অধিকাংশ লোকই পরিণত বয়স না হওয়া পর্যন্ত বুঝতেই পারেন না তাদের ভবিষ্যতটা কীভাবে সাজাবেন। এমনকি শেষকালে গিয়ে দেখেন, তার দ্বারা কিছুই করা হয়ে ওঠেনি! অনেকেই আবার পারিপার্শ্বিক নানামুখী চাপ ও কথাবার্তায় বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকেন। ফলে তাদের পক্ষেও সঠিক লক্ষ্যের সন্ধান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেরই কৈশোর কেটে যায় স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক, খেলাধুলা আর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডায়। তবে এসবের ব্যতিক্রম দেখা যায় মাত্র ৯ বছর বয়সী ফিলিপাইনের বালক কেন আমান্তর বেলায়। যে বালক মাত্র ৯ বছর বয়সেই রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালকে আশ্রয় দিয়েছিল নিজের বাসায়। তৈরি করেছিল ‘হ্যাপি অ্যানিম্যাল ক্লাব’ বা ‘শুভ প্রাণী ক্লাব’ নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান! ক্লাবটি আজও আশ্রয়হীন, বেওয়ারিশ, অসুস্থ প্রাণীদের কাছে খুবই উন্নতমানের আশ্রয়স্থল। কারণ সেখানে খাবার, চিকিৎসাসহ সবকিছুরই ব্যবস্থা করে থাকে বালক কেন আমান্ত।
ঘটনাটি ২০১৪ সালের। শিশু কেন আমান্ত বাসা থেকে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দুই সপ্তাহের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যেত। ছোট্ট একটি বালকের এমন আচরণ বাবা-মায়ের দৃষ্টিতে ভয় ও সন্দেহের উদ্রেক করতেই পারে। কেনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভয় ও সন্দেহের কারণে একদিন বাবা তার সন্তানের পিছু নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন কেনকে দেখে বাবা স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি দেখেন, তার ছেলে ফিলিপাইনের গ্রাম্য রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ, রোগ-শোকে আক্রান্ত কুকুরকে খাবার দিচ্ছে! এরপর তিনি কিছু ছবি তুলে ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন।
কেন তার বাবাকে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা জানায়। সে সময় ফিলিপাইনের বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে সরকারিভাবে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া ছিল। কারণ সেখানে শতকরা মাত্র ২০-৩০ ভাগ কুকুরের মালিকানা ছাড়া বাকিগুলো ছিল বেওয়ারিশ।
কুকুর হত্যার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো প্রাণী কল্যাণ সংস্থাও এগিয়ে আসছিল না। কুকুর-বিড়ালকে কোনো প্রকার কারণ ছাড়া মেরে ফেলার সিদ্ধান্তকে মানতে কষ্ট হচ্ছিল শিশু কেনের। বাবাকে জানায় সে সেগুলোকে আশ্রয় দিতে চায়। বাবা সন্তানের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে গর্ববোধ করলেও অর্থনৈতিক সংকটের ভাবনায় পড়ে যান। তিনি তার ছেলেকে জানান, কুকুরের আশ্রয়ের জন্য ঘর নির্মাণ ও খাবার ক্রয়ের জন্য প্রচুর টাকার দরকার। এছাড়াও পুরোপুরি কাজের জন্য সময়ের দরকার পড়বে প্রায় ২০ বছর। তাছাড়াও কেনের মতো বাচ্চার দ্বারা এমন কাজ করা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ ছিল বাবার।
কেন ছোটবেলা থেকেই ঘুমাতো বাবার পোষা বিড়ালকে সাথে নিয়ে। মাত্র আট বছর বয়সে বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালকে আশ্রয় দেওয়ার স্বপ্ন থেকে পোস্টারও তৈরি করে সে। যেখানে প্রাণীদের ভালোবাসা ও রক্ষার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। কেন রাস্তা থেকে কালো, বাদামী ও সাদা বর্ণের কুকুর ছানাকে বাসায় নিয়ে এসে তার বাবার গ্যারেজে আশ্রয় দেয়। এটিই ছিল কেনের প্রথম অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র। সে কুকুরগুলোর নাম রাখে ব্ল্যাকি, ব্রাউনী এবং হোয়াইট পাপ্পি।
প্রাণীর জন্য শিশু মন কাঁদে যখন, স্রষ্টাও বোধহয় সঙ্গী হতে চান তখন। তাই হয়তো সে সময় ইন্টারনেট জগতে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরকে খাবার দেওয়া শিশু কেনের ছবি দ্রুত ভাইরাল হতে থাকে। একটি শিশু রাস্তার অসুস্থ তিনটি কুকুরকে খাবার দিচ্ছে, এমন ছবি যে কাউকেই হতভম্ব করে দিতে সক্ষম হয়। তখন বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রাণীপ্রেমীরা একটি শিশুর প্রাণীপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে সহায়তার হাত বাড়ায়। সে সময় কেন অনলাইন দ্বারা ২৭,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড অনুদান পেয়েছিল, যার বর্তমান মূল্য বাংলাদেশী টাকায় দাঁড়ায় ৩১,৯৫,১২৪ টাকা!
১ মে, ২০১৪ সালে কেন অনুদানের টাকা থেকে ১,৫০০ ডলার দিয়ে এক বছরের জন্য ১০,০০০ বর্গ ফুট জায়গা ইজারা নেয়। সেখানে তার বন্ধু ও পিতার সহায়তায় বেওয়ারিশ কুকুরকে আশ্রয় দিতে দুটি বৃহদাকারের ঘর নির্মাণ করে। এছাড়াও প্রাণীদের রাখার জন্য দুটি পেন বা খোঁয়াড়ও নির্মাণ করে। অতঃপর বেওয়ারিশ কুকুর তিনটিকে উন্নতমানের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে কেন। কেন কুকুরগুলোকে ভাল মানের কৌটাজাত খাবার পরিবেশন করেছিল। এছাড়াও মাইট আক্রান্ত কুকুরগুলোকে ভেটেরিনারিয়ান তথা প্রাণী চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসাও করায়। যথাযথ পরিচর্যা, চিকিৎসা ও খাবার পেয়ে কুকুর তিনটি দু’মাসেই সুস্থ ও সুন্দর হয়ে ওঠে।
কুকুরগুলোর ক্ষত শুকিয়ে নতুন লোম গজায়। তাছাড়াও তারা মানুষের সাথে মিশতে শেখে। এভাবেই মাত্র ৬-৭ বছর বয়স থেকে মহৎ কিছু করার স্বপ্নে বিভোর বালক কেনের দ্বারা মাত্র ৯ বছর বয়সে গড়ে ওঠে ‘হ্যাপি অ্যানিম্যাল ক্লাব’ নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ ফিলিপাইনের দ্বীপ মিন্দানাওয়ের দাবাও শহরে অবস্থিত প্রথম কোনো বেওয়ারিশ প্রাণীর আশ্রয়দানকারী প্রতিষ্ঠান। তাছাড়াও ক্লাবটি আজও সেখানকার একমাত্র নিবন্ধনকৃত সফল প্রাণীর আশ্রম ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ধরে রেখেছে। বর্তমানেও প্রতিষ্ঠানটি কেন ও তার স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় কারণ ব্যতিরেকে উদ্ধারকৃত প্রাণীগুলো আশ্রয়কেন্দ্রের খাঁচায় বন্দী থাকে না। এছাড়াও সেখানে বিড়ালের জন্য অধিকতর মুক্তভাবে বিচরণের জায়গা প্রদান করা হয়। মুক্তভাবে চলাফেরার সুযোগ পেয়ে প্রাণীগুলো সত্যিই খুব খুশি হয়ে যায়। প্রাণীগুলোর আনন্দ বৃদ্ধির জন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিন কেন সেগুলোকে পার্কে অথবা খেলার মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে কুকুরগুলো আনন্দে ছোটাছুটি ও খেলাধুলা করে থাকে। প্রতিটি কুকুরকে সপ্তাহে অন্তত একবার কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করায়। কেন এসব কাজ পড়ালেখার পাশাপাশি চালিয়ে আসছে। তবে এজন্য তাকে প্রিয় ফুটবল খেলা থেকে বিরত থাকতে হয়।
পোষাপ্রাণী হিসেবে কুকুর-বিড়ালের যথেষ্ট কদর থাকলেও তারা কিন্তু কম বিপজ্জনক নয়! বিশেষত রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো বেওয়ারিশ কুকুরতো আরও মারাত্মক হতে পারে। তাছাড়াও প্রাণীগুলোর মানসিক অবস্থাও বুঝে শুনে কাজ করা উচিত। এমনই এক বিপজ্জনক কুকুর ছিল এমিলি। কুকুরটি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। সেটি কাছে গেলে যে কাউকেই কামড় দেয়ার চেষ্টা করত। আসলে যারাই প্রাণী পোষেন বা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন তাদেরই উচিত পোষাপ্রাণীকে জলাতঙ্কসহ বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করা। আর অবশ্যই প্রাণী পালনকারীদের জলাতঙ্কের টিকা নেয়া উচিৎ। জলাতঙ্কের টিকা নেয়ার ব্যাপারে কেন ছিল খুবই উৎসাহী। তাই সে ‘হ্যাপি এনিম্যাল ক্লাব’ চালু করার পরপরই জলাতঙ্ক রোগের টিকা নেয়।
কেন এর আশ্রম থেকে সুস্থ হওয়া কুকুরগুলোকে পরবর্তীতে যারা প্রাণী লালন পালন করতে চান তাদেরকে দেওয়া হয়। যদিও রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো বর্ণসঙ্কর কুকুরকে নেয়ার বিষয়ে ফিলিপাইনের লোকদের আগ্রহ কিছুটা কম। তথাপিও কেন হতাশ হয় না। সে বিভিন্নভাবে আশ্রয়হীন প্রাণীদের সংগ্রহ করে আশ্রয় ও সেবাদান করে। কেন স্বপ্ন দেখে তার আশ্রয়কেন্দ্রটি আরও বড় আকারে হবে ও অধিক লোক বেওয়ারিশ প্রাণীকে পোষার জন্য নেবে, অধিক লোক প্রাণীদের আশ্রয় ও খাবার ক্রয়ের জন্য অর্থ সহায়তা দেবে। এছাড়াও সারাবিশ্বে ‘হ্যাপি অ্যানিম্যাল ক্লাব’ এর শাখা খোলা হবে। যেসব শাখা প্রতিনিয়ত অলাভজনকভাবে প্রাণীদের জন্য কাজ করে যাবে, যাদের সহায়তায় কোনো প্রাণীকেই অকালে মৃত্যুবরণ করতে হবে না।
প্রাণীকে ভালোবেসে একটি ছোট শিশুর তৈরি করা প্রতিষ্ঠান হয়তো একদিন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ প্রাণীজগৎ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হবে। জগতের সকল প্রাণী নিরাপদ আবাস ও মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হবে।
ফিচার ইমেজ – Happy Animal Club Inc.