মনে করুন, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন চারপাশে অজস্র সব কুমিরছানা। নাদুসনুদুস সেই কুমিরছানারা রোদে গা এলিয়ে খেলা করছে, ডিম ফুটে বেরুচ্ছে কেউ কেউ। বিশাল সাইজের কুমিররা সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। যারা কুমির ভয় পান তারা হয়তো স্বপ্নেও এমন দৃশ্য কল্পনা করেন না। কিন্তু বাস্তবে যদি এই দৃশ্য দেখতে চান তাহলে যেতে হবে থাইল্যান্ডের কুমিরের খামারগুলোতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কুমিরের খামারগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, দেখে আসতে পারেন কীভাবে এই প্রাণীদের জীবনযাত্রা বয়ে চলছে।
থাইল্যান্ডের কুমিরশালায় স্বাগতম
পুরো থাইল্যান্ড জুড়েই দেখা মিলবে অসংখ্য কুমিরের খামারের। থাই সরকারের মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এক হাজারেরও বেশি কুমিরের খামার আছে দেশ জুড়ে।
আর খামারগুলোতে ঠিক কত কুমির আছে, সেই সংখ্যাটা শুনেও রীতিমতো পিলে চমকে উঠবার জোগাড়। কম করে হলেও ১২ লাখ কুমিরের আবাসস্থল হিসেবে পরিণত হয়েছে এই খামারগুলো।
আয়ুথায়া কুমির খামার
থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় কুমিরের খামার আর প্রজননকেন্দ্রটি অবস্থিত আয়ুথায়া প্রদেশে। ‘শ্রী আয়ুথায়া কুমির খামার’ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৩৫ বছর পাড়ি দিয়েছে।
এই কুমির খামারেই আছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক কুমির। এই বিপুল সংখ্যক কুমির লালন পালন আর দেখভালের জন্যেও আয়ুথায়া প্রদেশে তৈরি হয়েছে বিশাল কর্মসংস্থান। আর এই ব্যাপারটিকে থাই অর্থনীতির জন্য বেশ ইতিবাচক মনে করেন বিশাল এই কুমিরশালার কর্ণধার উইচিয়ান রুয়েঙ্গনেট।
আছে কুমির রপ্তানির অনুমতিও
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, শুধু কুমির পালন করে ঠিক লাভের জায়গাটি কোথায়! শ্রী আয়ুথায়া কুমির খামারের কুমির রপ্তানির জগতে বেশ সুনাম আছে। এই খামারটি সহ থাইল্যান্ডের বেশ কয়েকটি খামার ‘The Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora (CITES)’ নামক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে প্রজননকৃত ‘স্বাদু পানির কুমির’ রপ্তানিতে এদের আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে থাইল্যান্ডের এই স্বাদু পানির কুমিরের প্রধান বাজারটি গড়ে উঠছে চীনকে কেন্দ্র করে।
খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অবকাঠামো
থাইল্যান্ডের কুমির খামারগুলোতে কুমির প্রজনন থেকে শুরু করে লালন পালন করে বড় করা হয়। পরিণত বয়সে পৌঁছে যাবার পর কুমিরকে বধ করা, মাংস আর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে খামারগুলোতেই। ডিম সংগ্রহ আর ডিম থেকে কুমিরের বাচ্চা উৎপাদনকে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠছে কর্মসংস্থান।
সংগৃহীত ডিমগুলোকে যাচাই বাছাই করে উপযুক্ত তাপমাত্রা আর পরিবেশে রেখে দেওয়া হয় পরিস্ফুটনের জন্য। পরবর্তীতে তা থেকে কুমিরছানা উৎপাদন আর দেখভালের কাজটি করা হয় বেশ সতর্কতার সাথে।
তবে কুমির পালন মোটেও সহজসাধ্য নয়
কুমির মূলত মাংসাশী প্রাণী। বড় বড় দাঁতের পাটি আর শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে ছোটবড় প্রাণীকে শিকার করতেই পছন্দ করে। হিংস্র এই প্রাণীকে তাই খাঁচায় কৃত্রিম পরিবেশে লালন পালন একটু কষ্টসাধ্য বটে। খাদ্য হিসেবে এদের প্রথম এবং একমাত্র পছন্দ মাংস। আর কৃত্রিম পরিবেশে যেহেতু শিকার ধরার সুযোগ নেই বললেই চলে, সেহেতু খামারিদের সেই চাহিদা মেটাতে হয় কৃত্রিমভাবে সরবরাহকৃত মাংস দিয়েই।
তাই কুমিরের প্রত্যাশিত বৃদ্ধির জন্য খামারিদের যোগান দিতে হয় বিপুল পরিমাণ মাংসের। পাশাপাশি শিকারী এই প্রাণীদের পরিচর্যা করার জন্যে দরকার দক্ষ জনবলের। তাই কুমির পালন একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে বেশ বিপজ্জনক। উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন না করলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
