মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর লিঙ্গ জন্মের পূর্বেই নির্ধারিত হয়। প্রাণী পুরুষ নাকি স্ত্রী হবে তা, সাধারণত সেক্স ক্রোমোসোমের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে সামুদ্রিক প্রাণীসহ অনেক প্রাণীতে সেক্স ক্রোমোসোম থাকে না। তাই তাদের সেক্স বা লিঙ্গ জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয় না। মস্তিষ্কের প্রভাব ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় কিছু কিছু প্রাণীর লিঙ্গ। বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী যেমন– মাছের অনেক প্রজাতি আছে যারা স্ত্রী হিসেবে জন্ম নিলেও পরবর্তীতে পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। আবার কিছু প্রজাতির প্রাণী আছে যারা পুরুষ হিসেবে জন্ম নিলেও একসময় স্ত্রী প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়। এরকমই কয়েকটি চমক জাগানিয়া প্রাণীর কথা নিয়ে আজকের আয়োজন।
ক্লাওন ফিশ
এরা অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের প্রবালপ্রাচীরের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। এশিয়ার দেশ জাপানের দক্ষিণাংশে প্রচুর পরিমাণে দেখা মেলে এদের। উজ্জ্বল কমলা বর্ণের সাথে তিনটি সাদা সরু দাগাঙ্কিত রেখার মাছটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪.১ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা হয়ে থাকে।
এদেরকে উভলিঙ্গ মাছ বলা হয়। জন্মের সময় এদের সবগুলোই পুরুষ হিসেবে জন্ম নেয়। জীবনের এক পর্যায়ে স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হওয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে এদের। কিন্তু একবার পুরুষ থেকে স্ত্রীতে রূপান্তরিত হলে আর পুরুষে ফিরে আসতে পারে না। দুটি পুরুষ সদস্য একত্রে মিলনের সময় আকারে যেটি বড় সেটি স্ত্রীতে পরিণত হয়। এদের দলে কোনো স্ত্রী মাছ যদি মারা যায় তাহলে অন্য একটি পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হয়ে শূন্যস্থান পূরণ করে।
হক ফিশ
প্রবালপ্রাচীরের পাশে বসবাসকারী মাছের আরেকটি প্রজাতি হলো হক ফিশ। স্ত্রী হিসেবে জন্ম নিলেও এরা পরিণত বয়সে পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। সামুদ্রিক মাছের অনেক প্রজাতির মাঝে এমন রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও হক ফিশে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে এবং পরিবেশ অনুকূলে থাকলে পুনরায় পূর্বের লিঙ্গে ফিরে আসতে পারে। জন্মের সময় স্ত্রী হয়ে জন্মানোর পর যদি তা পুরুষে রূপান্তরিত হয়, তবে প্রয়োজন অনুসারে তা আবারো স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হতে পারবে।
মোরে ঈল
অধিকাংশ মোরে ঈল জন্মগতভাবে পুরুষ ও স্ত্রী আলাদা আলাদাভাবে জন্মায়। সেগুলো বাকি জীবন এভাবেই থাকে। তবে কিছু কিছু ঈল প্রজাতি উভলিঙ্গের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যেমন জেব্রা এবং ড্রাগন মোরে ঈল। জীবনের কোনো পর্যায়ে যদি পুরুষ সদস্যের সংখ্যা কমে যায় তবে তারা পুরুষে পরিবর্তিত হয়।
স্নো ফ্লেক ঈল জন্মের সময় স্ত্রী হিসেবেই জন্ম নেয়। কিন্তু পরিণত বয়সে পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অপরদিকে রিবন মোরে ঈল জন্মের সময় পুরুষ হিসেবে জন্মালেও পরবর্তীতে বেশকিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে স্ত্রী ঈলে পরিণত হয়। ছোট পুরুষ রিবন মোরে ঈলের পৃষ্ঠদেশে হলুদ পাখনা থাকে। তারা যখন পূর্ণ বয়স্ক ও ডিম নিষিক্ত করতে থাকে তখন তাদের মুখ ধীরে ধীরে নীল ও হলুদ হতে থাকে। যখন কিছুটা বড় হয় তখন স্ত্রী জননাঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে। এরপর জীবনের বাকি সময় ডিম দানকারী স্ত্রী ঈল হিসেবেই কাটিয়ে দেয়।
দুই লিঙ্গধারী মুরগি
একধরনের জিনগত ত্রুটির কারণে কিছু প্রাণী ও পতঙ্গে একইসাথে পুরুষ ও স্ত্রী বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। এক্ষেত্রে পুরুষ লিঙ্গধারী অংশ পুরুষত্বের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে দেয় এবং স্ত্রী লিঙ্গধারী অংশ স্ত্রী লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এভাবে একই প্রাণীতে একইসাথে স্ত্রী ও পুরুষ বৈশিষ্ট্য সক্রিয় থাকে। এই অবস্থাকে বলে গাইনানড্রোমরফিজম (Gynandromorphism)।
