ডাইনোসর বইয়ের পাতার কল্পজগৎ থেকে উঠে আসা কোনো প্রাণী নয়। বাস্তব পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক প্রাণী যারা একসময় দাপিয়ে বেড়াতো গোটা দুনিয়া জুড়ে। প্রকৃতির কাছে হার মেনে পৃথিবী থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, আজও সকল বয়সী মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রাণীটি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ডাইনোসর নিয়ে গবেষণার বয়সও খুব বেশি নয়। মাত্র ১৭০ বছর পূর্বে ব্রিটেনের মধ্য লন্ডনে প্রথমবারের মতো বিশালাকার ডাইনোসরের একটি পূর্ণাঙ্গ অস্থির সন্ধান পাওয়া যায়। ডাইনোসর নিয়ে গবেষণা, তত্ত্ব, রহস্য কিংবা গল্পের শেষ নেই। হারিয়ে যাওয়া প্রাণীটি নিয়ে গবেষণার অন্যতম অবলম্বন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম। এসব জীবাশ্মের উপর গবেষণার থেকেই আবিষ্কার হয় ডাইনোসরের কোনো এক নতুন প্রজাতি, নতুন বৈশিষ্ট্য, নতুন তত্ত্ব যা পুরনো তত্ত্বকে বাতিল করে দেয় কিংবা বাতিল করে দেওয়া পুরনো তত্ত্বকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে।
ডাইনোসর নিয়ে মানুষের অপার আগ্রহ শুধুমাত্র এটির বিশাল দেহ কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নয়, অবাক করা নানা বৈশিষ্ট্য এবং প্রাণীটি সম্বন্ধে নিত্যনতুন তথ্য আবিষ্কার মানুষকে অসীম আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ধরে রেখেছে আজও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডাইনোসর নিয়েও চলেছে বিরামহীন গবেষণা, জানা গেছে এমন কিছু আকর্ষণীয় তথ্য যা ডাইনোসরের বিলুপ্তি ও বিবর্তনের ইতিহাসকে নতুন করে বুঝতে সাহায্য করবে।
১. উভচর ডাইনোসর
ব্যক্তিগত সংগ্রহে বছরের পর বছর কাটানোর পর, মঙ্গোলিয়া থেকে পাচার করা একটি জীবাশ্ম যখন উদ্ধার করা হয় তখনো কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে, ডাইনোসরের ইতিহাসে যুক্ত হতে যাচ্ছে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য। ডাইনোসরের নতুন এই প্রজাতিটি জলে-স্থলে উভয় জায়গাতেই বাস করতো অর্থাৎ এটি ছিল একটি উভচর ডাইনোসর! বিজ্ঞানীরাও গবেষণার শুরুতে ব্যাপারটি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান, কেননা ইতিপূর্বে যত ডাইনোসর আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই উভচর ছিল না। তারা সন্দেহ করতে শুরু করেন যে, এটি হয়তো ভিন্ন ভিন্ন জীবাশ্মের মিশ্রণ। কিন্তু ব্রিটেনের বিশেষ একধরনের তরঙ্গ যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এটি একটি আসল ও সম্পূর্ণ জীবাশ্ম।
নতুন আবিষ্কৃত এই ডাইনোসরটির নাম দেওয়া হয়েছে Halszkaraptor escuilliei, নামকরণটি করা হয়েছে একজন জীবাশ্মবিদ হালস্কা অসমোলস্কা ও জীবাশ্ম সংগ্রাহক ফোঁসওয়া এসকুইলির নামে। ডাইনোসরটির শারীরিক বৈশিষ্ট্য খুবই অদ্ভুত। এর ঘাড় অনেকটা রাজহংসের মতো, পায়ে রয়েছে ধারালো নখ, হাঁসের ন্যায় পিছনে রয়েছে লেজ এবং দু’পাশে দুটি ডানা সদৃশ অঙ্গ বিদ্যমান। মনে করা হয়, পিছনের লেজের মতো অংশ ও দুই পাশের ডানার মতো অঙ্গগুলো একে সাঁতার কাটতে সহায়তা করতো। বর্তমানের বেশিরভাগ উভচর প্রাণীর মতোই এটি স্থলভাগে দৌড়াতে পারতো এবং জলে সাঁতার কাটতে সক্ষম ছিল। তাছাড়া অন্যান্য ডাইনোসরের তুলনায় এর চোয়ালে দাঁতের সংখ্যাও বেশি ছিল। এটি শুধুমাত্র ডাইনোসরের একটি নতুন প্রজাতি হিসেবে উল্লেখযোগ্য নয়, ডাইনোসর নিয়ে গবেষণায় প্রাণীটি খুলে দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
২. মাংসাশী থেকে নিরামিষভোজী ডাইনোসর
