
মানবচরিত্র বড়ই বিচিত্র। জীবনধারণের জন্যে মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। রোজকার এতো দৌড়ঝাঁপ, এতো সংগ্রাম, এতো ছলচাতুরী, এতো অপরাধ, এতো নিয়মের ভাঙা-গড়া, সবকিছুর পেছনে মানুষের একটাই কারণ কাজ করে- বেঁচে থাকা। কিন্তু এই মানুষই আবার সময় সময় নিজের উপরে হিংস্র হয়ে ওঠে, নিজেকে শেষ করে দিতে এক বিন্দু দ্বিধা করে না। জীবনের কোনো না কোনো এক সময় প্রত্যেকের মনেই আত্মহত্যার চিন্তা ভর করে। কিন্তু কেন? কেন এতো ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় মানুষ?

আত্মহত্যা, কিছু মানুষের জীবনের সর্বশেষ ভয়ানক সিদ্ধান্ত; Image Source: quyanachronicle.com
পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে আত্মহত্যার অনুমতি আছে, তবে বেশিরভাগ দেশেই এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ইসলাম ধর্ম, হিন্দুধর্ম, খ্রিষ্টধর্মসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুলোর কোনোটিই আত্মহত্যার অনুমতি দেয় না। তারপরেও ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম-নীতির উর্ধ্বে উঠে রোজই আমাদের আশেপাশে কেউ না কেউ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এর জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। শুধুমাত্র ২০১৩ সালেই বিশ্বজুড়ে ৮,৪২,০০০ মৃত্যু ঘটেছে আত্মহত্যার মাধ্যমে। এক আমেরিকাতেই বছরে গড়ে ৪৪,১৯৩ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে দশম হলো আত্মহত্যা। আর চিন্তায় ফেলার মতো ব্যাপার হলো, গত ৪৫ বছরে বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার হার ৬০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আত্মহত্যার হারের অঙ্কটি বাংলাদেশেও নিতান্ত তুচ্ছ না। WHO এর রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১১ সালেই বাংলাদেশে ১০,৬৯৭ জন আত্মহত্যা করেছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০১০ সালের একটি রিপোর্ট বলে, সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৬৫ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা প্রবণতার মধ্যে বাস করছে। লিঙ্গ বিবেচনায়, সমগ্র বিশ্বে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি। আর বয়স বিবেচনায় মধ্যবয়সীদের তুলনায় টিনএজারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স্ক মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা অত্যাধিক। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়, অপরাধসমূহ ও ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার মূল কারণ; Image Source: southerncannabis.org
আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরা হয় বিষণ্ণতা। জীবনে অনেক সময়ই পরিস্থিতি মানুষের আওতার মধ্যে থাকে না। হতাশা মানুষের স্বাভাবিক অনুধাবন ক্ষমতাকে গ্রাস করে ফেলে। বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে পারে আর্থিক সংকট, পারষ্পারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, কারও কর্তৃক উত্যক্ত হওয়া কিংবা নেহায়েত কিছুই না। অনেক সময় পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্বের কারণ আর অর্থ খুঁজতে গিয়েও মানুষ অতিমাত্রায় বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ৯০ শতাংশ আত্মহত্যা বিষণ্ণতার কারণেই সংঘটিত হয়।

অস্তিত্ব সঙ্কটও হতে পারে বিষণ্ণতার অন্যতম কারণ; Image Source: netnewsledqer.com
অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মানুষকে অসহায় হয়ে আত্মহননের পথে নিয়ে যায়, যেমন- অত্যাধিক উৎকণ্ঠা, সামাজিক ভীতি, শুচিবাই (OCD), বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া কিংবা একাকীত্ব। শুচিবাই বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (OCD) এর প্রভাবে মানুষ কোনো বিশেষ ধরনের ভয় বা বিরক্তিকর উদ্বেগ কাটাতে বিশেষ কোনো কাজ বারবার করতে বাধ্য হয়। যেমন- অনেকে জীবাণুর ভয়ে যেকোনো পরিস্থিতে বারবার হাত ধুতে বাধ্য হয়। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষের মেজাজ যখন তখন বিনা কারণে পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো মানুষ অত্যাধিক বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, আবার কখনো অহেতুক অতি আনন্দিত বোধ করে। এতে করে অনান্য মানুষদের সাথে এদের ভাবের আদান-প্রদান যথারীতি ব্যাহত হয় এবং এরা একা হয়ে পড়ে। সিজোফ্রেনিয়া একটি অতি উচ্চমানের ঝুঁকিসম্পন্ন মানসিক সমস্যা। এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তি বাস্তব চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না, বরং অতিমাত্রায় কাল্পনিক বিভ্রমে ভুগতে থাকে। বিষাদগ্রস্ততা, দৃষ্টিভ্রম, স্নায়বিক বৈকল্যসহ আরও বিভিন্ন রকম উদ্ভট সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ব্যক্তির সামাজিক জীবন ব্যাহত হয়। ২০% থেকে ৪০% সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে বিভিন্ন কারণ; Image Source: wikiwand.com
এসব মানসিক সমস্যার প্রত্যেকটিই মানুষকে সমাজের সাথে মিশতে বাধাগ্রস্ত করে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বিভেদ তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে, মানুষ একা হয়ে পড়ে এবং বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। আর বিষণ্ণতা সরাসরি যে চিন্তার দিকে ধাবিত করে, সেটি হলো আত্মহনন।
আবার PTSD বা ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ অনেক সময় মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। শারীরিক বা মানসিকভাবে নিপীড়নের শিকার হলে মানুষ এক ধরনের ‘ট্রমা’ (Trauma) বা মানসিক অসুস্থতার মধ্যে বাস করে। বছরের পর বছর ধরেও এই অবস্থা চলতে থাকে। সেই নিপীড়নকালীন সময়ের দৃশ্যাবলি আর স্মৃতিগুলো মানুষকে সব সময় কষ্ট দিতে থাকে। এই কষ্ট থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে মানুষ আত্মহননকেই একমাত্র পথ মনে করে। উত্যক্তকরণ ও ধর্ষণজাতীয় নির্যাতনগুলোর ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা সৈনিকদের অনেক সময় মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।

