Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাওবাব: মরুভূমির এক অদ্ভুত গাছের সন্ধানে

ঘটনাটি ঘটেছিলো স্বর্গে। চমৎকার সুন্দর একটি গাছ ছিলো সেখানে। কিন্তু সুন্দর জিনিসের ভাগ্য বরাবর খারাপ হয়; সবার কুদৃষ্টি পড়ে তার উপরে। আর শয়তানের মাথায় তো মন্দবুদ্ধি গিজগিজ করছে। সে তখন স্বর্গেই থাকতো। শয়তান যখন অত সুন্দর গাছটিকে দেখলো, তার গা জ্বলে উঠলো। গাছটির পেছনে না লাগলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না সে। তাই তক্কে তক্কে রইলো। একদিন সুযোগ বুঝে গিয়ে গাছটিকে উপড়ে ফেলল সে। তারপর সেটাকে পৃথিবীতে এনে ডালপালা শুদ্ধ মাটির গভীরে উল্টো করে পুঁতে ফেললো। আর শিকড়গুলো রয়ে গেলো মাটির উপরে।

বেচারা গাছ! তার তো আর হাত-পা নেই যে চাইলেই সোজা হয়ে যাবে। উল্টো হয়েই রইল অমন। গল্পটি সত্য কি মিথ্যা তা কে জানে? তবে গাছটি কিন্তু সত্যি। বিশ্বাস না হলে যেতে হবে আফ্রিকার মরুভূমির বুকে। সেখানে কাউকে বলবেন, “মশাই, একটু বাওবাব গাছ দেখতাম! দেখানো যাবে?”

ভালো কথা, এই গাছটির নামই হলো বাওবাব গাছ!

শিকড় যেন আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে; source: pinterest

নিবাস

গাছটির আদি নিবাস আফ্রিকা, আরব এবং অস্ট্রেলিয়াতে; পাওয়া যায় মাদাগাস্কার এবং ভারতের কয়েকটি অঞ্চলেও। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মেসিনা নামক অঞ্চলে। তাই মেসিনাকে বলা হয় দ্য বাওবাব টাউন। মাদাগাস্কারে বাওবাব গাছকে ‘টি পট ট্রি’ বলে, কারণ কান্ডের সাথে চায়ের কাপের অদ্ভুত মিল। অস্ট্রেলিয়ায় একে বলে দ্য প্রিজন ট্রি, মানে জেলখানা গাছ! কেন? লেখাটি শেষ করলেই তার উত্তর মিলবে।

গাছের কথা

বাওবাব গাছ Adansonia গণের উদ্ভিদ, জন্মে মরুভূমিতে। একহারা গড়নের গাছের কান্ডটি মাটি থেকে সোজা উর্ধ্বমুখী। ডালপালার বালাই নেই বললেই চলে। মাথায় ঝোপের মতো কয়েকটি ডাল ছাতার মতো সাজানো। দূর থেকে দেখলে কারো মনে হবে একটি গাছকে বুঝি কেউ উঠিয়ে শিকড় উপুড় করে পুঁতে দিয়েছে! এই অদ্ভুত দর্শন আকারের কারণে প্রথমোক্ত গল্পের উৎপত্তি হয়েছে।

সানল্যান্ড বিগ বাওবাব; source: pinterest

সবচেয়ে বড় গাছটি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার লিনপোপো প্রদেশের একটি খামারে, উচ্চতা ৪৭ মিটার আর বেড় ২২ মিটার। এর নাম সানল্যান্ড বিগ বাওবাব

গাছটির মালিক এই গাছটির কান্ডের মধ্যে এক বার খুলে বসেছে। এক প্রকান্ড গাছের কান্ডের ভেতরে হাতে পানীয়ের গ্লাস, সাথে মৃদু ভায়োলিনের আওয়াজ; বেশ জমেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে বারে যাওয়া পরের কথা, চাইলেই আপনি এই মহাবৃক্ষকে এমনি এমনি দর্শনই করতে পারবেন না। আগে আপনাকে ট্যাঁকের টাকা খরচ করে দর্শনী দিতে হবে। কার্বন ডেটিং করে এই গাছটির বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৬,০০০ বছর। ভাবা যায়!

