Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাষ্ট্রের পরিচয় যখন পশু-পাখিতে

বাংলাদেশের জাতীয় পশু কোনটি? বাংলার বাঘ। আমরা বিশেষ করে আমাদের ক্রিকেট দলের সাথে ব্যাঘ্র পরিচয়টা জুড়ে দিতে খুবই পছন্দ করি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের লোকগাথা, শিল্প, সাহিত্য সবকিছুতেই প্রাণীটির উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা যায়। কাজেই বিশ্ব দরবারে বাঘ আমাদের জাতীয় পরিচয়কে বহুলাংশে প্রতিনিধিত্ব করে বললে খুব একটা ভুল হবে না।

এই যে কোনো পশু বা পাখির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় পরিচয় দেওয়া, এটা কেবল বাংলাদেশীদের একচেটিয়া অধিকার নয়। বস্তুত পৃথিবীর নানা দেশকে নানা পশুপাখির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়ে আসছে আজ বহুকাল ধরে। দেখা যাক উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পশু ও পাখির নাম, যারা পৃথিবীর অনেকগুলো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরা অনেকেই জাতীয় স্বীকৃতি পায়নি, তবে তারপরেও দেশগুলোর পরিচয় এই পশুপাখিদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে।

ভাল্লুক

ভাল্লুকের সাথে রাশিয়ার পরিচয়টা পাকাপাকিভাবে গাঁথা। সেই ১৬ শতাব্দী থেকেই ভাল্লুককে রুশ পরিচয়ের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়ে আসছে। এর মাঝে ভলগা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। রুশ সাম্রাজ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে হালের রুশ ফেডারেশন গঠিত হলেও রুশ জাতি আর ভাল্লুকের তকমাটা থেকে বার হয়ে আসতে পারেনি।

ইউক্রেন কব্জা করে নিয়েছে রুশ ভাল্লুক; Source: Polish Culture Forum

মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরে রুশীদেরকে ভাল্লুকের সাথে সেঁটে দেওয়ার এই প্রথা শুরু হয়। পরে মার্কিনরাও সেই তালে ধুয়ো দিয়েছে। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ সীমানায় থাকা হাজারে হাজারে ইউরেশীয় বাদামী ভাল্লুকের প্রাচুর্য দেখে আহ্লাদিত হয়ে এই কাজ করা হয়নি। প্রথাগতভাবেই ভাল্লুককে ধরা হয় বিশালদেহী, অলস এবং হিংস্র চরিত্রের একটি প্রাণী হিসেবে। বিদেশীরা রুশদেরকে, তথা রুশ রাষ্ট্রকে এই নজরে দেখতো বলেই ভাল্লুককে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিনিধি হিসেবে।

তা খাস রুশরা এই ব্যাপারটিকে কোন নজরে দেখেন? এক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক রুশ জনতার কাছে ভাল্লুক একটি জবরদস্ত শক্তিশালী প্রাণী। কাজেই ভাল্লুকের পরিচয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক রাজনীতিবিদই চেয়েছিলেন রাশিয়ার কোট অব আর্মসে ভাল্লুকের ছবি ব্যবহার করতে। বর্তমানে রাশিয়া শাসনকারী দল ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ এর প্রতীকও ভাল্লুক। সোভিয়েত আমলে আয়োজিত ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকের মাস্কট ছিল হাসিখুশি আদুরে ভাল্লুক ছানা মিশা। রুশদের পরিচয় কোনো হিংস্র ভাল্লুক নয়, এই হাসিখুশী ভাল্লুক ছানার মাধ্যমে নতুন করে তুলে ধরাই ছিল কর্তাদের উদ্দেশ্য।

হাশিখুশি ভাল্লুক মিশা; Source: Wall Street Journal

হালের ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং সিরিয়াতে রুশ হস্তক্ষেপের পরে এখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে চোখ বোলালে দেখা যায়, হরদম রাশিয়াকে ভাল্লুকের সাথে তুলনা দেওয়া চলছে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক; দুই অর্থেই ভাল্লুক আজ রুশদের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে।

মোরগ

প্রাচীন ফরাসি ভূমির নাম ছিল গল। এখন গল আর মোরগের লাতিন নাম একই- Gallus। যদিও মোরগের বিশেষ কোনো পৌরাণিক গুরুত্ব গল জাতির কাছে ছিল না। কিন্তু রোমানরা ফ্রান্স দখল করবার পরে হিসেবটা পাল্টে গেল। রোমানদের প্রাচীন দেবতা ‘মারকুরি’ এর সাথে মোরগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এদিকে মারকুরি গল অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় দেবতা হয়ে ওঠার সাথে সাথে ফরাসিদের সাথে মোরগের পরিচয়টাও পাকাপাকিভাবে স্থায়ী হয়ে গেল।

ফরাসী মোরগ; Source: imgur.com

পরবর্তী ফরাসি রাজারা মোরগকে অন্যতম জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন। মোরগেরা সকালে ডেকে ওঠে। অন্ধকারকে দূর করে আলোর আগমনের ক্ষণে এরা ডাকে বলে ফ্রান্সে মোরগকে শুভ দৃষ্টিতে দেখা শুরু হয়ে গেল। রেনেসাঁর আমলে এই প্রথা আরো বেগবান হয়। আর ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে তো কথাই নেই। সব যুদ্ধের স্মৃতিফলক আর ভাস্কর্যে ফ্রান্সকে মোরগের পরিচয়ে চিত্রিত করা শুরু হয়ে যায়।