ছেড়ে চলে যাওয়া কোনো সমাধান নয়; Image Source: filmpedia.com
বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনে ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততা ক্রমে মানুষকে নিঃসঙ্গ করে ফেলছে। প্রতিটি মানুষ তার চারিদিকে এক অদৃশ্য দেয়াল নিয়ে ঘুরছে। যে পরিমাণে নিত্যনতুন মানসিক সমস্যায় মানুষ রোজ আপতিত হচ্ছে, সে পরিমাণে মানসিক সহায়তা তারা একে অপরের কাছ থেকে পাচ্ছে না। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানসিক রোগীর হার, বৃদ্ধি পাচ্ছে আত্মহত্যার হার। অথচ একটু সচেতনতাই পারে অসংখ্য জীবন বাঁচাতে। বেশিরভাগ আত্মহত্যা সংঘটিত হয় অন্তত একজন পাশে থাকার মানুষের অভাবে। বেশিরভাগ আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি থাকে না যে তাদের চিন্তা ভাবনা আসলে সীমাবদ্ধ এবং তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। একজন বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা পরিচিত যে কেউ বিষণ্ণতার মধ্যে দিয়া যাবার সময় আমাদের তার পাশে দাঁড়ানো উচিত। তার সাথে জীবনের আশামূলক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত; কিংবা প্রয়োজনে কিছুই না বলে শুধু তার কথা শোনা উচিত। শুধু কয়েকটা নিশ্চুপ মুহূর্তও একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে।
বর্তমানে জায়গায় জায়গায় অনেক মানসিক সেবাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রয়োজনে দ্বিধা না করে সরাসরি পেশাদার পরামর্শদানকারীর সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ। যতটা সম্ভব সৃষ্টিশীল কাজে মনোনিবেশ করলে বিষণ্ণতা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ইতিবাচক পরিবেশ এবং ইতিবাচক মানুষদের সাহচর্য মানুষের জীবনমুখী হবার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। যেকোনো ধরনের মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে।
ঈশ্বর জীবন দিয়েছেন লড়াই করে বাঁচার জন্য, হার মেনে পালিয়ে যাবার জন্য নয়। আর তাই একজন হার না মানা বীরের মতো জীবনের সঙ্কটকালীন সময়গুলো উতরে যেতে হবে। মনের মধ্যে শক্তি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমাধান নয়। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখাই নিজেকে বাঁচানোর একমাত্র পথ।

নিজের উপরে বিশ্বাস রাখা জরুরী; Image Source: e-buddhism.com
জীবনকে যতগুলো সম্ভব সুযোগ দেয়া উচিৎ। রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টার পরেই ভোরের সূর্যোদয়ের দেখা পাওয়া যায়। আজ সময় যত কঠিন, কাল ততটা না-ও থাকতে পারে। আজ যেখানে শুধুই গুমোট মেঘ, কাল সেখানে রংধনুর ছড়াছড়ি হতেই পারে। এটাই জীবনের নিয়ম। এই নিয়মের সাথে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যাক প্রতিটি মানুষ। সুন্দর হোক সবার জীবন। নিজেকে জয় করার গর্বে গর্বিত হোক প্রতিটি জীবন।
“কতো লক্ষ জনম ভ্রমণ করে পেয়েছি এই মানব জনম, এ জীবন চলে গেলে, ও ভোলা মন, আর তো পাবো না…।”

জীবন হোক বিজয়ের গৌরবমন্ডিত; Image Source: slideshare.net