গাছটির যখন জন্ম, সম্রাট আলেক্সান্ডার তখনও পৃথিবীতে আসতে সাড়ে তিন হাজার বছর দেরি। সক্রেটিসের খোঁজ নেই। পিরামিড তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

শিমুল গোত্রীয় গাছটি পত্রমোচী ঘরানার। বছরের অধিকাংশ সময়ে কোনো পাতা থাকে না। তখন মৃত গাছ বলে ভ্রম হয়। গ্রীষ্ম শেষে নতুন পাতা গজায় বাওবাব গাছে। পাতা না থাকলেও এরা কান্ডের ভেতরে খাদ্য এবং পানি সঞ্চয় করে রাখে। খাদ্য-পানি সঞ্চিত হতে হতে কান্ডটি ব্যারেলের মতো মোটা হয়ে যায়। কোনো কোনো গাছ তার কান্ডে ১,২০,০০০ লিটার পানি ধরে রাখতে পারে। এত পানি নিজের শরীরে ধরে রাখলেও জলাবদ্ধ জায়গায় এরা বাঁচতে পারে না। প্রাণীকূলের হাত থেকে যথেষ্ঠ সুরক্ষিত এরা, একমাত্র হাতিই পারে এর ক্ষতি করতে। আরেক জাতের ছত্রাক এদের জন্য প্রাণঘাতী। সব গাছের আকার এক রকম হয় না। এদের আকার নির্ভর করে এলাকা ও প্রজাতির উপরে।

ব্যবহার

বাওবাবের কান্ড এত পুরু যে তা অগ্নি প্রতিরোধী। কান্ড থেকে একধরনের তন্তু পাওয়া যায়। সেগুলো থেকে তৈরি হয় দড়ি, বাদ্যযন্ত্রের তার, জলনিরোধী ব্যাগ, এমনকি ছাতাও। বাওবাব ফুল বেশ বড় এবং দেখতে সাদা রঙের। এদের ফল ১৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়। প্রমাণ সাইজের ফলগুলো থেকে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত শাঁস, যা বেশ সুস্বাদু খাবার। টক-মিষ্টি স্বাদের বাওয়াব ফল দুগ্ধজাত খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

বাওবাব ফল; Source: dw.com

মালাউইয়ের অধিবাসীরা এ ফল দিয়ে তৈরি করে দারুণ এক জুস। ভিটামিন সি তে পরিপূর্ন এই ফল, সাথে আছে এন্টি অক্সিডেন্ট এবং পর্যাপ্ত আঁশ। এই এন্টি অক্সিডেন্ট কী করে তা কমবেশি সবারই জানা আছে। শরীররে বুড়িয়ে যেতে বাধা দেয় এই এন্টি অক্সিডেন্ট আর আঁশ পাকস্থলীকে সুস্থ রাখতে দারুণ কার্যকরী। বীজ থেকে তৈরি হয় তেল, সৌন্দর্যচর্চায় যার দারুণ চাহিদা রয়েছে। ভেজে খেতেও মন্দ না বাওবাব বীজ।

আর ফলের খোসা! সেগুলো দিয়ে তৈরি হয় পাল্প এজেন্ট। এদের পাতাও ফেলনা নয়। দারুণ স্বাদের চাটনি তৈরি হয় এদের পাতা সিদ্ধ করে। মালাউই, জাম্বিয়া আর জিম্বাবুয়েতে দারুণ জনপ্রিয় এই চাটনি। টাটকা এবং শুকনো- দু’ভাবেই খাওয়া হয় এদের পাতার নির্যাস। উত্তর নাইজেরিয়াতে এদের আলাদা নাম পর্যন্ত আছে- কুকা। কুকা সুপের প্রধান উপাদান এটি।

জাপানি এক কোম্পানী বাজারে ছেড়েছে বাওবাব পেপসি নামে হালকা টক স্বাদযুক্ত ঠান্ডা পানীয়। তবে বাধ সেধেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তারা কেন জানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাওবাব ফলকে। তাই আস্ত ফল পাওয়া যাবে না ইউরোপে। কিন্তু তাই বলে বাওবাব প্রেমীরা মানবে কেন? স্বল্প পরিসরে ছাড়পত্র দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বলতে গেলে বাধ্য হয়েই। ইউরোপের সুপার মার্কেটে তাই পাওয়া যাচ্ছে বাওবাব ফলের শাঁস।

