রায় সব বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশংসা ও মনোযোগ আশা করে এবং তা না পেলে অনবরত অভিযোগ করতে থাকে। ‘নার্সিসিজম’ বা ‘নার্সিসাস কমপ্লেক্স’ নামটি ব্যবহার করা হচ্ছে ১৯৬৮ সাল থেকে।

আমিই সেরা!
এ অবস্থায় ব্যক্তি নিজেকেই সম্ভাব্য সকল কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু মনে করে। একজন নার্সিসিস্ট প্রায় সবসময়ই অন্যের জীবনে নাক গলায় এবং ভাবে যে, সে ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করছে। তার এ সাহায্য যদি কেউ না চায়, তবে সে ভাবে যে সে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি বা প্রশংসাটুকু পাচ্ছে না! নার্সিসিস্টরা সাধারণত বিশ্বাস করে যে, তারা অন্যদের দিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন। কিন্তু প্রকৃতার্থে তারা তাদের স্বীকৃতি পাওয়া নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন থাকে!

আমার আমি
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নার্সিসিজম
মনোসমীক্ষণতত্ত্বের একটি ধারণা হচ্ছে এই ‘নার্সিসিজম’ অথবা ‘নার্সিসাস কমপ্লেক্স’। ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে ১৯১৪ সালে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নার্সিসিজমের ওপর লেখা একটি রচনা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে। ১৯২০ সালে ‘American journal of Sociology’-তেও এর বেশ ভালো ধারণা পাওয়া যায়। এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে প্রথম বর্ণনা করেন রবার্ট ওয়েল্ডার। এই জটিলতাটি সর্বপ্রথম শনাক্ত করেন হ্যাভেলক এলিস, ১৮৯৮ সালে। ১৮৯৮ সালে হ্যাভেলক এলিসের গবেষণায় তিনি কোনো ব্যক্তির অতিরিক্ত স্বমেহনের ফলে সে কীভাবে নিজেই নিজের যৌনসঙ্গী হয়ে যায় তা বলতে গিয়ে ব্যবহার করেন ‘Narcissus-like’ শব্দটি। ১৮৯৯ সালে পল ন্যাকে, যৌনবিকৃতির একটি অধ্যয়নে ‘narcissism’ শব্দটি বলেন।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞানী মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড যা বলেন, “ছোটবেলায় নার্সিসিজম একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তার সীমানা যদি বয়ঃসন্ধিকালকেও অতিক্রম করে ফেলে, তবে একে মানসিক ভারসাম্যহীনতার একটি স্তর বলেই গণ্য করা হবে।”
যেজন্য একে নার্সিসাস কমপ্লেক্স বলা হয়
গ্রীক পুরাণের একটি কাহিনী অনুযায়ী, নার্সিসাস নামে একজন অতি সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। তিনি দেখতে এতই রূপবান ছিলেন যে, তার আশেপাশের প্রায় সব নারীই তার প্রেমে পড়তো! কিন্তু তিনি কাউকেই তেমন পাত্তা দিতেন না, নিজের মতো চলে যেতেন পাশ কাটিয়ে। নারীরা যতই তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করুক না কেন, নার্সিসাস কারো দিকেই ফিরে তাকাতেন না।
নার্সিসাসের এই কাহিনী বলতে গেলে যার কথা বলতেই হয়, তিনি হলেন জলপরী ইকো।
জিউসের পত্নী দেবী হেরার সাথে কিছু শত্রুতাবশত ইকোর কপালে জুটেছিলো এক নিদারুণ অভিশাপ! ইকো কখনো নিজে থেকে প্রথমে কোনো কথা বলতে পারতেন না, তিনি অন্যের কথার শেষ অংশটুকুর পুনরাবৃত্তিই করতে পারতেন শুধু। ভাগ্যের আরেক পরিহাস, এই ইকোও গভীর প্রেমে পড়লেন নার্সিসাসের। তাতে কী হবে, তিনি যে কখনো নার্সিসাসের সাথে কথাই বলতে পারতেন না! মনের দুঃখে ইকো বনে চলে গেলেন। একদিন নার্সিসাসও সেই বন অতিক্রম করছিলেন, এমন সময় তিনি বনের মধ্যে কারো উপস্থিতির আঁচ পেলেন। নার্সিসাস নীরবতার মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “কেউ আছে এখানে?”। ইকো আনন্দিত স্বরে প্রতিধ্বনি করলেন, “আছে, আছে”। ইকো গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকায় নার্সিসাস তাকে দেখতে পেলেন না, তাই আহ্বান করলেন, “এসো!”। এতদিন ধরে এই তো বলতে চেয়েছিলেন ইকো! ইকো উৎফুল্ল হয়ে উত্তর দিলেন, “এসো”।
গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন ইকো, দুহাত বাড়িয়ে দিলেন তার প্রিয়তম নার্সিসাসের দিকে। কিন্তু হায় আত্মমুগ্ধ নার্সিসাস! তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন ইকোর কাছ থেকেও। তিনি বললেন, “আমি বরং মরে যাবো, পরে তোমাকে ক্ষমতা দেবো আমার ওপর”। ইকোও বলতে থাকলেন, “তোমাকে ক্ষমতা দেবো আমার ওপর”। নার্সিসাস ততক্ষণে চলে গেছেন সে স্থান ছেড়ে। এরপর ইকো দুঃখে-শোকে-লজ্জায় নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন একটি গুহায়।
এদিকে নার্সিসাসেরই দ্বারা অপমানিত এক নারীর প্রার্থনা শুনে, ন্যায়পরায়ণ ক্রোধের দেবী নেমেসিস নার্সিসাসের জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। “যে অন্যকে ভালবাসে না, সে নিজেকে ভালবাসুক”- এই ছিল তার সিদ্ধান্ত। জলপান করতে গিয়ে নার্সিসাস একটি ঝিলের জলে ঝুঁকে পড়েন, জলের মাঝে তার চোখ পড়ে, সেই সাথে জলে ফুটে ওঠা তার প্রতিবিম্বের প্রতিও। মুহূর্তেই নিজের প্রেমে পড়লেন নার্সিসাস! এরপর একে একে কেটে গেল রাত-দিন, তিনি সেখান থেকে সরতে পারলেন না। নার্সিসাস এমন একজনকে ভালবেসেছিলেন, যাকে তিনি কখনো পাবেন না। এভাবেই একদিন তার মৃত্যু হয় নিজেকে দেখতে দেখতে।
নার্সিসাসের এই গল্পের সাথে মনোবিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন মানবচরিত্রের অদ্ভুত এক জটিলতার, যাকে তারা নার্সিসাসের নাম দিয়েছেন-‘নার্সিসিজম’ বা ‘নার্সিসাস কমপ্লেক্স’।
নার্সিসিজম কি একটি সমস্যা?
