বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত ২০ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী, উদ্ভিদ এবং জীবাণু আবিষ্কার করেছে। কিন্তু ধারণা করা হয়, আরো ১০ লক্ষাধিক নতুন প্রজাতি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৮ হাজারের অধিক নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। এগুলোর মধ্যে পতঙ্গ ও প্রাণীর সংখ্যাই বেশি। সাধারণত নতুন কিছু আবিষ্কৃত হলে তা ‘The International Institute for Species Exploration (IISE)’ রীতিমত উদযাপনই করে। সেই সাথে তারা প্রতিবছর সেরা ১০টি নতুন আবিষ্কৃত প্রজাতির তালিকাও প্রকাশ করে।
আমরা সচরাচর বিগত বছর ঘটে যাওয়া ঘটমান বিষয়ের তালিকা বছরের শেষ মাসে অথবা নতুন বছরের প্রথম মাসে পেয়ে থাকি। কিন্তু নতুন প্রজাতির তালিকা পেতে হলে চোখ রাখতে হয় চলমান বছরের ২৩ মে-তে। এই দিনটিতে জন্মেছিলেন আধুনিক শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যার জনক ও দ্বিপদ নামকরণের প্রবর্তক ক্যারোলাস লিনিয়াস। সুতরাং ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত সেরা ১০টি নতুন প্রজাতির তালিকা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। আজকের লেখায় জানবো ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত সেরা ১০টি নতুন প্রজাতির প্রাণী-পতঙ্গ ও উদ্ভিদ নিয়ে।
১) সর্টিং হ্যাট মাকড়শা
জে. কে রোলিংয়ের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের বই থেকে পাওয়া সর্টিং হ্যাটের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে নতুন আবিষ্কৃত একটি মাকড়শার। প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Eriovixia gryffindori । আকারে ক্ষুদ্র, ২ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট মাকড়শাটির শরীরের উপরিভাগ দেখতে কনিক্যাল বা মোচাকৃতির, যা জাদুকর গড্রিক গ্রিফিন্ডরের টুপির ন্যায়, যা তিনিই প্রথম মাথায় পরেছিলেন।
মাকড়শাটি পাওয়া যায় ভারতে। আবিষ্কার করেছেন সেখানকার তিনজন গবেষক জাবেদ আহমেদ, রাজশ্রী খালাপ এবং সুমুখা জাভাগাল। মাকড়শাটি যখন ছদ্মবেশে থাকে তখন মৃত, শুকনো ও বাদামী পাতার মত রূপ ধারণ করে। নিশাচর এই মাকড়শা সাধারণ মাকড়শার মতোই জাল বুনতে পারে। মাকড়শাটির পুরুষ প্রজাতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
২) ক্যাটিডিড
মালয়েশিয়াতে পাওয়া গেছে ক্যাটিডিড নামক পতঙ্গ প্রজাতিটি, নাটকীয়ভাবে এদের স্ত্রী ও পুরুষ বর্ণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরুষ প্রজাতির ক্যাটিডিড দেখতে পুরোপুরি সবুজ। অপরদিকে স্ত্রী পতঙ্গটি দেখতে লাল এবং গোলাপী।
ঘাসফড়িংয়ের ন্যায় দেখতে বড়ই অদ্ভুত এই পতঙ্গটিকে দেখে যে কেউই সবুজ বা গোলাপী পাতা ভেবে ভুল করতেই পারেন। ক্যাটিডিডের বৈজ্ঞানিক নাম Eulophophyllum kirki।
মালয়েশিয়ার বোর্নিও দ্বীপে, গবেষকরা বিষাক্ত মাকড়শা ও সাপ খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যান অদ্ভুত এই পতঙ্গটি। এটি লম্বায় মাত্র ১.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
৩) রুট ইঁদুর
অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী কর্তৃক ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপে রুট ইঁদুর আবিষ্কৃত হয়। লেজসহ মাত্র ৩০ সে. মি. দৈর্ঘ্যের ইঁদুরটির ওজন ৪০ গ্রাম।
রুট ইঁদুর, সুলাওয়েসী ওয়াটার র্যাট বা ইঁদুরের মতো হলেও সে শুধু পোকামাকড় খায় না। সে উদ্ভিদের মূল, কন্দ এবং পোকামাকড়ও খায়। অথচ সুলাওয়েসী ওয়াটার র্যাট, যেটি পানিতেও চলাচল করে, সেটি শুধুমাত্র পোকামাকড় খায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Gracilimus radix।
৪) চার লিঙ্গের মিলিপ্যাড
প্রাণীজগতে এ পর্যন্ত সর্বাধিক পায়ের অধিকারী হচ্ছে সিফোনোরিনিড মিলিপ্যাডস, যার পায়ের সংখ্যা ৭৫০টি। অপরদিকে নতুন আবিষ্কৃত মিলিপ্যাড Illacme tobini এর পায়ের সংখ্যা ৪১৪ টি। পায়ের সংখ্যায় সেরা না হলেও এটি সমগ্র জীবনকাল ধরে শরীরের খণ্ডাংশ ও পায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে।
প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা প্রাণীটির কোনো চোখ নেই। পুরুষ প্রাণীর চারটি পা লিঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে স্ত্রী প্রাণীতে শুক্রাণু প্রবেশ করে থাকে। এছাড়াও শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য রয়েছে ২০০টি বিষ নিঃসরণকারী গ্রন্থি। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের প্রাণীটি যুক্তরাষ্ট্রের সিকোয়া জাতীয় উদ্যানে আবিষ্কৃত হয়েছে।
