
প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস চলচ্চিত্রটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। এই চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়, একদল বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জি কিভাবে ধীরে ধীরে মানুষের উপর রাজত্ব শুরু করে। প্ল্যানেট অফ দ্য এইপস অবশ্য নিছকই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। কিন্তু বাস্তবে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান না হলেও এই শিম্পাঞ্জি, হনুমান, গরিলা প্রভৃতি বানর শ্রেণির প্রাণীরা আকৃতিগতভাবে তো মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি বটেই, এদের বুদ্ধিও অন্য অনেক প্রাণীর তুলনায় বেশি। ফলে প্রায় সময়ই এরা সহজেই মানুষের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
এরকমই একটি বুদ্ধিমান পোষা গরিলা ছিল ব্রিটেনের একটি গ্রামে, যার আচার-আচরণ ছিল প্রায় মানুষের মতোই। এর নিজের একটি বেডরুম ছিল, এটি নিজের ঘর নিজে গোছগাছ করে রাখত, এমনকি এটি এলাকার স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলাও করতো। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এই গরিলাটির বাস ছিল ব্রিটেনের গ্লুসটারশায়ারের ছোট একটি গ্রাম ইউলিতে। এর নাম ছিল জন ড্যানিয়েল।

মার্গারেট গ্রুম এবং তার প্রকাশিত বই; Source: GLOUCESTERSHIRE LIVE
জন ড্যানিয়েল ছিল গ্রামের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি চরিত্র। গ্লুসটারশায়ারের স্থানীয় এক ইতিহাসবিদ মার্গারেট গ্রুম সম্প্রতি গ্রামটির ইতিহাস নিয়ে লেখা একটি বইয়ে জন ড্যানিয়েলের কথা উল্লেখ করেন। বইটিতে তিনি জন ড্যানিয়েলের বেশ কিছু দুর্লভ ছবিও প্রকাশ করেন। তার বর্ণনা এবং প্রকাশিত ছবিগুলোতে উঠে আসে জন ড্যানিয়েলের অসাধারণ ‘মানবিক’ জীবন যাপন এবং শেষ পর্যন্ত তার করুণ পরিণতির ইতিহাস।
জন ড্যানিয়েলের জন্ম হয়েছিল গ্যাবনে। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত পূর্ব আফ্রিকার দেশ গ্যাবন তখন ছিল ফরাসি ঔপনিবেশিকদের দখলে। ফরাসি সেনারা শিশু গরিলাটির বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাকে ইউরোপে নিয়ে আসে। একের পর এক হাত বদল হয়ে শেষ পর্যন্ত সে এসে হাজির হয় লন্ডনে। ১৯১৭ সালে ইউলি গ্রামের অধিবাসী মেজর রুপার্ট পেনি লন্ডনের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গরিলা শিশুটিকে বিক্রি করতে দেখতে পান। তিনি ৩০০ পাউন্ড (বর্তমানের হিসেবে প্রায় ২০,০০০ পাউন্ড) খরচ করে একে বাসায় নিয়ে আসেন এবং এর নাম রাখেন জন ড্যানিয়েল।

জন ড্যানিয়েল এবং অ্যালিস কানিংহাম; Source: GLOUCESTERSHIRE LIVE
জন ড্যানিয়েলকে রুপার্ট পেনি তার বোন অ্যালিস কানিংহামের বাড়িতে রাখেন। দোকানে জন ড্যানিয়েলের স্থান ছিল বেজমেন্টে অবস্থিত লোহার তৈরি খাঁচায়। কিন্তু অ্যালিসের কাছে এসে তার বন্দীদশার সমাপ্তি ঘটে। অ্যালিস তার নাম দেন সুলতান। অ্যালিসের বাড়িতে সে মানব সন্তানের মতোই বেড়ে উঠতে থাকে। মার্গারেট গ্রুমের বর্ণনা অনুযায়ী, অ্যালিসের বাসায় জন ড্যানিয়েলের জন্য একটি পৃথক বেডরুম ছিল। জন তার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজ নিজে নিজেই করতে পারত। সে রুমের লাইট জ্বালাতে-নেভাতে পারত, রুম পরিষ্কার করতে পারত এবং নিজে নিজেই টয়লেট ব্যবহার করতে পারত।
জন কানিংহাম পরিবারের সাথে টেবিলে চেয়ারে বসে খাবার খেত। খাবার টেবিলে তার আচরণ ছিল অত্যন্ত সভ্য এবং ভদ্র। সে অপেক্ষা করত এবং যখন তার খাবার হাজির হতো, সে চেয়ারটিকে নির্ধারিত স্থানে টেনে নিয়ে বসত এবং খাওয়া শুরু করত। সে খেত অত্যন্ত ধীরে ধীরে এবং কখনোই অন্য কারো খাবার ছিনিয়ে নিত না।