এ ধরনের অবস্থা হলে হলে এরা অন্য স্ত্রী মুরগির সাথে সঙ্গমের জন্য লাফিয়ে ওঠেম, আবার ছোট আকারের ডিমও পারে। এ ধরনের দ্বিপার্শ্বীয় বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে কঙ্কালের গঠন দুই পাশে দুই রকম হয়ে থাকে। এদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংশের গঠনও ভিন্ন হয়। এছাড়াও ময়নাতদন্ত করলে ভিতরে অণ্ডকোষ ও ডিম্বকোষ দুটোই পাওয়া যায়।
নর্দান কার্ডিনাল পাখি
দুই লিঙ্গধারী মুরগির মতো বৈশিষ্ট্য মাঝে মাঝে কার্ডিনাল পাখিতেও দেখা যায়। এই পাখির একদিকের অর্ধাংশ স্ত্রী পাখির মতো বাদামী-ধূসর পালকে আবৃত থাকে আর বাকি অর্ধাংশ পুরুষ পাখির মতো উজ্জ্বল লাল বর্ণের পালক দ্বারা আবৃত হয়ে থাকে।
এসবক্ষেত্রে সচরাচর বাম পাশটা স্ত্রী ও ডান পাশটা পুরুষ পাখির বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়। ওয়েস্টার্ন ইলিওনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান পিয়ার এবং তার সহকর্মী রবার্ট মোট্জ বন্য পরিবেশে গাইনানড্রোমরফিজমের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের পর্যবেক্ষণ ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এ সময় তারা ৪০টি নর্দান কার্ডিনাল পাখির উপর পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন। স্বাভাবিক পাখির ডাক ও মিলনে আগ্রহের প্রতি দ্বিপার্শ্বীয় পুরুষ-স্ত্রী কার্ডিনাল পাখির প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায় এ ধরনের দ্বিপার্শ্বীয় পুরুষ-স্ত্রী পাখি কখনোই ডাকেনি এবং মিলনেও আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবে স্বাভাবিক পাখিগুলো কখনো এই পাখিগুলোকে আক্রমণও করেনি।
ব্যাঙ
গবেষণাগারে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ব্যাঙের লিঙ্গ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বন্য পরিবেশেও পুরুষ ব্যাঙের, স্ত্রী ব্যাঙে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ফসলের আগাছা দমনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক অ্যাট্রাজিনের প্রভাবে পুরুষ ব্যাঙ, স্ত্রী ব্যাঙে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই রূপান্তরের পর স্ত্রী ব্যাঙ স্বাভাবিক ব্যাঙের মতোই সফলভাবে সন্তান উৎপাদন করতে পারে।
বর্তমানে ইউরোপীয় দেশগুলোতে অ্যাট্রাজিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অ্যাট্রাজিন ফসলের মাঠ থেকে নদীতে গিয়ে পড়ে। অতঃপর ব্যাঙের টেস্টোস্টেরন (পুরুষ সেক্স হরমোন) উৎপাদন কমিয়ে দেয়। অপরদিকে এটি ইস্ট্রোজেন (স্ত্রী সেক্স হরমোন) উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ফলে দেখা যায় কোনো এক জলজ পরিবেশে শুধুমাত্র স্ত্রী ব্যাঙ উৎপাদিত হচ্ছে। শুধুমাত্র স্ত্রী ব্যাঙের সংখ্যা বাড়ায় প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। অর্থাৎ অ্যাট্রাজিনের প্রভাবে ব্যাঙের সংখ্যা প্রতিনিয়ত হ্রাস পেয়েছে।
বেয়ার্ড ড্রাগন
অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা খুঁজে পান, বেয়ার্ডেড ড্রাগন লিজার্ড ডিমের ভেতরে থাকার সময়ই তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। গবেষকরা আরো দেখেছেন অদ্ভুতভাবে যারা পুরুষ থেকে স্ত্রীতে পরিবর্তিত হয় তারাই ভালো মাতৃগুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে।
গবেষণায় জানা যায়, ডিম ফোটানোর সময় তাপমাত্রা যখন বেশি হয় তখন অধিকাংশ স্ত্রী ড্রাগনের জন্ম হয়। তাপমাত্রার প্রভাবে অন্যান্য প্রাণীরও লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। যেমন- কুমির, লিওপার্ড গেকো, সামুদ্রিক সবুজ কচ্ছপ ইত্যাদি। তাই বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধির কারণেও এদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফিচার ইমেজ – 7wallpapers.net