টাকমাথা ঈগল

টেকো ঈগল বা টাকমাথা ঈগল শুনে হেসে উঠবেন না। প্রায় তিন ফুটের মত লম্বা এই বিরাট শিকারী পাখিটি বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। কোন দেশ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

টাকমাথা ঈগল; Source: foxnews

রেড ইন্ডিয়ানদের কাছে টাকমাথা ঈগলের গুরুত্ব ব্যাপক। এরা উর্বরতার প্রতীক, সাহসী এবং সূর্য দেবতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে এমনই নানা বিশ্বাস থেকে রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলো এই ঈগলকে সম্মানের নজরে দেখে। সেই প্রথা পরবর্তী সাদা আমেরিকানরা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পাখি এই টাকমাথা ঈগলকে নিজেদের কোট অব আর্মস এ ব্যবহার করে আরেক এশীয় রাষ্ট্র ফিলিপাইন।

দুই মাথাওয়ালা ঈগল

প্রকৃতিতে দুই মাথাওয়ালা ঈগলের মতো কিম্ভূত কোনো প্রাণী দেখা যায় না। তবে রোমান রাজাদের তাতে কিছু যায় আসতো না। বাইজান্টাইন আমল থেকেই দুই মাথাওয়ালা ঈগলকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়। পূর্ব এবং পশ্চিম দুই দিকেই সমানে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকা রোমান সাম্রাজ্যকে তুলে ধরতো এই ঈগল।

সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক দুই মাথাওয়ালা ঈগল; Source: ancient-origins.net

রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে পরবর্তীতে অন্য অনেক রাষ্ট্র/সাম্রাজ্য দুই মাথাওয়ালা ঈগল ব্যবহার করতে থাকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে। সেই তালিকাতে আছে প্রাশিয়া তথা জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, রাশিয়া, সার্বিয়া, মহীশূর এবং আলবেনিয়া। বলকান রাষ্ট্রগুলো, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়াতেও দুই মাথাওয়ালা ঈগলের ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল।

যদিও রোমানরাই এই প্রতীকের ব্যবহার শুরু করে, কিন্তু আদতে দুই মাথা ওয়ালা ঈগলের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালে তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চলে বসবাসরত হিট্টিরা প্রথম এই প্রতীক ব্যবহার করা শুরু করেছিল বলে জানা যায়।

স্প্রিংবক

এই ক্ষিপ্র অ্যান্টিলোপটির দেখা মেলে আফ্রিকায়। দক্ষিণ আফ্রিকা তাকে জাতীয় প্রাণীর মর্যাদা দিয়েছে। সাদাদের শাসনামল থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকানদের জাতীয় পরিচয়ের সাথে এই প্রাণীটি জড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্বেত শাসনের অবসান ঘটলেও স্প্রিংবক জাতীয় জীবনে নিজের গুরুত্ব জিইয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রাগবি দলকে স্প্রিংবক হিসেবে সম্বোধন করা হয়।

ক্যাঙ্গারু এবং এমু পাখি

দুই পায়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফানো প্রাণী ক্যাঙ্গারুদেরকে সবাই চেনেন। অস্ট্রেলিয়ার কোট অব আর্মসেও তাকে দেখা যায়। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এমু পাখি। মরুভূমিতে চড়ে বেড়ানো এই উটপাখি জাতীয় পাখিটিও অস্ট্রেলিয়ার কোট অব আর্মস এ স্থান পেয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার কোট অব আর্মস; Source: Wikimedia Commons

কিউই

সাড়ে চারশো গ্রামের এই ছোট্ট পাখিটা উড়তে পারে না। রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে খাবার খুঁজে বেড়ায়। লম্বা ঠোঁট আর গোলগাল গড়নের কারণে পাখিটি দেখতে খুব মিষ্টি।

তা কিউই পাখিকে মাথায় করে নিয়েছে তাদের জন্মভূমি নিউজিল্যান্ড। একমাত্র এই দেশটিতেই এই পাখিটির দেখা মেলে। নিউজিল্যান্ডের জাতীয় পাখি তো বটেই, নিউজিল্যান্ডের নাগরিকেরা পর্যন্ত নিজেদেরকে ‘কিউই’ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাখিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করবার ক্ষেত্রে এই পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সিংহ

গ্রেট ব্রিটেনের কোট অব আর্মসের দিকে তাকালে একটা সোনালি রঙ এর সিংহ দেখতে পাওয়া যায়। সাহস, আভিজাত্য আর মর্যাদার প্রতীক এই ‘পশুর রাজা’ পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। তবে পৃথিবীর সবথেকে বড় সাম্রাজ্যগুলোর একটির অধিকারী গ্রেট ব্রিটেনের সাথে সিংহের পরিচয়টা বেশি নিবিড়। গ্রেট ব্রিটেনের অংশ, ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলকে ‘থ্রি লায়নস’ বলে ডাকা হয়।

ব্রিটিশ সিংহ এবং রুশ ভাল্লুক; ছবিসূত্রঃ Pinterest

ফিচার ইমেজ: University of Richmond Blogs

Related Articles