সাধারণত মানুষের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যায়, বয়স বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে দাঁতগুলো মজবুত হতে হতে শেষ বয়সে দুর্বল হতে শুরু করে, এমনকি সেই সময়ে মানুষ দাঁত হারাতেও শুরু করে। Limusaurus প্রজাতির অদ্ভুত ডাইনোসরগুলোর শৈশবকালে শক্তিশালী দাঁতের অধিকারী হলেও, যৌবনে পদার্পণের পর্যায়ে দাঁত হারাতে শুরু করে। মাত্র ১.৫ মিটার লম্বা দ্বিপদী এই প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব ছিল প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। মাত্র ১২ বছর বয়সে যাদের সবগুলো দাঁত পড়ে যেত। সবগুলো দাঁত হারানোর পর, তাদের মুখের সামনে অংশ পরিবর্তিত হয়ে পাখির ধারালো ঠোঁটের মতো রূপ নিত। এই পরিবর্তনের ফলেই শুরুতে এই ডাইনোসরগুলো মাংসভোজী হলেও, পূর্ণবয়স্করা নিরামিষ খেয়ে জীবন ধারণ করত। এরকম বিবর্তন অন্য কোনো প্রজাতির ডাইনোসর তো নয়ই, বরং বর্তমান কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়নি।
চীনা গবেষকদের দলটি প্রায় ৬টি ভিন্ন বয়সের ১৯টি নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করার পর দেখেন যে, এ ডাইনোসরগুলো জন্ম নিত এক সেন্টিমিটার লম্বা ১২টি দাঁত নিয়ে। তাছাড়া এই প্রজাতিটির জীবদ্দশায় আরো ৭৭টি শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাথার খুলির পরিবর্তন এবং উপরের চোয়াল বাঁকিয়ে নিচের দিকে নেমে আসা, যেটি একসময় ধারালো ঠোটে রূপান্তরিত হয়। বিবর্তনের এই পর্যায়ে বাধ্য হয়েই মাংসের উপর নির্ভরশীল ডাইনোসরগুলো পরবর্তীতে তৃণভোজী প্রাণীতে পরিণত হয়। গবেষকরা মনে করছেন যে, প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে শিশু ডাইনোসরদের খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনতে এই পরিবর্তন ব্যাপক ভূমিকা রাখতো।
৩. পাখির মতো ডিমে তা দিতো ডাইনোসর
‘চিকেন ফ্রম হেল’ ডাক নাম দেওয়া ডাইনোসরগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বিশালাকার এবং গায়ে পাখির মতো পালক দ্বারা আবৃত। পালকযুক্ত ডাইনোসরগুলোর মধ্যে এরাই সবচেয়ে বৃহৎ। Anzu wyliei নামক ডাইনোসরগুলো Oviraptorosaurs এর অন্তর্ভুক্ত এবং এদের ওজন প্রায় এক মেট্রিক টন পর্যন্তও হতে পারে। অনেকটা পাখির মতো দেখতে ডাইনোসরগুলোর দাঁতবিহীন ঠোঁট, লম্বা ও বিশাল পা, ডানা সদৃশ নখযুক্ত বাহু। ফ্রান্স ও চীনের সম্মিলিত দলের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, কিছু ডাইনোসর পাখির মতো ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতো এবং এগুলোই Oviraptorosaurs ডাইনোসর।
ডাইনোসর নিয়ে শত বছরেরও বেশি সময় নিয়ে গবেষণা হলেও, বিলুপ্ত হয়ে প্রাণীগুলো একসময় কীভাবে তাদের বংশবিস্তার করতো তা ছিল বিশাল এক রহস্য। কিন্তু নতুন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য এই সংক্রান্ত রহস্যের জট খুলতে প্রাথমিক ধারণার প্রবর্তনের মাধ্যমে ডাইনোসর সংক্রান্ত ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই ডাইনোসরগুলোর জীবাশ্ম প্রথম যখন পাওয়া যায়, সেগুলো পাওয়া গিয়েছিল পাখির বাসার আশেপাশে। বিজ্ঞানীরা তখন ধারণা করে যে, হয়তো অন্য কোনো প্রাণীর ডিম চুরি করতে গিয়ে ডাইনোসরগুলো সেই প্রাণীর হাতে নিহত হয়েছিল। তাই এদের বলা হতো ‘ডিম চোর’। একইসাথে অবশ্য কিছু জীবাশ্মবিদ মনে করতেন যে, Oviraptorosaurs ডাইনোসরেরাই তাদের ডিমে তা দিত এবং বাচ্চা ফোটাতও।
