সভ্যতার বিকাশে মানুষ ছাড়া যে প্রাণীটির অবদান সবচেয়ে বেশি সেটি হচ্ছে ঘোড়া। মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঘোড়া এবং মানুষের মধ্যে সেই আদ্যিকাল থেকেই সহজাত বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারপর থেকে ঘোড়া হয়ে ওঠে মানুষের বিশ্বস্ত সহচর। আজকের উত্তরাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা যখন ছিল না, তখন দূরযাত্রার জন্য ঘোড়াই ছিল একমাত্র বাহন। পণ্যদ্রব্য পরিবহন ও কৃষিক্ষেত্রেও সেকালে ঘোড়া ব্যবহৃত হতো। তবে ঘোড়া সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্রে এর ভূমিকার কল্যাণে। কত সাহসী যোদ্ধার কত তেজস্বী ঘোড়া যে কত রাজ্যজয়ের সঙ্গী হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এজন্যই ইতিহাসে ঘোড়া বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ঘোড়ার যে গুণাবলির কারণে সাধারণত মানুষ ঘোড়া পছন্দ করে, সেগুলো হলো গতি, শক্তিমত্তা, উদ্দামতা, তেজ, আনুগত্য, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি। আরো একটি কারণে মানুষ ঘোড়া পছন্দ করে। সেটি হচ্ছে ‘সৌন্দর্য’। ঘোড়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীগুলোর একটি। সব ঘোড়াই কমবেশি সুন্দর, তবে কিছু ঘোড়া দেখলে সত্যিই চোখে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। রুপকথার পঙ্খীরাজ হয়তো নয়, তবে তারচেয়েও কম সুন্দর নয় এই ঘোড়াগুলো। এমনই কিছু ঘোড়ার কথা জানাবো আমাদের আজকের আয়োজনে।
১. আখাল টেকি
আখাল টেকি প্রজাতির ঘোড়া মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তানের জাতীয় প্রতীক (National Emblem)। শক্তিমত্তা, সহনশীলতা ও চকচকে চামড়ার মোহনীয় সৌন্দর্যের কারণে এই ঘোড়ার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। আখাল টেকি প্রজাতির ঘোড়া নানা রঙের হয়ে থাকে। এর মধ্যে হরিণের চামড়ার মতো রঙের (বাকসিন) ঘোড়ার শরীরের চামড়া ধাতুর মতো চকচক করে বলে এই ঘোড়াটি ‘স্বর্ণালী অশ্ব (Golden Horse)’ নাম পেয়েছে।
রাজকীয় সৌন্দর্য ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে ধকল সহ্য করে দীর্ঘসময় টিকে থাকার ক্ষমতার কারণেও এই ঘোড়ার সুখ্যাতি আছে। আখাল টেকি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন অশ্বপ্রজাতিগুলোর একটি।
বর্তমানে এই প্রজাতির খুব অল্প সংখ্যক ঘোড়াই পৃথিবীতে টিকে আছে। দুষ্প্রাপ্য এই ঘোড়া সাধারণত তুর্কমেনিস্তান ও রাশিয়ায় পাওয়া যায়। আখাল টেকি পৃথিবীর অন্যতম দামী ঘোড়া।
২. ফ্রিসিয়ান
আকর্ষণীয় ফ্রিজিয়ান প্রজাতির ঘোড়ার উৎপত্তি নেদারল্যান্ডের ফিসল্যান্ড এলাকায়। ফ্রিজিয়ান ঘোড়ার বিশেষত্ব হচ্ছে এর দীর্ঘ কালো শরীর আর ঘাড় ছাড়িয়ে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া লম্বা কেশর। এর কেশর দেখলে মনে হয় যেন এলোকেশী কোনো রমণীর বাধাহীন চুল হাওয়ায় উড়ছে। বিশাল আকৃতি আর কঠোর চেহারা দেখে এদের উদ্ধত ভেবে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আদতে এরা খুবই নম্র স্বভাবের হয়ে থাকে।