গ্রামের শিশুদের সাথে খেলছে জন ড্যানিয়েল; Source: GLOUCESTERSHIRE LIVE
জন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করত। যখন পানি শেষ হয়ে যেত, তখন সে নিজেই উঠে গিয়ে কল ছেড়ে গ্লাস পূর্ণ করে নিয়ে আসত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে কখনোই কল বন্ধ করতে ভুলে যেত না। জন বিকেল বেলা নিয়মিত এক কাপ চা এবং রাতের বেলা এক কাপ কফি পান করত।
মার্গারেট গ্রুম বলেন, কয়েক বছর আগেও গ্রামটিকে কিছু মানুষের দেখা পাওয়া যেত, যারা জন ড্যানিয়েলের কথা স্মরণ করতে পারত, যারা ছোটকালে তারা জন ড্যানিয়েলের সাথে একসাথে বড় হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের কেউই আর বেঁচে নাম। বর্তমান সময়ের ইউলির গ্রামবাসীরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না যে, একসময় তাদের গ্রামেই মানুষের পাশাপাশি বেড়ে উঠেছিল এক গরিলা সন্তান।

বোতল থেকে পান করছে জন ড্যানিয়েল; Source: GLOUCESTERSHIRE LIVE
উইলির গ্রামবাসীরা জন ড্যানিয়েলের বেশ ভক্ত ছিল। জন অধিকাংশ সময়ই গ্রামের শিশুদের সাথে খেলাধুলা করত। সে তাদের সাথে বাগানে ঘুরে ঘুরে গোলাপ ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত। গ্রামের শিশুরা তাকে ঠেলাগাড়ির উপর বসিয়ে গ্রাম জুড়ে ঘুরে বেড়াত। জন নিজেও জানত যে, গ্রামবাসীর কাছে সে জনপ্রিয়। নিজের রুমে থাকা অবস্থায় সুযোগ পেলেই সে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকত, যেন মানুষ তাকে দেখে আনন্দিত হয়।
জন আপেলের জুসের খুব ভক্ত ছিল। সে জানত গ্রামের কোন কোন বাড়িতে আপেলের জুস মজা হতো। সে প্রায়ই সেসব বাড়ি যেত আপেলের জুস খাওয়ার লোভে। গ্রামের মুচিকেও সে খুব পছন্দ করত। সে প্রায় সময় মুচির সামনে তার জুতা সেলাই করা দেখত।
লন্ডনে অ্যালিস কানিংহামের একটি বাড়ি ছিল। তিনি যখন লন্ডনে যেতেন, তখন মাঝে মাঝেই জন ড্যানিয়েলকেও সাথে নিয়ে যেতেন। সেখানে মিস কানিংহাম যখন পার্টি দিতেন, সেসব পার্টিতেও সগৌরবে উপস্থিত থাকত জন ড্যানিয়েল। অতিথিদের সামনেই সে হাঁটাচলা করত, চা-কফি পান করত।

জন ড্যানিয়েল; Source: GLOUCESTERSHIRE LIVE
কিন্তু জন ড্যানিয়েলের এই মানবীয় জীবন যাপন চিরস্থায়ী হয়নি। ১৯১৮ সালে যখন সে প্রথমে ইউলি গ্রামে এসেছিল, তখন তার ওজন ছিল মাত্র ১৪ কেজি। কিন্তু মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই সে শিশু থেকে ৯৫ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক গরিলায় পরিণত হয়। ফলে মিস কানিংহামের পক্ষে তার দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক আমেরিকান ব্যবসায়ীর মিথ্যা আশ্বাসে তিনি ১৯২১ সালে জন ড্যানিয়েলকে ১,০০০ গিনির বিনিময়ে বিক্রি করে দেন, যে তাকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, জনের স্থান হবে ফ্লোরিডার একটি পরিবারের বাসায়।
কিন্তু প্রতারক মার্কিন ব্যবসায়ী জনকে নিয়ে ব্যারনাম অ্যান্ড বেইলি নামে এক সার্কাস দলের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে পরে তার স্থান হয় নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানায় অবস্থানকালে জনের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, জনের বিমর্ষতা এবং অসুস্থতা অন্য প্রাণীদের মতো স্বাভাবিক কারণে ঘটেনি। সে তার পূর্ববর্তী ‘মা’য়ের অভাবেই গৃহকাতর হয়ে পড়ছে।

খাঁচায় বন্দী জন ড্যানিয়েল; Source: New York Public Library
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মিস কানিংহামের ঠিকানা খুঁজে বের করে এবং তার কাছে এক জরুরী বার্তা প্রেরণ করে, যেখানে লেখা ছিল, “জন ড্যানিয়েল আপনার শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। আপনি কি এখুনি আসতে পারবেন না? বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা আনন্দের সাথে আপনার যাতায়াতের খরচ বহন করব।“
বার্তা পাওয়ামাত্রই মিস কানিংহাম নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কানিংহাম যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার আগেই জন নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল সাড়ে চার বছর।
জন ড্যানিয়েলের মৃতদেহকে স্টাফ করা হয় এবং আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাশনাল হিস্টোরির কাছে দান করে দেওয়া হয় সংরক্ষণ করার জন্য। ১৯২২ সালে এটি নিউইয়র্ক জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছিল। এখনও এটি সেখানেই আছে।
ফিচার ইমেজ- GLOUCESTERSHIRE LIVE