৫) পিঁপড়া
পাপুয়া নিউ গিনিকে পৃথিবী নামক গ্রহের বিরল প্রাণীর আবাসস্থল বলে গণ্য করা হয়। বিরল প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ৮০০ প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সেখানে।
সম্প্রতি ‘গেম অফ থ্রোনস’ এর ড্রাগনের মতো অদ্ভুত একটি পিঁপড়ার খোঁজ মিলে যায় এই নিউ গিনিতে। পিঁপড়াটি কাঁটাযুক্ত হওয়ায় তাকে ড্রাগন পিঁপড়া বলা হয়। Pheidole drogon হচ্ছে পিঁপড়াটির বৈজ্ঞানিক নাম।
প্রথমে ধারণা করা হতো, পিছনে থাকা কাঁটাগুলো শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, কাঁটাগুলো পেশীকে সংযুক্ত রাখার কাজ করে।
৬) স্টিংরে
নতুন আবিষ্কৃত সেরা ১০টি প্রাণীর তালিকায় আরেকটি প্রাণী হচ্ছে স্টিংরে, ব্রাজিলের টোকানটিনস নদীতে পাওয়া যায়। প্রাণীটি লম্বায় ৪৩ ইঞ্চি ও ওজন ২০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
Potamotrygon rex হচ্ছে কালচে থেকে কালচে-বাদামী প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম। এই বর্ণের সাথে হলদে ও কমলা রংয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর সমাবেশ ঘটে। প্রাণীটির প্রায় ৩৫ সে. মি লম্বা লেজ রয়েছে। দেখতে চাবুকের ন্যায় লেজটি আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
৭) সেন্টিপ্যাড বা শতপদী
Scolopendra cataracta, নতুন আবিষ্কৃত সেন্টিপ্যাড বা শতপদী প্রাণী, যার সন্ধান পাওয়া যায় লাওস, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে। এরা লম্বায় প্রায় ৮ ইঞ্চি ও ২০ জোড়া পা রয়েছে।
প্রাণীটিকে দেখে পরিচিতই মনে হচ্ছে, তাই নয় কি! আমাদের দেশেও এমন একটি প্রাণী পাওয়া যায় বলে ভাবছেন? আসলে আপনার ধারণা ভুল। কারণ এই প্রাণীটিই হচ্ছে একমাত্র উভচর সেন্টিপ্যাড বা শতপদী, যা পানিতে সাঁতারও কাটতে পারে ও পানির নিচে হাঁটতেও পারে। আবার স্থলেও চলাচল করে।
৮) টমেটো
প্রাণীজগতে নানাকিছু আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদজগতেও নতুন নতুন আবিষ্কারের খোঁজ পাওয়া যায়। উদ্ভিদজগতে এ বছরের সেরা ১০টি নতুন আবিষ্কৃত প্রজাতির তালিকায় স্থান পেয়েছে টমেটো। টমেটোটির বৈজ্ঞানিক নাম Solanum ossicruentum। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ১৫০ জন জীববিজ্ঞান শিক্ষার্থী নতুন আবিষ্কৃত টমেটোটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছেন।
এই টমেটো শুকালে হাড়ের মতো শক্ত হয় বলে বৈজ্ঞানিক এমন নামকরণ করা হয়েছে। ল্যাটিন ‘ossi’ এর অর্থ হাড়ের ন্যায় এবং ‘cruentum’ অর্থ হচ্ছে রক্তাক্ত। এই টমেটো কাটলে রক্তলাল বর্ণ পাওয়া যায়। এই বর্ণ মূলত বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় তৈরি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৯) অর্কিড
কলম্বিয়ায় নতুন এক প্রজাতির অর্কিডের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। Telipogon diabolicus এর বৈজ্ঞানিক নাম। এই অর্কিডের স্ত্রী ও পুরুষ জননাঙ্গ একত্রিত হয়ে শয়তানের মাথার ন্যায় আকৃতি দিয়েছে। এটাই হচ্ছে Telipogon diabolicus অর্কিডের বিশেষত্ব ও এই নামকরণের কারণ।
নতুন আবিষ্কৃত অর্কিডের পাপড়িটাও দেখতে কিছুটা অদ্ভুত। নখের মতো দেখতে পাঁপড়িগুলো এটিকে শয়তানের অবয়ব প্রদানে আরও বেশি চমক দিয়েছে বলে মনে করেন আবিষ্কারকেরা।
১০) চুরো
ক্যালিফোর্নিয়ার গভীর সমুদ্রে প্রায় ৫,৬০০ ফুট পানির নিচে আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন আরেকটি প্রাণী। নাম তার চুরো। প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Xenoturbella churro। সামুদ্রিক এই প্রাণীটি লম্বায় প্রায় ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
স্পেন ও লাতিন আমেরিকার ভাজা প্যাস্ট্রি বা চুরোর মতো দেখায় বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে চুরোর। প্রাণীটি মানুষের মতো দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম। অর্থাৎ মানুষের কপাল, নাক ও বুকের মাঝ বরাবর লম্বালম্বি কেটে ফেললে, উভয়পাশে যেমন একই দেখা যাবে, তেমনি চুরোকেও দু’ভাগ করলে একই দেখাবে।
প্রাণীটির কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো, এদের মুখ আছে কিন্তু পায়ুপথ নেই। আবার আদর্শ ডিম্বাশয় নেই, কিন্তু সমস্ত শরীরেই ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর উপস্থিতি রয়েছে।
ফিচার ইমেজ- sci-news.com