ফ্রিজিয়ান ঘোড়ার ভালো পরিবহন ক্ষমতার কারণে মধ্যযুগে এই ঘোড়া অস্ত্রসজ্জিত যোদ্ধাদের পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগের পর এই প্রজাতির কদর অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কয়েক দশক ধরে আবারো ফ্রিজিয়ান ঘোড়ার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
৩. জিপসি ভ্যানার
সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াদের কথা বলতে গেলে যার কথা বলতেই হবে সে হচ্ছে জিপসি ভ্যানার। ঘোড়াদের জগতে ভিন্নরকম এক সৌন্দর্যের উপমা জিপসি ভ্যানার। সাদা-কালোর নান্দনিক সংমিশ্রণ জিপসি ভ্যানারের শরীরে সৌন্দর্য যোগ করার সাথে সাথে এর নম্র স্বভাবকেও যেন প্রকাশ করে। এই প্রজাতির ঘোড়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর শরীরের চুলের বিন্যাস। এর রয়েছে হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত বিস্তৃত লম্বা চুল।
লাস্যময়ী জিপসি ভ্যানারের চোখ ঢেকে দেওয়া ঘন চুলের লম্বা কেশর দেখে মনে হয় যেন কোনো দীর্ঘকেশী তরুণীর অবাধ্য কেশগুচ্ছ কপালে এসে পড়েছে। হৃদয়কাড়া সৌন্দর্যের জন্য এর দামও অস্বাভবিক বেশি। তবে এত সুন্দর এই ঘোড়ার জন্ম হয়েছিল ভার বহনের জন্য! ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের জিপসিরা তাদের ভবঘুরে জীবনের তল্পিতল্পা পরিবহনের জন্য এই সংকর ঘোড়া জন্মানোর পরিকল্পনা করেছিল।
৪. এরাবিয়ান
অতুলনীয় সৌন্দর্য আর দুরন্ত গতির জন্য পুরো পৃথিবীতেই সুপরিচিত আরবি ঘোড়া। বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মাথা এবং উঁচু লেজের এরাবিয়ান হর্স দেখতে দারুণ আকর্ষণীয়। আরব উপদ্বীপেই এই ঘোড়ার উৎপত্তি। প্রায় ৪,৫০০ বছর ধরে এই প্রজাতি পৃথিবীতে টিকে আছে। আরব মরুভূমির বুকে নির্ভীক বেদুঈনের দুর্বার গতিতে ছুটে চলা এরাবিয়ান হর্সেরই অবদান।
এরাবিয়ান হর্স অবশ্য একসময় ব্যবসা বাণিজ্য আর যুদ্ধের বদৌলতে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্দান্ত গতির কারণে এখনকার প্রায় সব রেসের ঘোড়ায়ই কম-বেশি এরাবিয়ান ঘোড়ার রক্তের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।
৫. আন্দালুসিয়ান
আন্দালুসিয়ান ঘোড়ার উৎপত্তি ইবেরিয়ান উপদ্বীপের রুক্ষ, পাহাড়ি অঞ্চলে। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ঘোড়া। আন্দালুসিয়ান ঘোড়ার ক্রমবিকাশ ঘটেছে দক্ষিণ স্পেনে। এজন্যই হয়তো সুন্দরী আন্দালুসিয়ান ঘোড়ার আরেক নাম খাঁটি স্প্যানিশ ঘোড়া। প্রশস্ত কপাল সম্বলিত মাথা, দৃষ্টিনন্দন কেশর আর শক্তিশালী পায়ের আন্দালুসিয়ান ঘোড়া দেখলে চোখে নিখাঁদ মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতেই হবে।
ক্ষিপ্রতা আর দুর্লভ সাহসিকতার জন্য এককালে স্পেনের অশ্বারোহী বাহিনীতে ব্যবহার ছিল আন্দালুসিয়ান ঘোড়ার। তারপর যোদ্ধাদের রসদের বোঝা ভারী হওয়ার সাথে সাথে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয় হালকা ভারের আন্দালুসিয়ান। তবে এখনো রাইডিং হর্স হিসেবে জনপ্রিয় ধূসররঙা দারুণ সুন্দর এই ঘোড়া।
৬. অ্যাপালুসা