প্রায় ৭০ মিলিয়ন বছর পূর্বের জীবাশ্ম ডিম নিয়ে গবেষণা করেন দলটি, ডিমগুলোতে এখনো ভ্রণের অস্তিত্ব রয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, ডাইনোসরগুলি ডিমের উপর বসে তা দিত প্রায় ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, যা বর্তমান কালের পাখিদের মতোই। এই প্রজাতির চেয়ে বড় ডাইনোসরদের পক্ষে সাধারণত ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব না হয়তো। তবে ডিমগুলোর উপর গাছের পাতা কিংবা অন্যান্য শুকনো দ্রব্যাদি দিয়ে থাবা দ্বারা আবৃত করে বাচ্চা উৎপাদনের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করা একেবারে অসম্ভব ছিলো না।
৪. নতুন প্রজাতির সবচেয়ে বড় ডাইনোসর
কত বড় হতে পারে একটি ডাইনোসর? এই প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর সম্ভব না হলেও, ডাইনোসরের জীবাশ্মের কল্যাণে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীটির বিশালত্বের একটি আনুমানিক ধারণা পাওয়া যায়। নতুন নতুন জীবাশ্ম আবিষ্কারের ফলে প্রায় কিছু বছর পরপর, আবিষ্কৃত ডাইনোসরগুলো একটি আরেকটি ছাড়িয়ে যেতে থাকে।
২০১৭ সালে নতুন যে ডাইনোসরের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটি হলো Titanosaurs গোত্রের Patagotitan mayorum। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে বড় ডাইনোসর এটি এবং এমনকি পৃথিবীর মাটিতে হেঁটে বেড়ানো সবচেয়ে বড় প্রাণীও এই ডাইনোসরটি। ১০২ মিলিয়ন পূর্বে পৃথিবীতে বিচরণ করা প্রাণীটি অন্য সব দৈত্যাকার ডাইনোসরগুলোর মতো লম্বা গলার অধিকারী। সর্ববৃহৎ ডাইনোসরটি লম্বায় প্রায় ১২০ ফুট, উচ্চতা ২০ ফুট এবং ওজন প্রায় ৬৯ টন যা প্রায় ১২টি আফ্রিকান হাতির সমান ওজন। বর্তমান পৃথিবীতে স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণীটি হলো আফ্রিকান হাতি। Patagotitan ডাইনোসরগুলো আকারে হয়তো আরো বড় হতে পারে, কেননা প্রাপ্ত নমুনা থেকে গবেষকরা আরেকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এগুলোর বৃদ্ধি তখনো থেমে যায়নি। Patagotitan ডাইনোসরের পূর্বে সর্ববৃহৎ ডাইনোসরের খেতাব ছিল Dreadnoughtus ডাইনোসরের, যেটি লম্বায় প্রায় ৮৫ ফুট ছিল।
৫. ডাইনোসর গোত্রের ইতিহাস পুনর্লিখন
Ornithischia ও Saurischia হলো ডাইনোসরের প্রাথমিক দুটি গোত্র, যা ১৩০ বছর পূর্বে জীবাশ্মবিদ হ্যারি শেলি বলে গেছেন। হ্যারি মূলত ডাইনোসরের আকারের উপর ভিত্তি করে কাজ করেছিলেন এবং সেই সময়ে প্রাপ্ত জীবাশ্মের সংখ্যাও তেমন একটা বেশি ছিলো না। বর্তমান সময়ে হ্যারির প্রণীত কাজের সাথে নিত্য নতুন আবিষ্কারের সামঞ্জস্যতা তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ডাইনোসর গোত্রের নতুন মডেল তৈরি করছেন যা হ্যারির কাজকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে।
কম্পিউটারের সাহায্যে প্রায় ৪৫০টি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে, ৭৫টি ভিন্ন ডাইনোসর নিয়ে নতুন মডেল তৈরি করা হয়েছে। নতুন আদর্শ মডেল তৈরি করতে একই কিংবা কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এর ফলে ডাইনোসরের প্রায় ১০ হাজার সম্ভাব্য গোত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন ৮০টি অবস্থা অবতারণার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডাইনোসরেরা পৃথিবীতে ২৪৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে বিচরণ করতো, যা প্রমাণ তত্ত্বের চেয়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর বেশি। প্রস্তাবিত নতুন গোত্র বর্তমান প্রতিমানের চেয়ে বেশি যুক্তিসঙ্গত এবং এটি গৃহীত হলে ডাইনোসরের বিবর্তনের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।
ফিচার ইমেজ- wallpapercave