১৯৩০ সালের আগেও অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া আর পাপুয়া নিউ গিনির বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ঘুরে বেড়াত এক বিশেষ জাতের প্রাণী। তার মুখ আর দেহটা দেখতে কুকরের মতো। পিঠে বাঘের মতো কালো ডোরাকাটা দাগ। আর লেজটা ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো, যেন তিনটি প্রাণী মিলে বিশেষ এক জাতের প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে অদ্ভুতুড়ে এক প্রাণীর কথা যার নাম থাইলাসিন। এদেরকে তাসমানিয়ান টাইগার নামেও ডাকা হতো।
একটা সময় পর্যন্ত সুখে দিন কাটলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৮০০ সালের দিকে প্রাণীটির উপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মানুষ আর প্রকৃতির নির্মমতায় একের পর এক মারা পড়তে থাকে প্রাণীটি। একসময় যে প্রাণীর সংখ্যা ছিল অগণিত, ১৯০০ সালের দিকে এসেই সেই প্রাণীর সংখ্যা হয়ে যায় হাতে গোণার মতো। ধারণা করা হয়, ইউরোপের তাসমানিয়াতেই কমপক্ষে ৫ হাজার থাইলাসিনের বসবাস ছিল। কিন্তু শিকারে পরিণত হওয়া, বাসস্থান ধ্বংস আর রোগব্যাধির কারণে প্রাণীটি খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯৩০ সালে মানুষের জানা সর্বশেষ বন্য থাইলাসিনটি এক শিকারির গুলিতে নিহত হয়। এরপর আর কোনো দিন বন্য থাইলাসিনের দেখা মেলেনি। ১৯৩৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রাণীটি সংরক্ষিত ঘোষণা করে। কিন্তু ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। বন্য থাইলাসিন তো আগেই শেষ, চিড়িয়াখানায় রাখা সর্বশেষ থাইলাসিনটিও মারা যায় একে ‘সংরক্ষিত প্রাণী’ ঘোষণার ৫৯ দিন পর।
১৯৩৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, অস্ট্রেলিয়ার হোবার্টের বোম্যারিস চিড়িয়াখানায় বেঞ্জামিন নামের সর্বশেষ থাইলাসিনটি মারা যায়। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রাণীটিকে সরকারিভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু রিপোর্ট এসেছে যে, থাইলাসিনদের আবার দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াতেই নাকি এদের দেখা পেয়েছেন কেউ কেউ। তবে থাইলাসিনের দেখা পাওয়া নিয়ে যেমন বিতর্ক রয়েছে, তেমনি আশায় বুকও বাঁধছেন অনেকে।
থাইলাসিন পরিচিতি
থাইলাসিন শব্দটি এসেছে গ্রীক এবং পরবর্তিতে ল্যাটিন শব্দের মাধ্যমে। এর মানে হচ্ছে কুকুরের মতো মাথা কিন্তু ক্যাঙারুর মতো থলি আছে এমন প্রাণী। থাইলাসিন দেখলে মনে হবে এর মাথাটা কুকুরের, লেজটা ক্যাঙ্গারুর আর গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ। তবে অল্প বয়সে এই দাগ স্পষ্ট বোঝা গেলেও বয়স বাড়লে তার গাঢ়ত্ব কমতে থাকে। অনেকটা বাঘের মতো দেখতে লাগে বলে এক তাসমানিয়ান টাইগারও বলা হয়।
থাইলাসিনের স্বাভাবিক ওজন প্রায় ২৫ কেজি এবং উচ্চতা প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার। দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৫ সেন্টিমিটার। এর গায়ের রঙ হলদেটে বাদামি। পিঠে কালো ডোরাকাটা দাগ। লেজটার দৈর্ঘ্য ৫০-৬৫ সেন্টিমিটারের মতো। মারসুপিয়াল প্রাণী হওয়াতে স্ত্রী থাইলাসিনের পেটের দিকে থলি রয়েছে। তবে পুরষ থাইলাসিনের কোনো থলি নেই। এর বৈজ্ঞানিক নাম Thylacinus Cynocephalus।
বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন এই প্রাণীটি আদতে অর্ধ-নিশাচর এবং লাজুক প্রাণী। মানুষের সাথে যেকোনো ধরনের যোগাযোগই এরা এড়িয়ে চলতে চায়। থাইলাসিনরা মাংশাসী প্রাণী। তৃণভোজী প্রাণী, পাখি, ক্যাঙ্গারু এবং অন্যান্য মারসুপিয়াল প্রাণী খেয়েই বেঁচে থাকতো এরা।
অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখন্ড, পাপুয়া নিউ গিনি এবং তাসমানিয়ায় থাইলাসিনদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলেই বসবাস ছিল এদের। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, তাসমানিয়া বাদে বাকি সব অঞ্চল থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগেই থাইলাসিনরা বিলুপ্ত হয়।
বিলুপ্তির কারণ
১৮০০ সালের দিকে তাসমানিয়ায় যখন প্রথম উপনিবেশ স্থাপিত হয় তখন ওই অঞ্চলে কৃষির সূচনা হয় আর কৃষিশিল্পও গড়ে ওঠে। নতুন বসতি স্থাপনকারীরা নিজেদের আর ভেড়ার মতো গবাদি পশুর জন্য প্রচুর জমি ও বন কেটে বসবাসের উপযোগী করে। কিন্তু মানুষের অতি প্রয়োজনীয় গবাদি পশুগুলো বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আক্রমণের শিকার হতে থাকে। ‘গবাদি পশুর এমন ক্ষতির পেছনে বন্য কুকুর আর অব্যবস্থাপনা দায়ী’ এমন প্রচুর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সন্দেহের তীর যায় থাইলাসিনদের দিকে। বসতিরা মনে করতে থাকে থাইলাসিনরাই তাদের গবাদি পশু শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে থাইলাসিনদের প্রতি মানুষের ঘৃণা আর ক্ষোভ বাড়তে থাকে। মানুষ নিজেদের গবাদিপশু বাঁচাতে থাইলাসিনদের মারতে শুরু করে।
১৮৩০ সালের দিকে তাসমানিয়ার সরকার খুব বাজে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়, যারা মৃত থাইলাসিন নিয়ে আসতে পারবে তাদেরকে পুরস্কার দেওয়া হবে। ফলে অনেকেই অর্থের জন্য থাইলাসিন শিকার শুরু করে। ১৯০৯ সাল পর্যন্ত চলে সরকারের এ কার্যক্রম। এ সময় প্রায় ২,১৮০টি থাইলাসিনকে হত্যা করা হয়।
তবে ধারণা করা হয়, ১৮৩০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার থাইলাসিনকে হত্যা করে মানুষ। তাছাড়াও বন্য কুকুরদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বেঁচে থাকা, খোসপাচড়া রোগসহ আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে থাইলাসিনদের সংখ্যা কমতে থাকে।
বিলুপ্তি নিয়ে বিতর্ক
থাইলাসিনরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও গবেষকদের দাবি থাইলাসিনকে বিলুপ্তির হাত থেকে ফিরিয়ে আনবেন তারা। ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে থাইলাসিনকে আবার ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন গবেষকরা। ক্লোনিং করে থাইলাসিন ফিরিয়ে আনার পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তি তর্ক রয়েছে, তবে এটাও মানতে হবে যে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে থাইলাসিনদের ফিরিয়ে আনার এ প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল এবং জটিল।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় জাদুঘরের কাছে থাইলাসিনদের নিয়ে ব্যাপক সংগ্রহ রয়েছে। এসব সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওয়েট স্পেসিমেন (তরলে সংরক্ষিত জৈবিক নমুনা)। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার অ্যানাটমি ইনস্টিটিউটের সংগ্রহে রয়েছে দুটি থাইলাসিনের চামড়া, কঙ্কাল এবং ত্রিশটিরও বেশি দেহাংশ। এসব সংগ্রহ থাইলাসিন ক্লোনিংয়ে বেশ সাহায্য করবে।
তবে কাগজ-কলমে থাইলাসিনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও থাইলাসিন নাকি এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অনেকেই নাকি থাইলাসিনের দেখা পেয়েছেন। থাইলাসিনের সন্ধানে নানা গবেষণা আর অনুসন্ধানও চলছে। তাসমানিয়ার জঙ্গলে এখনও খোঁজাখুঁজি চলছে থাইলাসিনের। অনেকে থাইলাসিনের দেখা পেয়েছেন এমন রিপোর্টও হয়েছে মিডিয়াতে। এদিকে থাইলাসিনের সন্ধান পাওয়ার বিচ্ছিন্ন খবর পাওয়া গেলেও কার্যকর প্রমাণ না থাকার কারণে এখনো সরকারিভাবে প্রাণীটি বিলুপ্ত প্রাণীর তালিকাতেই রয়েছে।
বেঁচে আছে কি থাইলাসিনরা?
থাইলাসিনদের বিলুপ্ত ঘোষণার পরও সম্প্রতি প্রায় প্রতি বছরই কেউ না কেউ এদের দেখেছেন বলে দাবি করছেন। কিন্তু প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত এবং কার্যকর দলিল দেখাতে না পারার কারণে সেসব দাবি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। তবে যারা এদের দেখেছেন বলে দাবি করেছেন তারা তাদের দাবির বিষয়ে অনড়।
প্রাণীবিদ জেরেমি গ্রিফিথ এবং কৃষক জেমস ম্যালে থাইলাসিনের সন্ধান করেছেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। তারা দুজনে বিভিন্ন ক্যামেরা স্টেশন স্থাপন করেছেন এবং সার্ভে করেছেন। পরে একটি গবেষক টিমও তৈরি করেছেন। কিন্তু এত বছর সন্ধান করেও তারা থাইলাসিনের দেখা পাননি।
পরবর্তীতে অনেকেই থাইলাসিন দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। ২০০৫ সালে জার্মান পর্যটক ক্লস এমেরিকস এবং বিরগিট জানসেন তাসমানিয়ায় বেড়াতে এসে থাইলাসিনের দেখা পান বলে দাবি করেন।
২০০৭ সালে তিনজন তদন্তকারী দাবি করেন তারা থাইলাসিনের দেখা পেয়েছেন। এদের একজন ছিলেন আদ্রিয়ান রিকার্ডসন যিনি থাইলাসিন নিধনের সময় প্রায় ২৬ বছর থাইলাসিন শিকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, ২০০৭ সালে তারা যে প্রাণীটি দেখেছেন সেটি থাইলাসিন ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী হতেই পারে না।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে থাইলাসিনের দেখা পাওয়ার কমপক্ষে সাতটি রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে তারা যে প্রাণীটিকে দেখতে পেয়েছেন সেটি দেখতে অনেকটা বড় শিয়ালের মতো কিন্ত শিয়ালের মতো লোম নেই এবং পিঠের দিকে কালো ডোরাকাটা দাগ আছে।
২০১৮ সালে একজন অস্ট্রেলীয় নাগরিক তার বাড়ির উঠোনের সিসি ক্যামেরার ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে একটি প্রাণীকে দেখা যায় যা দেখতে হুবহু থাইলাসিনের মতোই।
২০১৯ সালে ভিক্টোরিয়ার একজন কৃষক তার জমির পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। এ সময় তিনি একটি বিশেষ প্রাণীকে দেখতে পান যেটি শিয়ালের চেয়ে বড় এবং গায়ে ডোরাকাটা দাগও রয়েছে, লেজটাও অনেক বড়। তিনি সেটির ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে আপলোডও করেন। তার মতে প্রাণীটি থাইলাসিনই ছিল। যদিও সেই ছবির কোয়ালিটি ছিলো নিম্নমানের।
সম্প্রতি থাইলাসিনের দর্শন পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন এক মহিলা। তিনি নাকি দুটি বাচ্চাসহ মা থাইলাসিনকে দেখেছেন হার্টজ পাহাড়ের পাশে।
গত কয়েক বছরে থাইলাসিনের সন্ধান পাওয়ার অনেক ভিডিও আর ছবি নিয়ে অনেকেই এই প্রাণীর দেখা পাওয়ার দাবি করেছেন। তবে সেসব ভিডিও আর ছবির কোয়ালিটির কারণে থাইলাসিনের বেঁচে থাকার বিষয়ে এখনও নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ।
থাইলাসিনের সন্ধান পাওয়ার এত এত দাবি অনেকের মনেই আশা জাগাচ্ছে যে হয়তো থাইলাসিনরা এখনও তাসমানিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বুকেই হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি হয়তো এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে বিশেষ এই প্রাণীদের কয়েকটি। এমনও হতে পারে, আবার দল বেঁধে ঘুরতে দেখা যাবে বিশেষ এই প্রাণীদের।