থাইল্যান্ডের এই কুমির খামারগুলো থেকে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি হয় কুমিরছানাও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা চিড়িয়াখানা কিংবা একুরিয়ামের জন্যে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কুমিরের একটা বড় অংশের যোগান দেয় এই খামারগুলো।
মূল্যবান রপ্তানিদ্রব্য কুমিরের চামড়া
কুমিরের চামড়া বেশ মূল্যবান রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য। কারণ কুমিরের চামড়া থেকে তৈরি হয় হাতব্যাগ কিংবা জ্যাকেটের মতো বিলাসবহুল দ্রব্যাদি।
কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো ‘বিরকিন স্টাইলের’ একটা হ্যান্ডব্যাগের দাম ২,৩৫৬ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর কুমিরের চামড়ায় নির্মিত জ্যাকেট কিংবা স্যুটের দাম প্রায় ৫,৮৮৫ ডলার। বিশ্বজুড়ে এসব বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে থাইল্যান্ডের কুমিরের খামারগুলো হয়ে উঠছে লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র।
চাহিদা আছে কুমিরের মাংসেরও
বিশ্বজুড়ে আছে কুমিরের মাংসের চাহিদাও। প্রতি কেজি কুমিরের মাংসের মূল্য প্রায় প্রায় ৯ মার্কিন ডলার। থাইল্যান্ডের রেস্তোরাঁ আর পর্যটক গন্তব্যগুলোতেও বেশ ভালো চাহিদা আছে এই কুমিরের মাংসের। চাহিদা আছে কুমিরের পিত্ত আর রক্তেরও।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ
পুরো থাইল্যান্ড জুড়ে গড়ে উঠা বড় বড় এইসব কুমিরের খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে করেছে আলাদা একটি পর্যটন শিল্পও। প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমিরদের জীবনযাত্রা খুব কাছ দেখতেই অনেকেই পাড়ি জমান এই কুমির খামারগুলোতে। পাশাপাশি এসব পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দেখার সুযোগ মিলবে কীভাবে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা কুমিরের মুখের ভেতরে মাথা ঢুকিয়েও অক্ষত অবস্থায় তা আবার ফেরত নিয়ে আসছেন!
প্রাণী সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
থাইল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাদু পানির জলাশয়গুলোতেই বেশ উল্লেখযোগ্য হারে কুমির দেখা যেত। কিন্তু স্বাদু পানিতে অপরিমিতভাবে মাছ শিকার এবং কুমিরের বাসস্থান নষ্টের ফলে কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো পড়েছে হুমকির মুখে। মানুষের এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কারণেই বিশ্ব জুড়ে প্রায় সাতাশ প্রজাতির কুমির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরো অনেক প্রজাতি ধুঁকে ধুঁকে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। ভারতীয় উপমহাদেশের জলাশয়গুলোতে পাওয়া যেত লম্বা চোয়ালের এক কুমির, যা ঘড়িয়াল নামেই পরিচিত। বাসস্থানের দূষণ আর অতিরিক্ত মাছ শিকারের কারণে মাছের উপর নির্ভরশীল এই কুমির প্রজাতিটিও হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
পাশাপাশি মূল্যবান চামড়াও অনেকটা কাল হয়েছে কুমিরের জন্যে। বিশ্ববাজারে কুমিরের চামড়ায় নির্মিত বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা থাকায় অবৈধভাবে শিকার করে চামড়া পাচারের কারণেই হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক দুর্লভ প্রজাতির কুমির। কিন্তু থাইল্যান্ডের এই কৃত্রিম খামার থেকে বৈধ উপায়ে চামড়া আসার ফলে একদিকে যেমন সে রাস্তা বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে না হলেও কৃত্রিম পরিবেশে সংরক্ষিত এই কুমির রেহাই পাচ্ছে হারিয়ে যাওয়ার করাল গ্রাস থেকে।
ফিচার ইমেজ: reuters.com