মানুষের আবাস

মাদাগাস্কারের প্রকান্ড সব বাওবাব গাছের কোটরে একসময় সেখানকার আদিবাসীরা বসবাস করতো। আর অস্ট্রেলিয়ার বাওবাবগুলো ব্যবহার হতো আরো বৈচিত্র্যময় কাজে। সেখানকার অধিবাসীরা কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতো বাওবাবের প্রকান্ড খোঁড়ল। কোনো কোনো কোটরে নাকি ২০-২৫ জন বন্দীও ধরে যেত! ভাবুন তাহলে কতবড় হয় বাওবাব গাছ। এজন্য এদের নাম বাওবাব প্রিজন ট্রি! অস্ট্রেলিয়ার ইউন্ডহ্যাম অঞ্চলে দেখা মেলে এই বাওবাব প্রিজন ট্রির। এখন অবশ্য বন্দী রাখার বন্দোবস্ত নেই। বরং পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় এক জায়গা এটি! রীতিমত সারাবিশ্ব থেকে মানুষ আসে এই গাছগুলো দেখতে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সাভানুর নামক জায়গায় এমন তিনটি গাছের দেখা মেলে। ধারণা করা হয়, ভারতীয় বুশম্যানরা এখানে আস্তানা গেড়েছিলো এককালে।

উপকথায় বাওবাব গাছ

এদের নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প-গাঁথা! Source: face2faceafrica.com

বাওবাব গাছ নিয়ে সব অঞ্চলে কমবেশী নানা উপকথা প্রচলিত রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মাদাগাস্কারের মানুষদের বিশ্বাস, ঈশ্বর প্রথম বাওবাব গাছ তৈরি করে মাটিতে রোপণ করেছিলেন সেগুলোকে। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন তাল গাছ। তাল গাছ অনেক লম্বা আর সরু। সেগুলোকে দেখে বাওবাব গাছ ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ জানালো, তাকে কেন অত লম্বা বানানো হলো না? ঈশ্বর কিছু বললেন না।

এরপর তিনি লাল ফুলযুক্ত একধরনের গাছ সৃষ্টি করলেন। সেগুলোকে দেখে বাওবাব গাছ আবার নালিশ করলো ঈশ্বরের কাছে, তার ফুলগুলো কেন লাল নয়? ঈশ্বর এবারও চুপ রইলেন। এরপর তিনি সৃষ্টি করেন ডুমুর গাছ। ডুমুরের ফল দেখে বাওবাব গাছ আবার ঈশ্বরের কাছ গিয়ে অভিযোগ করতে থাকলো, তার ফল কেন ডুমুরের ফলের মতো সুন্দর নয়? এবার ঈশ্বর রেগে গেলেন খুব। তিনি বাওবাব গাছটিকে ধরে উল্টো করে মাটিতে পুঁতে দিলেন!

আরেকটি উপকথা আছে বাওবাব গাছকে নিয়ে। পৃথিবী সৃষ্টি করার পর ঈশ্বর সমস্ত গাছ সৃষ্টি করে এক জায়গায় রাখলেন। তারপর দেবতাদের দায়িত্ব দিলেন সেগুলো পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিতে! দেবতারা ছিল দারুণ আলসে। তারা আর পৃথিবীতে আসার কষ্ট করতে চাইলো না। স্বর্গ থেকে গাছগুলো পৃথিবীতে ছুঁড়ে দিতে লাগলো।

সব গাছের শিকড় মাটির দিকে থাকাতে তারা ঠিকঠাক পৃথিবীতে পৌছালো বটে, কিন্তু বাওবাব গাছের কপাল ছিলো খারাপ। শিকড়ের বদলে তার মাথা মাটির দিকে রেখে কোনো এক বেখেয়ালি দেবতা গাছটিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো পৃথিবীতে। তাই বাওবাব গাছের অমন পরিণতি!

ফিচার ইমেজ- athenas.it

Related Articles