অ্যাপালুসা ঘোড়া পরিচিত এর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ফুটকিযুক্ত চামড়ার কারণে। পৃথিবীতে ফুটকিওয়ালা চামড়ার ঘোড়ার ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীনকালে মিশর, চীন, পারস্যে এরকম ঘোড়ার প্রচলন ছিল। তিলকিত চামড়ার ঘোড়া অনেক পরে স্পেনে জন্মানো হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে কোনোভাবে এই প্রজাতির ঘোড়া মেক্সিকোতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মেক্সিকো থেকে উত্তর আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রজাতি। উত্তর আমেরিকার নেজ পার্সি ইন্ডিয়ানদের ফুটকি চামড়ার ঘোড়ার সাথে মুসট্যাঙ ঘোড়ার সংকর করার কারণে জন্ম হয় নতুন প্রজাতির এক ঘোড়ার।
নেজ পার্সিরা পেলর নদীর অববাহিকায় বাস করত বলে এই ঘোড়াটিকে ডাকা হতো পেলর ঘোড়া নামে। পরে অ্যাপালুসা নামে ডাকা শুরু হয়। অ্যাপালুসার গায়ের বিচিত্র এই নকশার নানা রুপ আছে, আছে নানা নাম। যেমন- চিতাবাঘ ফুটকি (leopard spotted), ফুটকিওয়ালা কম্বল (spotted blanket), তুষার ছড়ানো কম্বল (frosted blanket) প্রভৃতি।
৭. মাসট্যাঙ
বুনো পশ্চিমের ধুলো ওড়া মরুভূমিতে দাপিয়ে বেড়ানো ঘোড়ার পদধ্বনি মানেই মাসট্যাঙ। আমেরিকার বুনো পশ্চিম এলাকায় ব্যবহৃত প্রধান ঘোড়াগুলোর একটি হচ্ছে মাসট্যাঙ। আমেরিকান মাসট্যাঙ ঘোড়ার পূর্বপুরুষরা এসেছিল স্পেন থেকে। পোষা স্প্যানিশ পূর্বপুরুষ নানা প্রজাতির সাথে মিশে তৈরী করেছে মাসট্যাঙ।
মাসট্যাঙ প্রজাতির ঘোড়াকে ‘বুনো ঘোড়া’ বলা হলেও এরা ঠিক ‘বুনো’ নয়। কোনো প্রাণীকে বুনো (wild) কথাটা বলাটার অর্থ হচ্ছে ঐ প্রাণীটি কোনদিনই পোষ মানেনি। কিন্তু মাসট্যাঙ এসেছে গৃহপালিত পূর্বপুরুষ থেকে। তাই এদেরকে ওয়াইল্ড না বলে বরং ফেরাল বলা হয়। মানে এরা স্বাধীনভাবে বনে চড়ে বেড়ানো ঘোড়া যারা এককালে পোষা ছিল, পরে জঙ্গলে পালিয়েছে।
৮. হাফলিঙ্গার
অস্ট্রিয়া এবং উত্তর ইতালির সবুজ অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলকেই হাফলিঙ্গারের জন্মভূমি মনে করা হয়। তাম্রবর্ণের হাফলিঙ্গার দেখতে বেশ আদুরে। এর স্বভাব ও সৌন্দর্যকে তুলনা করা চলে উচ্ছ্বল কোনো শিশুর সাথে। নম্র স্বভাবের হলেও দারুণ ক্ষিপ্র হাফলিঙ্গার। এদের চলার ধরনে আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। মূলত পাহাড়ে ঘোরাঘুরির কাজেই হাফলিঙ্গার ব্যবহার করা হয়।
৯. মরগান
মরগান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন ঘোড়া প্রজাতি। সরু মাথা, লম্বা গ্রীবা আর দীঘল লেজের মরগান ঘোড়ায় এক ধরনের রুক্ষতা আছে। তারপরও সুন্দর ঘোড়াদের কথা বলতে গেলে মরগান ঘোড়ার কথা আসে। তবে এরা যতটা না সুন্দর তার চেয়ে বেশি কাজের। আমেরিকার ইতিহাসে মরগান ঘোড়ার বিশেষ অবদান আছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল এই ঘোড়া। এছাড়া ঘোড়সওয়ার ও জিনিসপত্র পরিবহন করেও মরগান ঘোড়া আমেরিকানদের কম সেবা করেনি। মরগান ঘোড়া মূলত এর বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত।
১০. মাড়ওয়ারি
প্রতিবেশী ভারতের যোধপুর অঞ্চলের দুঃসাহসী ঘোড়া মাড়ওয়ারিও কম সুন্দর না। ভেতরের দিকে ভাঁজ করা কান দেখে সহজেই এদের চেনা যায়। এরাবিয়ান হর্সের সাথে ভারতের স্থানীয় ঘেড়ার সংকরের ফলে বিশাল মাড়ওয়ারি ঘোড়ার উৎপত্তি ঘটেছে। মাড়ওয়ারি এলাকায় যুদ্ধক্ষেত্রেই এই ঘোড়া বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মাড়ওয়ারি ঘোড়া বেশ পরিচিত।
ফিচার ইমেজ- kb4images.com