নার্সিসিজমকে মূলত সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর কারণে সমাজের অন্যান্য সদস্যের সাথে মিশতে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নার্সিসিস্ট ব্যক্তির জগত শুধু তাকে ঘিরেই; কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মানুষের স্বভাবে সবসময়ই বিনিময়প্রথা লক্ষ্য করা যায়। একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতে তথ্যের আদান-প্রদান, মত বিনিময় এবং একে অন্যকে নিয়ে ভাবাটা খুব বেশি জরুরী। একজন নার্সিসিস্ট ব্যক্তির সাথে তাই সম্পর্ক তোলাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
একজন নার্সিসিস্ট তার পছন্দ-অপছন্দকে সবসময় তার সামনের মানুষটির ওপর চাপিয়ে দেন, ঐ মানুষটিরও যে নিজস্ব মতামত থাকতে পারে, তা তিনি মাথায়ই আনেন না। তাই মানিয়ে চলা মুশকিল হয়ে পড়ে। নার্সিসিস্টরা হয়তো এ কারণেই খুব একা হয়ে থাকে এবং সেজন্য প্রতিনিয়ত অভিযোগও করে। এরা একসময় আশেপাশের মানুষের জন্য বিরক্তিকর হয়ে পড়ে এবং মানুষ এদের এড়িয়ে চলতে থাকে।
নার্সিসিজমের সাথে সফলতার একটি যোগসূত্র দেখা যায়। নার্সিসিজম ব্যক্তিকে চূড়ান্ত স্বার্থপর করে তোলায় তিনি ভেবেই নেন যে, সফলতার প্রথম স্থানটি তার হবে। নিজেকে সবচেয়ে বেশি বিশেষ ভাবার কারণে সফলতার প্রতি ঝোঁকও বেশি হয়ে থাকে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সফল স্বৈরাচারী শাসকরা কোনো না দিক দিয়ে নার্সিসিস্ট ছিলেন।
নার্সিসিজমের কারণ কী?
অদ্ভুত এই মানসিক অবস্থার কোনো কারণকেই এখনো মনোবিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট করতে পারেন নি। তবে তারা এর একটি জীবমনঃস্তাত্ত্বিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন। এই মডেলটি বলে যে- নার্সিসিজমের পেছনে পরিবেশগত, সামাজিক, বংশগত ও স্নায়ুজীববিজ্ঞানগত একটি সমন্বয় দায়ী। যদি কেউ তার প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজনীয় মনোযোগ না পায়, যদি পরিবারে বা বংশে কেউ নার্সিসিস্ট হয়ে থাকে, একাকীত্ব- এসবই নার্সিসিজম তৈরি করতে পারে।
নার্সিসিজম থেকে উত্তোলনের উপায় কী?
নার্সিসিজমের চিকিৎসা করা খুব কঠিন, কারণ এক্ষেত্রে রোগীরা কখনোই মানতে চান না যে তাদের কোনো সমস্যা আছে। তারা নিজেদেরকে নিখুঁত মনে করেন এবং তাদের কোনোকিছুই শুধরানো প্রয়োজন বলে মনে করেন না। তাই এ থেকে উত্তোলনের উপায় হয়তো নিজে সচেতন হওয়া, নিজের ভুল খুঁজে বের করা।
কারা ভোগেন নার্সিসিজমে?
গবেষণায় বলা হয়, শতকরা ১ভাগ মানুষ এই জটিলতায় ভোগেন। এর স্থায়িত্ব দীর্ঘসূত্রিতায় পৌঁছে তবে চিরস্থায়ী হয় না। নারীদের চাইতে পুরুষের মধ্যে এবং বয়স্কদের চাইতে অল্পবয়সীদের মধ্যে বেশি নার্সিসিজম দেখা যায়।
নিজেকে ভালোবাসা দোষের নয়, বরং নিজেকে না ভালোবাসলে অপরকে ভালোবাসা যায় না। কিন্তু আমরা তখনই ‘নার্সিসিজম’ বা ‘নার্সিসাস কমপ্লেক্স’ শব্দটি ব্যবহার করবো যখন আত্মপ্রেম কারো কারো জন্য সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে।