প্রকৃতিতে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস রয়েছে। রয়েছে সুবিশাল পর্বত, গাছপালা, নদ-নদী, ফুল-ফল ও নানা ধরনের প্রাণী ও পাখির সমাহার। এগুলোর অধিকাংশই নানাভাবে আমাদের আকৃষ্ট করে। একটি ছোট্ট পাখির কিচিরমিচির, ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলার দৃশ্য, সৌন্দর্য ইত্যাদি সহজেই মানুষের মন কেড়ে নিতে পারে। পাখির ডাকে ঘুম না ভাঙলে পাখি প্রেমিকদের সকালটা অপূর্ণই থেকে যায়। এ পর্যন্ত ১০,০০০ এর অধিক প্রজাতি ও ২২,০০০ উপপ্রজাতির ১৯ মিলিয়নেরও অধিক পাখি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে এই পাখিদের অনেকেই আছে যারা আনন্দের পরিবর্তে বিপদেরও কারণ হতে পারে, যারা মানুষের জীবন পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। আজ জানাবো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক এমনই কয়েকটি পাখির কথা।
কেশোয়ারী
দেখতে অনেকটা টার্কির মতো হলেও কেশোয়ারী টার্কির মতো নিরীহ নয়। নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেইনফরেস্ট এদের আবাসস্থল। এরা রেটিট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত পাখি। এই পরিবারের পাখিরা উড়তে অক্ষম। তবে ঘন্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। এদের ত্বক সম্পূর্ণ নীল বা নীল দাগযুক্ত এবং পালক সম্পূর্ণ কালো হয়। মাথায় হাড়ের তৈরি বর্মের মতো শক্ত গঠন থাকে। এরা সাধারণত ৬ ফুট উঁচু এবং ওজন প্রায় ৬০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এদের ক্ষুরের মতো ধারাল স্পার ও নখরযুক্ত শক্তিশালী পা রয়েছে। প্রতিটি পায়ে ৩টি করে নখর রয়েছে। এদের পা এতোই শক্তিশালী যে, লাথি দিয়ে কুকুর ও ঘোড়াকে মেরে ফেলতে পারবে। এই পাখির মাঝের নখটি প্রায় ৫ ইঞ্চি লম্বা, ছুরির মতো ধারালো ও তীক্ষ্ন হয়। এরা এমন নখযুক্ত পা দ্বারা মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই একজন মানুষের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করতে সক্ষম!
বিপজ্জনক হলেও কেশোয়ারীর আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা তেমন জানা যায় না। এ পর্যন্ত একজন ১৬ বছর বয়সী এক বালকের কথা জানা যায়। ফিলিপ ম্যাকক্লিন নামের বালক ও তার ভাই ১৯২৬ সালে একটা কেশোয়ারীকে হত্যার জন্য আঘাত করে। তখন কেশোয়ারী পাল্টা আক্রমণ করে বসে। সেটি ধারালো নখের সাহায্যে ম্যাকক্লিনের গলার শিরা কেটে ফেলে! ২০০৭ সালে গিনেসবুক কেশোয়ারীকে সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখির তালিকায় স্থান দিয়েছে।
উটপাখি
উটপাখিকে আফ্রিকার মুক্তাঞ্চলে পাওয়া যায়। এরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় জীবিত পাখি। পুরুষ উটপাখি প্রায় ৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। এদের ওজন হয় ১৫০ কিলোগ্রাম।
বিপজ্জনক পরিবেশে উটপাখি তার শক্তিশালী পায়ের উপর নির্ভর করে। একটি ভীত উটপাখি ঘন্টায় প্রায় ৭২ কিলোমিটার বেগে দৌঁড়াতে পারে। এদের পায়ে খুরের মতো গঠন বিশিষ্ট দুটি শক্ত ও ধারাল নখ আছে। তারা যদি মানুষের দ্বারা বাচ্চার বিপদ ও বাসস্থান হারানোর ভয় পায়, তবে আক্রমণ করে বসে। এরা লাথি দিয়ে সিংহ ও বড় ধরনের শিকারীকে মেরে ফেলতে পারে। উটপাখিও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতর মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম।
ইউরোপীয় হেরিং গল
ইউরোপীয় হেরিং গল উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ মহাদেশের পাখি। ২০১৫ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, পূর্ণবয়স্ক হেরিং গল পাখির সংখ্যা ১৩,৭০,০০০- ১৬,২০,০০০।
হেরিং গল শহুরে জনবসতিতে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ থেকে খাবার সংগ্রহের উদ্দেশে বাসা বাঁধে। এরা মানুষের খাবার চুরি করতে খুবই পারদর্শী। খাবার চুরির জন্যই বেশিরভাগ সময় মানুষের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়।
হেরিং গল বাসা তৈরি ও ডিম পাড়ার সময়েও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়। এদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়, কারণ এরা দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে। যদি একা কোনো পাখি আক্রমণ করে পেরে না ওঠে, তবে সে অন্যান্য পাখিকে সাহায্যের জন্য ডাকে। তখন দলবদ্ধভাবে ক্ষুরের মতো ধারাল ঠোঁট দিয়ে মানুষকে জখম করে।
গ্রেট উত্তরাঞ্চলীয় লুন
পাখি প্রজাতির বিবর্তনের শুরু থেকে টিকে থাকা একটি পাখি হচ্ছে গ্রেট উত্তরাঞ্চলীয় লুন। এদের উষ্ণমণ্ডলীয় বনাঞ্চল, উত্তর আমেরিকার তুন্দ্রা অঞ্চল এবং ইউরেশিয়ার উত্তরাঞ্চলে পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখলে যে কেউই পাখিটিকে হাঁস ভেবে ভুল করতে পারেন। কিন্তু পাখিটিকে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে পেঙ্গুইন ও অ্যালবাট্রোসের সাথে মেলানো হয়। সাঁতার কাটার সময় এদের শরীর হাঁসের থেকে কম ভেসে থাকে।
এই পাখির দৈর্ঘ্য ২৪-৩৯ ইঞ্চি এবং পাখার দৈর্ঘ্য ৬০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে বড় লুন পাখির ওজন ছিল প্রায় ৬ কিলোগ্রাম। এদের ক্ষুরের মতো ধারালো ঠোঁট রয়েছে, যার সাহায্যে শিকারের মাংস কেটে খায়। এরা মানুষকে আক্রমণ করলে মাথা ও ঘাড়ে ঠোকর দিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করতে পারে। মানুষকে মেরে ফেলার ইতিহাস তেমন না থাকলেও একজন পক্ষীবিদকে শিকার ভেবে হত্যা করার কথা জানা যায়!
রাজহাঁস
রাজহাঁস হচ্ছে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বৃহৎ জলজ পাখিদের মধ্যে একটি। এদের ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে পাওয়া যায়। তবে উত্তর আমেরিকারও কিছু কিছু এলাকায় এদের দেখা যায়। এরা সাধারণত সাড়ে এগারো কিলোগ্রাম থেকে কিছুটা বেশি ওজন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের পাখা প্রায় ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
শান্ত-নীরব রাজহাঁস তার সৌন্দর্যে আপনাকে কাছে টানতেই পারে। কিন্তু এদের কাছে যাওয়ার পূর্বে মনে রাখতে হবে, এরা মোটেও শান্ত-নীরব নয়। বিশেষ করে শিশুদের এদের কাছে যেতে দেয়া উচিত নয়। কারণ রাজহাঁস যেকোনো সময়ে, বিশেষত ডিম পাড়ার সময়কালে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এরা বিশাল পেশীযুক্ত পাখার সাহায্যে আঘাত করে মারাত্মকভাবে আহত করতে পারে। এদের আঘাতে সাধারণত চোখই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান ম্যাগপাই
অস্ট্রেলিয়ান ম্যাগপাই অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বিপজ্জনক পাখি। মাঝারি আকারের এই পাখি তৃণভূমি, বিস্তৃত মাঠ, পার্ক, বাগানসহ অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সর্বত্রই বাস করে।
এরা আবাসিক এলাকার রাস্তা ও পার্কে বাসা তৈরি করে। এরা শান্ত স্বভাবের পাখি হলেও বসন্তকালে বাসা নির্মাণ ও ডিম পাড়ার সময় খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। নিজস্ব বাসা রক্ষার জন্য যেকোনো ধরনের বিপদকে নির্ভয়ে মোকাবেলা করে। এরা মানুষকে আক্রমণ করে ত্বক ও চোখ জখম করতে পারে।
ল্যামিগায়ার শকুন
ল্যামিগায়ার বিশ্বের সকল পুরনো শকুন প্রজাতির মধ্যে একটি। জার্মান ভাষায় একে ‘ল্যাম্ব ভালচার’ বলা হয়। যখন ভেড়ার বাচ্চা অসুস্থ হয় কিংবা মারা যায়, তখন এরা তা খায়। এজন্যই এমন নামকরণ। এদেরকে দাড়িওয়ালা শকুনও বলা হয়। এদের ওজন ৬ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই শকুনের প্রসারিত পাখার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত হয়।
ল্যামিগায়ার ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ও এশিয়ার উচ্চ পর্বত বিশিষ্ট এলাকায় বাস করে। এরা পঁচা মাংস এবং হাড় খায়। ছোট ছোট হাড় পুরোটাই খেতে পারলেও বড় হাড় খেতে বিপত্তিতে পড়ে যায়। কিন্তু তারা শক্ত হাড় খেতে না পারলেও হাড়ের মজ্জা খাওয়া ছাড়তে নারাজ। ল্যামিগায়ার শকুন মজ্জা খাওয়ার জন্য অনেক উঁচু আকাশ থেকে শক্ত পাথরকে লক্ষ্য করে হাড় ফেলে দেয়। হাড় ফেলে মজ্জা বের করার কৌশলটাই মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এই কৌশল অবলম্বন করে শকুন কচ্ছপেরও খোলস ফাটিয়ে খায়। জানা যায়, ল্যামিগায়ারের ফেলা কচ্ছপ মাথায় পড়ে গ্রীক নাট্যকার এসচিলাসের মৃত্যু হয়েছিল।
আলোচিত পাখিগুলো বিপজ্জনক হলেও একটি বিষয় লক্ষ করলে দেখা যায়, তারা সবসময়ই আক্রমণ করে বসে না। সাধারণত কোনো প্রকার বিপদের সম্মুখীন না হলে এরা আক্রমণ করছে না। প্রায় সকল প্রাণী ও পাখিই এমন। তাই তাদের বিপদে ফেলে আক্রমণাত্মক না করাই হবে প্রাণী ও পাখিপ্রেমীদের কাজ।
ফিচার ইমেজ – mdahlem.net